আচ্ছা।
পানি খাবে?
না!
পানি খাবে না?
খাব।
রুবাকে কড়া ঘুমের ওষুধ কিছু খাইয়ে দিলে কেমন হয়? যে কাজটা আমি করতে পারি নি ঘুমের ওষুধ সেটা করবে। হাই ডোজের হিপনল আমার কাছে আছে। পানিতে গুলে সরবতের মতো করে খাইয়ে দিতে পারলে আর দেখতে হবে না। রুবা খেতে আপত্তি করবে বলে মনে হচ্ছে না। মবে গেলে তার জন্যেও ভালো, আমার জন্যেও ভালো!
ড্রয়ার খুলে কুড়িটা টেবলেট পেলাম। আধগ্লাস পানিতে কুড়িটা টেবলেট, ঘন পেস্টের মতো তৈরি হলো। চেখে দেখি তিতা এবং মিষ্টি মিলে বিশ্ৰী স্বাদ। এই জিনিস কেউ খেতে পারবে না, কিন্তু রুবা পারবে। অবশ্যই পারবে। সে মানুষের স্তরে এখন নেই। সে এখন অন্য কোনো স্তরে। এই স্তরে স্বাদ-বৰ্ণ-গন্ধ বলে কিছু থাকার কথা না।
আচ্ছা, আমি এইসব কী ভাবছি? এখন ভাবাভাবির সময় না। সময়টা হলো কাজের। টাইম অব অ্যাকশন। দেরি করা যাবে না। সময় নষ্ট করা যাবে না। যা করার খুব ভেবে-চিন্তে করতে হবে। সকাল আটটার আগে ডেডবডি সরিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে। শ্বশুর সাহেবকে ঘুম থেকে তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে হবে।–রুবা এখনো ফিরে নি। শ্বশুরবাড়ি থেকেই ওসি সাহেবকে টেলিফোন করতে হবে।
আমি গ্রাস হাতে রুবার কাছে গেলাম। রুবা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে আমাকে দেখল। না।
রুবা নাও, খেয়ে ফেলে।
সে গ্লাস নেবার জন্যে হাত বাড়াল না। বাড়বে না জানতাম। সেই বোধ এখন তার নেই। আমাকেই খাইয়ে দিতে হবে। আমি তাকে উঠে বসালাম, তার মুখের কাছে গ্লাস ধরলাম। সে খাচ্ছে। চুকচুক করে খাচ্ছে।
খেতে মজা না?
উঁ।
খাও, আরাম করে খাও। খেয়ে ঘুমিয়ে থাক।
উঁ।
তুমি মেয়ে খারাপ না। মেয়ে ভালো।
উঁ।
শুধু ভালো মেয়ে বললে কম বলা হয়, তুমি বেশ ভালো মেয়ে… ..বুঝতে পারছ?
হুঁ।
আমি যা করেছি। বাধ্য হয়ে করেছি। ঈর্ষার কারণে করেছি। তোমাল নানান ধরনের বন্ধু-বান্ধব। ওদের সঙ্গে তুমি কত গল্প কর, কত হাসোহাসি। আমার সঙ্গে কোনো গল্প কর না। হুঁট করে ওদের সঙ্গে বের হয়ে যাও, আমার সঙ্গে যাও না। এ জন্যেই রাগ হতো।
হুঁ।
বেশি রাগ না, অল্প রাগ। অল্প রাগটা বাড়তে বাড়তে এরকম হয়ে গেল।
বুঝতে পারছি?
হুঁ।
তাছাড়া আমার চেহারা ভালো না। মুখ খানিকটা বাঁদরের মতো, দাঁত বের হয়ে থাকে–এই নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের কমপ্লেক্স আছে। আমার ধারণা, কেউ আমাকে সহ্য করতে পারে না। রুবা, তুমি কি আমার কথা শুনতে পোচ্ছ?
