হ্যাঁ, আমি। বারান্দায় বসে বসে ঘুমুচ্ছিস কোন আক্কেলে? শেষটায় নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে, নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবি না? নিজের শরীরের যত্ন নিজে না করলে কে করবে? বৌ-মার অবস্থাও তো ভালো না।
আমি কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা ভয় নিয়ে বাবাকে দেখছি। শেভ করেন নি, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা-কালো দাড়ি। প্রতি দিন শেভ করা বাবার ধাতে ছিল না। প্রতি তিনদিন পর পর শেভ। পয়সা বাঁচানো।
হাঁ করে কী দেখছিস রে খোকন?
আপনাকে দেখছি।
দেখাদেখির কিছু নেই রে বাবা। সময় সংক্ষেপ। এখন কাজে লেগে পড়তে হবে। তুই একা পাববি না বলেই তোকে সাহায্য করতে এসেছি।
আমাকে সাহায্য? আমাকে কী সাহায্য?
বৌ-মার ডেডবডি সরাবার ব্যবস্থা করতে হবে না? তুই একা পারবি?
আমি হেসে ফেললাম। আমার বাবা, ঠােকরোকানা স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব এসেছেন আমাকে সাহায্য করতে। পুরো ব্যাপারটা এক ধরনের হেলুসিনেশন। কিংবা আমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি। মানুষ যখন ভয়াবহ কোনো সমস্যায় পড়ে তখন স্বপ্নে সে রিলিফ পায়। এও এক ধরনের রিলিফ। আমাকে সাময়িক রিলিফ দেওয়াবা জন্যে আমার বাবা আজহার উদ্দিন সাহেব চলে এসেছেন। কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলছেন, তোকে সাহায্য করতে এসেছি–হা হা হা।
হাসছিস কেন রে খোকন? এটা কি হাসির সময়?
আপনি একা এসেছেন কেন বাবা? মাকে নিয়ে এলেন না কেন?
তাকে আনব কী করে? তাকে কুকুরে কামড়াল না? ওর কি চলাফেরার অবস্থা আছে! তুই অকারণে দেরি করছিস। আয় আমরা কাজে নেমে পড়ি।
আচ্ছা বাবা, আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
মাথা খারাপ হবে কেন? আমার তো পাগলের বংশ না। এই বংশে কোনো পাগল নেই। আমাদের অতি উচ্চ বংশ।
বাবা, আপনাকে দেখে ভালো লাগছে। বসুন। কিছু খাবেন বাবা গরম চা কিংবা কফি?
চা খাওয়া যায়। শীতটাও বেজায় নেমেছে–তুই পাতলা একটা শার্ট গায়ে দিয়ে ঠাণ্ডায় বলে আছিস কীভাবে?
আমি আবারো হো হো করে হাসলাম। নিজের হাসির শব্দে নিজেই চমকালাম। কী আশ্চর্য কণ্ড ঘটছে স্বপ্নে, বাবাকে দেখছি। একেবারে বাস্তবের মতো স্বপ্ন। কিংবা কে জানে সত্যি সত্যি বাবা হয়তো পরলোক থেকে চলে এসেছেন। এখন পিতা-পুত্র মিলে ডেডবডি সরাব–হা হা হা।
হাসছিস কেন রে খোকন?
এমনি হাসছি।
চা বানালে তাড়াতাড়ি বানা। আদা থাকলে এক টুকরা আদা দিয়ে দিবি। আমার গলা বসে গেছে।
বাবা ই ই করে গানের কী একটা কলিও যেন ভাজলেন। সখি হে সখি হে ধবনের গান। এ তো দেখি ভালো যন্ত্রণা হলো।
আমি বারান্দা থেকে বসার ঘরে ঢুকলাম, বাবা পেছনে পেছনে এলেন। শব্দ কবে হাই তুল্য লন, আঙ্গুলো তুড়ি বাজলেন। আমাকে স্বীকার করতেই হবে, এটা যদি স্বপ্ন হয়ে থাকে তা হলে বেশ কঠিন এবং জটিল স্বপ্ন। Powerful dream.
