চা এনে ওসি সাহেবের সামনে রাখলাম। তিনি ওয়কিটকিতে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। খেজ্বরে আলাপ।
ভাই, চা নিন। ঘরে চিনি আছে কিন্তু চিনির কৌটাটা কোথায় জানি না।
চিনি নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি চায়ে চিনি খাই না।
ওসি সাহেব চাযে চুমুক দিয়ে বললেন, চা তো ভালো বানিয়েছেন। গুড়। মাঝে মাঝে আপনার বানানো চা এসে খেয়ে যেতে হবে।
জি আসবেন।
ওসি সাহেব সিগারেট ধরালেন। মনে হয় তিনি বেশ কিছু সময় এখানে কাটাবেন। শোবাব ঘরের দরজাটা কি এক ফাকে আটকে দেব? ওসি সাহেব বসেছেন শোবার ঘরের দরজার দিকে পেছন দিয়ে। কাজেই আমি যদি দরজা বন্ধ করে দেই, উনি বুঝতে পারবেন না।
আমি শোবার ঘবেব দরজাবি কাছে চলে এলাম। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা টেনে বন্ধ করলাম। এক ফাঁকে দেখলাম রুবা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে সে আমাকে দেখে হাসল। আমি ওসি সাহেবের সামনের চেয়ারে এসে বসেছি। ওসি সাহেব বললেন, কী এমন চুপচাপ কেন? বউ এক রাতের জন্য গেছে, এতেই আপনি যা মন খারাপ করেছেন–আশ্চর্য! হাসিমুখে কিছু বলুন তো শুনি।
শরীরটা ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে।
এই জ্বরের নাম হলো বিরহ, জ্বর। শুনেন ভাই, একটা উপদেশ দেই–স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসবেন না। বেশি ভালোবেসেছেন কি মরেছেন–স্ত্রীকে আর পাবেন না। সবচে ভালো হয় যদি ভালো না বেসে পারেন। আচ্ছা উঠি।
বসুন না। একা আছি, কথা বলতে ভালো লাগছে।
বসলে হবে নারে ভাই। পুলিশের চাকরিতে বসাবসি বলে কিছুই নেই। ভাবি ফিবলে একটা খবর দেবেন।
জি আচ্ছা।
আমি ওসি সাহেবকে বাসার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। তিনি যখন জিপে উঠতে যাচ্ছেন তখন এক মুহুর্তের জন্যে মনে হলো–আচ্ছা, ব্যাপারটা উনাকে খুলে বললে কেমন হয়! যদি তাকে বলি–ভাই, আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছিলাম, এখন দেখছি সে বেঁচে আছে। পানি খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে। বিশ্বাস না করলে আপনি আসুন আমার সঙ্গে, আপনাকে দেখাই।
শেষ পর্যন্ত বলা হলো না। ওসি সাহেব জিপে উঠে বললেন, ভাই চলি? বলেই জিপ স্টার্ট দিলেন। আমি বেশ কিছু সময় ঠাণ্ডার মধ্যে একা একা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরে ফিরতে ভয় লাগছে। ইচ্ছা করছে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া যাবে না। আমাকে ঘরেই ফিরতে হবে।
আচ্ছা রুবাকে কেন মারলাম? তাকে মারাটা কি খুব জরুরি ছিল?
রুবাকে মেরে ফেলার প্রথম চিন্তাটা আমার মাথায় আসে আমাদের বাসর রাতে। চিন্তাটা আসে খুব অল্পসময়ের জন্যে। ইংরেজিতে বলা যায়। It came as a flicber, আমার ধারণা সব মানুষের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে। মুহুর্তের জন্যে হলেও পাশের মানুষটাকে খুন করতে ইচ্ছা করে। এটা দোষের কিছু না; আমার মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। বাসর রাতে কী ঘটল বলি। সারাদিনের ক্লান্তিতে আমি অবসন্ন। প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে। দুপুরে কিছু খাই নি। ক্ষুধার কারণে বমি বমি লাগছে। এই অবস্থায় রুবা ঘরে ঢুকল।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি–এত সুন্দর একটা মেয়ে! আগেও তো তাকে দেখেছি–এত সুন্দর লাগে নি! অন্য কোনো মেয়ে না তো?
