রুবা। আবারো হাসতে লাগল। আবারো তার শাড়ির আঁচল মাথা থেকে খসে। পড়ল। তখন আমার মনে হলো–এই অদ্ভুত মেয়েটা কি সত্যি বাকি জীবন আমার পাশে থাকবে?
আমি বললাম, তোমার দাঁত ব্যথা কি কমেছে?
রুবা হাসতে হাসতে বলল, আমার দাঁত ব্যথা ছিল না। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না বলে, মিথ্যা করে বলেছি–দাঁত ব্যথা।
ও আচ্ছা।
কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না কেন সেটা শুনবেন?
বলো?
প্রথমবার আপনার চেহারা যতটা খারাপ লেগেছিল–আজ তার চেয়ে দশগুণ বেশি খারাপ লাগছে। এই জন্যেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা। আপনি কি কবিতা শুনতে ভালোবাসেন?
না।
জানতাম ভালোবাসেন না। আমি যে-সব জিনিস পছন্দ করি আমার স্বামী সে-সব পছন্দ করবেন তা কী করে হয়। আপনি আবার রাগ করছেন না তো?
না।
আমার কিন্তু অনেক ছেলেরন্ধু আছে। আমি ওদের সঙ্গে খুব ঘোরাঘুরি করি। আপনি আবার বলবেন না–ওসব চলবে না। গৃহপালিত পশু হয়ে যাও। বলবেন না তো?
না।
তাহলে এক মিনিটের জন্যে আমার হাতটা ধরতে পারেন।
রুবা হাত বাড়িয়ে দিল। এমন চমৎকার একটা মেয়েকে ভেবে চিন্তে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছি। কেন করলাম? আমি কি অসুস্থ? আমি কি সাইকোপ্যাথ?
না, আমি অসুস্থ না। আমি সাইকোপ্যাথও না। আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। এই মেয়েকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার ছিল না। ও সরে যাচ্ছিল। আমি তা হতে দিতে পারি না!
এখন সে আর কোথাও যেতে পারবে না। কোনো বন্ধু এসে এখন আর তার কবিতা শুনবে না। বা কারো সঙ্গে বুড়িগঙ্গায় জোছনা দেখতে যেতে পারবে না।
আচ্ছা আজ কি জোছনা আছে? আকাশ আলো হয়ে আছে, কিন্তু আমি কোনো চাঁদ দেখছি না।
ঘরে ফেরা দরকার, ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। রুবার মুখোমুখি হতে ভয় করছে।
আমি ঘরে ঢুকলাম। বসার ঘরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হলোশোবার ঘরের দরজাটা না খুললে কেমন হয়? থাকুক রুবা বন্ধ ঘরে। আমি বাতটা সোফায় শুয়ে কাটিয়ে দেই। ডেডবডি সরানোর কাজ রাতের বেলা না করে দিনে করাই ভালো। দিনে চারদিকে প্রচুর মানুষ থাকে। সবাই ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকায় না। রাতে সবাই সবাইকে সন্দেহ করে।
শোবার ঘরের নিবে হাত রাখতেই ভেতরে ঝন ঝন শব্দে কাচের কী যেন ভাঙল। কী হচ্ছে? এসব কী হচ্ছে? আমি খুব সাবধানে দরজা ফাঁক কবলাম যেন প্রয়োজনে ঝাট করে দরজা বন্ধ করে দেয়া যায়।
শোবার ঘরের মেঝেতে রুবা বসে। পানির গ্রাসের ভাঙা টুকরো জড়ো করার চেষ্টা করছে। গ্রাসটা টেবিল থেকে নিচে পড়ে ভেঙেছে। আমি তার শব্দই শুনেছি। চিণ্ডাভাবনা না করেই বললাম, কী হয়েছে?