হুঁ।
অফিসেও কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। প্রয়োজনে কথা বলে, অপ্রয়োজনে কথা বলে না। শুধু নুরুজ্জামান সাহেব মাঝে মাঝে বলেন। আর কেউ না। তুমিও তাই কর। কাজেই আমার ধারণা হয়েছিল–তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। বুঝতে পারছি?
হুঁ।
এই জন্যেই আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি। যাতে কখনো আমাকে ফেলে চলে যেতে না পার। বুঝতে পারছি কি বলছি?
হুঁ।
কাজটা অন্যায় হয়েছে। খুব অন্যায়। পৃথিবী জায়গাটা সুবিধার না। এখানে মাঝে মাঝে অন্যায় না।
হুঁ।
তোমার জন্যে আমার এখন খারাপ লাগছে। খারাপ লাগা উচিত না, কিন্তু লাগছে।
আচ্ছা।
আমি খুব শক্ত মানুষ, বুঝলে রুবা, অসম্ভব শক্ত মানুষ। মন খারাপ কী ব্যাপার তা আমি জানি না। আমি কোনোদিন কাঁদি না। কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে।
হুঁ।
আমার মার কথা কি আমি তোমাকে কোনোদিন বলেছি রুবা?
না।
বলি নি। আমি কাউকে বলি নি। আমি কি আমার বড়বোনের কথা বলেছি?
না।
আমি কাউকেই কিছু বলি না। আমি সব নিজের মধ্যেই রেখে দেই।
হুঁ।
আমার বড়বোনের নাম কী বলো তো?
রুবা।
ঠিক বলেছ, রুবা। তোমাদের দুজনের মধ্যে খুব মিল। আমার বড়বোন ঘুমের মধ্যে হাঁটফেল করে মারা গিয়েছিল। ডাক্তারের রিপোটে তাই আছে। আসল ব্যাপারটা শুনবে?
রুবা শব্দ করল না। আমি বললাম, কিছু খাবে?
না।
তুমি এখন আরাম করে ঘুমাও। শুয়ে পড়। এসো শুইয়ে দেই।
আমি রুবাকে শুইয়ে দিলাম। সে কোনো আপত্তি করল না। মুখ এখনো হা হয়ে আছে, ওষুধের গুঁড়া লেগে আছে। কুৎসিত দেখাচ্ছে। চোখ খোলা। মাছের মতো চোখ, চোখে পলক পড়ে না।
আমি রুবার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা কর। কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছি–ভালো ঘুম হবে। যা ঘটার ঘুমের মধ্যেই ঘটবে। তুমি কিছু টের পাবে না। চোখ বন্ধ করা।
রুবা চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। পারছে না। আমি চোখের পাতা টেনে দিলাম। রুবার গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে গেছে। দেখাচ্ছে মসৃণ কিন্তু হাত রাখলেই খসখসে। ভাব! অনেকটা সাপের গায়ের চামড়ার মতো। দূর থেকে কী মসৃণ দেখায়, কিন্তু হাত দিলেই খসখসে। আমি একবার সাপের গায়ে হাত দিয়েছিলাম। সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাতে এসেছে। সবাই খেলা দেখছি। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে বাবার কোলে বসে আছি। সাপ এক একবার ফণা তুলছে, আমি আতঙ্কে জমে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠছি। বাবা এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, সাপ অতি নিম্নশ্রেণীর একটি প্রাণী। একে ভয়ে পাবার কিছু নেই। বিষদাঁত ভাঙা সাপ কেঁচোর কাছাকাছি। খোকন, তুমি সাপেব গায়ে হাত দাও। দাও হাত। হাত দিয়ে দেখ; একবার এর গায়ে হাত দিলেই তোমার ভয় ভেঙে যাবে। দাও, হাত দাও।
আমাকে হাত দিতে হলো। ধবিধার কথা অগ্রাহ্য করার সাহস আমাদের ভাইবোনদের কোনো কালেই ছিল না।
সাপের গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলাম— কী খসখসে চামড়া!