রুবা আমার দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে বলল, শুনুন, আমার প্রচণ্ড দাঁত ব্যথা করছে। আপনার সঙ্গে আজ রাতে কোনো কথাবার্তা বলতে পারব না। দয়া কবে কিছু মনে করবেন না। আমি চারটা পেইন কিলার খেয়েছি। আমার মাথা ঘুরছে।
আমি বললাম, ব্যথা কমেছে?
না কমে নি। ব্যথা আরো বেড়েছে। আপনি ডেনটিষ্ট হলে ভালো হতো। ফন্ট করে আমার দাঁত তুলে ফেলতেন। বলেই সে খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি অবাক হয়ে দেখছি— এত সুন্দর করে কেউ হাসে কী করে? হাসব দমকে তার মাথা থেকে শাড়ির আঁচল পড়ে গেল। তার ফর্স গলা বের হয়ে গেল। তার গলাটা কি অন্যদের গলার চেয়ে বেশি লম্বা? আমার ক্ষণিকের জন্যে ইচ্ছা করল শক্ত করে দুহাতে তার গলা চেপে ধরতে। It came as a flicber.
রুবা অবশ্যি দাঁত ব্যথা নিয়েই সে-রাতে অনেক গল্প করল। বেশিরভাগ তার বন্ধু বান্ধবের গল্প। এক একজনের গল্প উঠলে সে উদ্ধৃসিত হয়ে যায়–জানেন, ওব মতো মানুষ হয় না। অসাধারণ! অসাধারণ!
আমি এক পর্যায়ে বললাম, আমি কিন্তু অসাধারণ না রুবা। আমি সাধারণ। রুবা হাই তুলতে তুলতে বলল, তা জানি।
কীভাবে জানো?
বললে রাগ করবেন না তো?
না রাগ করব না।
রাগ করলেও আমি অবশ্যি বলে ফেলব। আমি পেটে কথা রাখতে পারি না। আপনি যে খুব সাধারণ সেটা টের পেলাম যখন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল। কারণ আমার ভাগ্য খুব খারাপ, আমি এই জীবনে যা যা চেয়েছি কোনোটাই পাই নি। আমি সবসময় চেয়েছি অসাধারণ একজন স্বামী কাজেই আমি যে সাধারণ একজন স্বামী পাব সেটা তো ধরেই নেওয়া যায়। যায় না?
হ্যাঁ যায়।
এমনিতে আমি খুব সুন্দর। যে-ই দেখবে সে-ই বলবে সুন্দর। অথচ যখন আমাকে সুন্দর দেখানো দবকার তখন আমাকে দেখায় বাদরের মতো।
কখন তোমাকে সুন্দর দেখানোর দরকার?
একবার একটা ছেলে আমাকে দলবল নিয়ে দেখতে এলো। কী সুন্দর ছেলে। হ্যান্ডসাম, টল। প্লেন চালায়, পাইলট। আমি খুব যত্ন করে সাজিলাম। সাজার পর আয়নার তাকিয়ে দেখি কী যে বিশ্ৰী দেখাচ্ছে। এত সুন্দরী মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ওরা আমাকে পছন্দ করল না।
তাহলে তো তোমার ভাগ্য আসলেই খারাপ।
আমি খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারি। যে-ই শুনবে সে-ই মুগ্ধ হবে। টেলিভিশনে কবিতা আবৃত্তির অডিসন দিতে গেলাম— বেছে বেছে সেই দিনই আমার গলায় কী যে হলো, এক সঙ্গে দুতিন রকম স্বর বের হয়। টেলিভিশনের যে প্রযোজক অডিসিন নিচ্ছিলেন, তিনি হেসে ফেললেন। অন্যরাও হাসতে লাগল। শুধু আমি নিজের মনে তিন রকমের স্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলাম। হিহিহি।