রুবা জড়ানো গলায় বলল, গ্লাস।
শোন রুবা, উঠে দাড়াও। গ্লাসের ভাঙা টুকরা জড়ো করতে হবে না। উঠে দাড়াও। দাড়াও বললাম।
সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে–পারছে না। টেনে তোলার জন্যে অসহায় ভঙ্গিতে একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। এটা কি কোনো ট্রিকস? আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা? আমি তার হাত ধরব, আর সঙ্গে সঙ্গে সে জাপ্টে ধরবে আমাকে। হরর ক্টোরিতে এরকম থাকে। মৃত মানুষ জীবিত মানুষকে মরণ আলিঙ্গনে জাপ্টে ধরে। রুবা। আবার বলল, ধর, আমাকে টেনে তোল।
আমি ধরলাম এবং টেনে তুললাম। হরর গল্পের মতো সে আমাকে মরণ আলিঙ্গনে বঁধিল না। পাড় মাতালরা যেমন হেলতে দুলতে থাকে সেও তেমনি হেলছে দুলছে। তার হাত শীতল, বরফের মতোই শীতল। তার হার্ট কি বিট করছে? এই মুহুর্তে তার বুকে হাত রেখে কিংবা নাড়ি ধরে তা বোঝা যাবে না। কারণ ধ্বক ধ্বক শব্দে আমার নিজের হোটই কাঁপছে। সেই শব্দ অন্য সব শব্দকে ঢেকে ফেলবে।
রুবা।
উঁ।
তুমি মরে গেছ। বুঝতে পারছি?
উঁ।
তুমি কীভাবে কথা বলছি, কীভাবে হাঁটাহাঁটি করছ, আমি জানি না। তোমার কেমন লাগছে বলো তো?
উঁ,
উঁ না। কথা বলো। লেট আস টক। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছি?
উঁ।
বলে আমার নাম কী? বলো, আমার নাম বলে।
মিজান।
এই তো হয়েছে। এসো এখন এই চেয়ারটায় বোস। নাও, এই চাদর দিয়ে গা ঢাক। উলঙ্গ মানুষ দেখতে ভালো লাগে না। রাস্তায় নগ্ন পাগলীদের দিকে কেউ তাকায় না। এখন আমার কথাবা জবাব দাও–তোমার এখন কেমন লাগছে?
ভায।
ভয় লাগছে?
হুঁ।
ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগার কী আছে? একজন মৃত মানুষের ভয় লাগার কিছু নেই। তয় জীবিত মানুষের। মৃত মানুষের কোনো ভয় নেই। তাদের জগৎ ভয়শূন্য। You understand?
বাতি জ্বালাও।
বাতি জ্বালাব?
হুঁ।
রুবা, ঘরে বাতি জ্বলছে। একটা টিউব লাইট জ্বলছে। টেবিল ল্যাম্পও জ্বলছে।
অন্ধকার।
তোমার কাছে অন্ধকার লাগছে?
হুঁ।
আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
ছায়া ছায়া।
শোন রুবা, আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি।
জানি।
তুমি জানো?
হুঁ।
আমার ওপর কি তোমার কোনো রাগ আছে?
না।
রাগ থাকলে বলে।
না।
তুমি কি আমাকে খুন করতে চাও?
না।
রুবা! তুমি কি প্রতিশোধ নিতে চাও?
না।
গুড ভেরি গুড। বুঝলে রুবা, একটা কোনো সমস্যা হয়ে গেছে। মৃত মানুষের কথা বলার কোনো কারণ নেই–কিন্তু তুমি কথা বলছি। কীভাবে বলছ?
আমি জানি না।
তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
এসো, শুয়ে থাক। বিছানায় শুয়ে থাক।
আচ্ছা।
আমি রুবার হাত ধরে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। গায়ে চাদর টেনে দিলাম। সে অদ্ভুত শব্দ করছে। খুন খুন শব্দ।
কী হয়েছে?
ভয় লাগে।
শোন রুবা, ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমার পাশে বসে আছি।
আচ্ছা।
দাও, তোমার হাত দাও। তোমার হাত ধরে বসে থাকব।