তিনি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। রাত-দিন পড়াশোনা করেন। সেই বিশেষ ঘটনার দিন গভীর রাত পর্যন্ত পড়লেন। রাত দুটাির দিকে মনে হলো, ডেডবডি ডিসেকশান তো ভালো মতো শেখা হয় নি। মর্গে ডেডবডি আছে। একা একা গিয়ে কাটাকুটি করে দেখা যেতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। নাইটগার্ডের কাছ থেকে চাবি নিয়ে মর্গে ঢুকলেন। একটা ডেডবডি টেবিলে শোয়ানো। তিনি ঢোকামাত্ৰ ডেডবডি উঠে বসল। অন্য যে-কেউ হলে ফিট হয়ে ধড়াম করে মেঝেতে পড়ে যেত। কিংবা দুর্বল হার্টের হলে হার্টফেল করে মরে যেত। বিধানচন্দ্রের বেলায় কিছুই হলো না। তিনি বুঝলেন, ভেইন থেকে দুষিত রক্ত মাথায় ঢুকে গেছে বলে হেলুসিনেশন হচ্ছে। তিনি যে ভেইন মাথায় রক্ত দেয় সেটা বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, ডেডবডি আগের জায়গাতেই আছে। তিনি কাটাকুটি শেষ কবে হাত-মুখ ধুয়ে আবার পড়তে বসলেন এবং যথারীতি পরীক্ষায় ফার্স্ট বা সেকেন্ড এ জাতীয় কিছু হয়ে সবাইকে স্তম্ভিত করলেন।
নিতান্তই অবিশ্বাস্য গল্প। বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে গল্প বানাতে হয়। এটিও বানানো হয়েছে। প্রথম কথা–ভেইন দিয়ে দূষিত রক্ত মাথায় যায় না। ভেইন থেকে দূষিত রক্ত বের হয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, মেডিকেল কলেজের মৰ্গে ডেডবডি ফেলে রাখবে, ছাত্ররা অফটাইমে কাটাকুটি করবে, তাও অসম্ভব একটা ব্যাপার। ডেডবডি এত সস্তা না। কাটাব জন্যে ব্যাঙ জোগাড় করতেও ঝামেলা হয়, আর এটা হলো মৃত মানুষ। কাজেই বোগাস। অল বোগাস।
আমার ঘরে যা ঘটছে তাও অল বোগাস। আমার মাথা উত্তেজিত। এর বেশি কিছু না। ব্ৰেইনে অক্সিজেনের অভাল হচ্ছে। লোহিত রক্তকণিকা বেশি বেশি করে অক্সিজেন মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারছে না। বারান্দায় বসে থাকলে একটা সুবিধা হবে–ফ্রেশ বাতাস পাব। ফ্রেশ বাতাস মানেই অক্সিজেন। ফুসফুস ভর্তি করে অক্সিজেন নিতে হবে।
শোবার ঘর থেকে খুটি খুঁট শব্দ হচ্ছে। মানেটা কী? ধড়াম করে আরেকটা শব্দ হলো। টেবিলল্যাম্পটা কি মাটিতে পড়ে গেল? আমার কি উচিত ভেতরে ঢুকে দেখা? না কি আমার উচিত বিশুদ্ধ বাতাসে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকা?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। শোবার ঘরে খটু খটু শব্দ বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে কেউ মেঝেতে শব্দ করছে। খটু খটু খটু খটু। আরো খানিকটা ব্ৰান্ডি গলায় ঢাললে কেমন? ওয়ান মোর পেগ। ওয়ান ফর দা রোড। না। আর না। যথেষ্ট হয়েছে–এই নুচুইসেন্স বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পনা মতো এগিয়ে যেতে হবে।
ঝন ঝন শব্দে কলিংবেল বেজে উঠল। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। কে আসবে এই সময়ে? এখন আমার করণীয় কী? শোবার ঘরের দরজা কি বন্ধ করে দেব? এটা কি অস্বাভাবিক হবে না? কে হতে পারে? আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ না তো? রিটায়ার করার পর আমার শ্বশুর সাহেবের হাতে কোনো কাজকর্ম নেই বলে যে-কোনো তুচ্ছ ব্যাপারেও তাঁকে পাঠানো হয়। মেয়ের খোঁজ নেবার জন্য তাঁকে পাঠানো হয় নি তো?