বাবা আনন্দিত গলায় বললেন, ঘর-দোয়ার তো খুব ঝকঝকে।
আমি বললাম, আপনার বৌমার শুচিবায়ুর মতো আছে।
আগ বলবি তো–আমি ধুলাপায়ে ঢুকেছি।
কোনো সমস্যা নেই, ও তো আর কিছু বুঝতে পারছে না।
তাও সত্যি। তুই ভালো কথা মনে করেছিস। এখন মূল বিষয়ে আয়–ডেডবডি কীভাবে সরাবি বলে ঠিক করেছিস। পদ্ধতিটা কী?
ডিসপ্যাবসান পদ্ধতি।
সেটা কী?
সত্যি জানতে চান?
অবশ্যি জানতে চাই।
ডেডবডিটা, টুকরো টুকরো কবে বড় একটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। পূব ভালো পদ্ধতি। ফুল প্রুফ।
আমার কাছে তো খুব ভালো পদ্ধতি বলে মনে হচ্ছে না। নোংরা পদ্ধতি বলে মনে হচ্ছে। কাটাকুটি কে করবে? তুই?
হুঁ।
পারবি? এত দিনের চেনা একটা মেয়ে। তার উপর প্রচণ্ড রাগ থাকলে অবশ্যি পারবি। আছে প্ৰচণ্ড রাগ?
কিছুটা আছে।
তোর বলার ভঙ্গি থেকে মনে হয় রাগ কমে গেছে। এখন তো কাটাকুটি করতেই পাববি না। তাছাড়া রক্ত টক্ত বের হয়ে বিশ্ৰী অবস্থা হবে। ডিসপারসান পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি নেই? তোর মাথা তো বেশ পরিষ্কার। চিন্তা ভাবনা কবে কিছু বের করতে পারিস না?
বাবা আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মোটা চশমার আড়ালে বাবার চোখে আগ্রহ ঝিকমিক করছে। সেই চোখ দেখে আমার পেটে হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠছেকী বিশ্ৰী ঝামেলা তৈরি হয়ে গেছে। আমি আমার চোখের সামনে আমার নিজের মনেরই একটি অংশকে দেখতে পাচ্ছি। সেই অংশটি বাবাব রূপ ধরে সামনে এসেছে। আমাকে তান দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি জানি যথাসমযে সে নিজ মূর্তি ধরবে।
খোকন!
জি বাবা।
কই চা খাওয়াবি বলেছিলি তার কী করলি!
চা বাবা আপনি খাবেন না–কারণ আপনার আসলে কেনো অস্তিত্ব নেই। আমি যদিও আপনাকে দেখছি, আসলে আপনি আমার সমানে নেই। আমার মাথার নিউবোনে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে বলে আমি আজগুবি সব ব্যাপার দেখতে শুরু করেছি।
তোর মাথায় কী হয়েছে?
কী হয়েছে আমি জানি না। বড় কোনো সাইকিয়াট্রিন্টের কাছে গেলে তিনি হয়তো বলতে পারতেন। তা তো সম্ভব না।
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, বৌমার মৃত্যু তোকে খুব এফেক্ট করেছে। নিজের হাতে খুন করেছিস তো, এই জন্যেই বেশি লাগছে। ভাড়া করা লোক পেলি না? ওরা যা করার চুপি চুপি করত— তুই টাকা দিয়ে খালাস। মানুষ মারতে আজকাল কত নেয়? রেট কত?
চুপ করুন তো বাবা।
তুই নিজ হাতে খুন করেছিস বলে কি তোর কোনো অপরাধ বোধ আছে?
না।
গুড। না থাকাই উচিত। মৃত্যু হলো কপালের লিখন। যার যেভাবে মৃত্যু লেখা সেভাবেই হবে। তুই নিমিত্ত মাত্র, বৌমার কপালে লেখা ছিল তোর হাতে মৃত্যু। তুই হাজার চেষ্টা করেও সেই লেখা ফেরাতে পারতি না। কাজেই যা হবার হয়েছে। বি হ্যাপি।