বাবা হাসিমুখে বললেন, ভয় ভেঙেছে খোকন?
আমার ভয় ভাঙে নি, তবু আমি মাথা নাড়লাম। বাবা হৃষ্ট স্বাবে বললেননিম্নশ্রেণীর প্রাণিদের ভয় পেতে নেই, ভয় যদি পেতেই হয় মানুষকে ভয় পাবি। মানুষ অতি উচ্চশ্রেণীর প্রাণী মানুষকে ভয় পাওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে।
রুবা চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কি? আমি তার গায়ে হাত রেখে বললাম, আমি কিছু খেয়ে আসি। আমার খিদে পেযেছে। একগাদা পোলাও খেয়েছি, তারপবেও খিদেয় মরে যাচ্ছি; ফ্রিজে কি খাবার কিছু আছে?
হুঁ।
আমি খাবার ঘরে ঢুকলাম। এই ঘরের দেয়ালে বিবাট একটা ঘড়ি আছে। ঘড়িতে দুটা বাজে। আশ্চৰ্য, আমি তো বিরাট একটা ভুল করেছি। খাবার ঘরে বাতি জ্বলছে, শোবার ঘরে বাতি জ্বলছে, বারান্দায় বাতি জ্বলছে, বসার ঘরে বাতি জ্বলছে। পুলিশ কেইস হলে অনেকেই সাক্ষ্য দেবে–অনেক রাত পর্যন্ত ঐ বাড়িতে বাতি জ্বলছিল।
খাবার ঘর ও বসার ঘরের বাতি নিভালাম। একসঙ্গে সবগুলো বাতি নেভানোও ঠিক না। সন্দেহ হবে। ফ্রিজ খুললাম। অনেক খাবারই আছে। পলিথিনের ব্যাগে মোড়া স্যান্ডউইচ, লাড্ডু, রসমালাইয়ের একটা হাঁড়ি।
একটা লাড্ডুর অর্ধেকটা মুখে দিতেই আমার খিদে চলে গেল, বমি বমি ভাব হলো। প্রচুর খাওয়া হলে যেমন বমি ভাব হয় সে-রকম।
আমি শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে এক গ্লাস ঠাণ্ড পানি নিয়ে বসলাম। রুবার ঘরের বাতি এখনো জ্বলছে। বাতি নিভিয়ে দেওয়া দরকার। বাতি জ্বালানো থাকলে কেউ ঘুমুতে পারে না। রুবা তো একেবারেই পারে না। যদিও এই রুবা হলো অন্য রুবা। তবুও দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাস।
রুবার ঘরে ঢুকলাম। সে ঠিক আগের মতো শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। চোখ এখনো খুলে নি। এটা একটা ভালো লক্ষণ। সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে? ডেকে দেখব?
থাক, ডাকার দরকার নেই। কাঁটায় কাটায় এক ঘণ্টা পর এসে দেখব কী ব্যাপার। এই এক ঘণ্টা আমি বিশ্রাম নেব। বারান্দায় চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকব। আমার নিজের বিশ্রাম দরকার। অস্বাভাবিক ব্যাপার যা ঘটছে বিশ্রাম নিলে সেসব পুরোপুরি বন্ধ হতে পারে।
আমি বারান্দায় এসে বসলাম। জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। বারান্দা চিক দিয়ে ঢাকা, তারপরেও চিকের ফাঁক দিয়ে শীতল হওয়া আসছে। একটা চাদরে গা ঢেকে বসা দরকার ছিল। পা তুলে বসলাম। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করতে হবে–নিয়তো শেষটায় পাগল হয়ে যাবে। বারান্দার বাতি নেভানো, তবু খানিকটা আলো আসছে। চাঁদের আলো? যখন গিয়েছে ড়ুবে পঞ্চমীর চাঁদ। কে বলত এ কথাটা? রুবা না? হ্যাঁ রুবা।
একদিন অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরি হলো–ইয়ার এন্ডিং-এর কামেলা। বাসায় ফিরেছি। রাত এগারোটায়। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিল। আমি ঘরে ঢুকে দেখি বিরাট উৎসব। রুবার বন্ধু-বান্ধবরা বারান্দায় গোল হয়ে বসে আছে। আজ না কি চাঁদেব পঞ্চমী। চাঁদ ড়ুবে গেলে জীবনানন্দের আট বছর আগের একদিন কবিতা পড়া হবে।
রুবা পরীর মতো সেজে বসে আছে। গলায় ফুলের মালা। খোপায় ফুল। রুবা এসে বলল, তুমি চট করে হাত-মুখ ধুয়ে আমাদের সঙ্গে এসে বসো তো।
কেন?