আবার ঝনঝনি শব্দে কলিং বেল।
এ পরেও দরজা না খুললে সন্দেহজনক ব্যাপার হবে। আমি দরজা খুলে ছোটখাট একটা ধাক্কা খেলাম। রমনা থানার ওসি মকবুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর গায়ে পুলিশের পুরো ইউনিফর্ম। মুখ হাসি হাসি।
মিজান সাহেবের খবর কী? আমাকে দেখে কি চমকে গেলেন না-কি? পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম–তারপর মনে হলো দেখে যাই আপনাকে। হঠাৎ করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। একটু চিন্তাও হচ্ছিল। আছেন কেমন?
জি ভালো।
ভাবি ফিরেন নি এখনো?
জি না।
করছিলেন কী?
বারান্দায় বসেছিলাম।
ওসি সাহেব ঘরে ঢুকলেন। চারদিকে তাকাতে তাকাতে বললেন, ভাবি বাসায় নেই, ভাবি থাকলে চা খেয়ে যেতাম।
আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।
না থাক, থাক। কষ্ট করতে হবে না। বাহ বাসাটা তো সুন্দর সাজিয়েছেন। চারদিক একেবারে ঝকঝকি করছে। ময়লা জুতা নিয়ে ঢুকে তো লজ্জাই লাগছে।
আমার স্ত্রীর একটু শুচিবায়ুর মতো আছে।
তাই নাকি! বলেন কী? আমার স্ত্রীরও তো শুচিবায়ু।
ওসি সাহেব তাঁর স্ত্রীর সাথে আমার স্ত্রীর মিল পেয়ে খুব আনন্দিত হলেন বলে মনে হলো। দাঁত-টাত কেলিয়ে…
চা এক কাপ পেলে মন্দ হতো না মিজান সাহেব, বানাবেন না কি?
আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। এই ব্যাটাকে চা খাওয়ানো এখন অত্যন্ত বিপদজনক। রুবা তার ঘরে নড়াচড়া করছে। একটা মৃত মানুষ নড়াচড়া করছে। বলতেও অস্বস্তি। তবে ব্যাপারটা ঘটছে। কীভাবে ঘটছে। আমি জানি না। তারচেয়েও বড় কথা, রুবা যদি ঘর থেকে বের হয়ে আসে তখন কী হবে? নগ্ন একটা মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হলো। ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসল। দৃশ্যটা কেমন হবে? ওসি সাহেব নিৰ্ঘাৎ লাফিয়ে উঠবেন। পুলিশের লোেকরা সাধারণত ভীতু প্রকৃতির হয়। নিশ্চয় তিনি কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠবেন। তখন আমাকে কী করতে হবে? আমি কী বলব? বলব–এ আমার স্ত্রী। এর নাম রুবা। একে মেরে ফেলেছিলাম। কিন্তু আবার বেঁচে উঠেছে।
ওসি সাহেব সোফায় গা এলিয়ে বসতে বসতে বললেন, বাসায় কি আপনি একা?
কী উত্তর দেব দ্রুত চিন্তা করতে হচ্ছে। আমি কি বলব, বাসায় কেউ নেই? ধরা যাক তাই বললাম, তারপর শোবার ঘর থেকে খুটি খুঁট শব্দ হলো, তখন কী হবে?
আমি ওসি সাহেবের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের পানি চাপিয়ে দিলাম। চিনি ছাড়া চা নিয়ে দেব। বলব, চিনির কোটা পাচ্ছি না। এতে লাভ হবে। এক চুমুক দিয়ে উঠে পড়তে হবে। এই ভদ্রলোককে দ্রুত ঘর থেকে বের করে দিতে হবে। তবে ওসি সাহেব। আসায় একটা সুবিধাও হয়েছে। ভদ্রলোক দেখে গেছেন। আমি বাসাতেই আছি। স্বাভাবিকভাবেই আছি।