সুব্ৰত এসেছে।
সুব্ৰতটা কে?
আশ্চর্য! সুব্রতকে চেন না? বিখ্যাত আবৃত্তিকার। নান্দনিক গোষ্ঠীর সুব্রত দে। ও আজ কবিতা পাঠ করবে।
আমি একাউন্টেন্ট মানুষ। আমি কবিতার কী বুঝি? তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না। তুমি চুপচাপ বসে থাকবে। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
তিনটা প্যারাসিটামল খাও। আমি গরম এক কাপ চা বানিয়ে দিচ্ছি। চা খাও। চা খেয়ে আমাদের সঙ্গে বসো। জীবনানন্দ দাশের কবিতা তোমার ভালো লাগবে।
রুবা-প্রায় জোর করেই আমাকে বারান্দায় নিয়ে গেল। রুবার বন্ধু-বান্ধবরা একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। সুব্রত নামের ছেলেটা আমাকে পাত্তাই দিল না। সে পৌষমেলার কী এক গল্প করছিল–সেই গল্পই করতে লাগল। আমি বোকার মতো খানিকক্ষণ বসে। থেকে শোবার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন শুনি কবিতা পাঠ হচ্ছে। সুব্রত না, কবিতা পড়ছে রুবা–
যখন গিয়েছে ড়ুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ;
বধু শুয়েছিল পাশে–শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল–জ্যোৎস্নায়–তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙ্গে গেল তার?…
কবিতা শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। গাঢ় গভীর ঘুম। এমন গাঢ় ঘুম অনেক দিন ঘুমাই নি।
এখনো ঘুম পাচ্ছে। চোখ ভেঙে ঘুম নামছে। ঘুমিয়ে পড়াটা কি ঠিক হবে? যদি সময়মতো ঘুম না ভাঙে! যদি জেগে উঠে দেখি দশটা বেজে গেছে–চারদিক আলো হয়ে আছে।
খোকনা! খোকন!
আমি ধড়মড় করে উঠলাম। বাবার গলা। শ্লেষ্মা জড়ানো ভারী স্বর। ভুল হবার কোনো কারণ নেই। বাবার গলা শুনব কেন? তিনি বেঁচে নেই। ডেড এন্ড গান। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। বাবা আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যেমন দাঁড়ান, খানিকটা কুজো হয়ে একটু বুকে এসেছেন। গা থেকে কড়া তামাকের গন্ধ আসছে। তাঁর গায়ে হলুদ কোট। কোটের তিনটা হলুদ বোতামের একটা লাল। হলুদ বোতাম একটা খুলে পড়ে গিয়েছিল। মা কোথেকে যেন একটা লাল বোতাম এনে লাগিয়ে দিলেন। বাবা নির্বিকার। সেই কোট পরেই স্কুলে ক্লাস নিতে যান।
খোকন, ওঠ্ ওঠ্। তোর এক ঘণ্টা ঘুমুবাব। কথা, তুই ঝাড়া দেড় ঘণ্টা ঘুমুচ্ছিস। ওঠ ওঠ। শেষে একটা বিপদ বাধবি।
বাবা আপনি?