বাব তখন খুব অসুস্থ, আমরা সবাই তাঁকে ঘিরে আছি, তখন তিনি একদিন বললেন–তোরা শুনে রাখা। কেউ পানি চাইলে তোর মা অস্থির হয়ে পড়ত—কোনো ফকির-মিসকিন বলতে পারবে না। সে পানি চেয়েছে, তোদের মা শুধু পানি তাকে দিয়েছে। পানি দিয়েছে, পানির সঙ্গে কিছু খেতে দিয়েছে। সে মরাল কীভাবে? পানির তৃষ্ণায়।
কোনো মেয়ে ছেঁড়া শাড়ি পরে এসেছে। এমন শাড়ি যে শরীর ঢাকতে পারছে না।–তোদের মা তৎক্ষণাৎ তাকে শাড়ি দিয়েছে। কত রাগোরাগিও এই নিয়ে তোদের মার সঙ্গে করেছি। সে কী বলত? বলত, আহা, শরীর ঢাকতে পারছে না–লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে–কী লাজ! সে মরাল কীভাবে লজ্জার মধ্যে। সে যখন মরল নগ্ন অবস্থায় মরল। হেন লোক নেই যে তাকে নগ্ন দেখে নি।
পশু-পাখির জন্যে তার মমতার শেষ ছিল না। একটা কাক এসে রেলিং-এ বসলে সে কী করত? ভাত ছিটিয়ে দিত। বলত, আহা বেচারা, খিদে পেটে এসেছে। কুকুরবেড়াল যেটাই এসেছে, টিনের থালায়.খাবার দিয়েছে। সে মরাল কীভাবে? কুকুরের হাতে।… ..কেন? বল কেন? চুপ করে থাকবি না। বল।
চুক চুক শব্দ হচ্ছে
চুক চুক শব্দ হচ্ছে।
তাকিয়ে দেখি, হামাগুড়ি দিয়ে রুবা চেয়ারের কাছে পৌঁছে গেছে। গ্রাসের পানি খাচ্ছে। মানুষের মতো না, কুকুরে মতো। জিব পানিতে ড়ুবিয়ে টেনে টেনে নিচ্ছে। কুচকুচে কালো একটা জিব। অনেকখানি লম্বা। হচ্ছেটা কী? তার গায়ে কাপড়ও নেই। সে কাপড় খুলল কখন?
আমি তাকিয়েই আছি। রুবা পানি খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গরম! १ट्रহা!
আমি ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এলাম বারান্দায়। আমারও গরম লাগছে। বারান্দায় খানিকক্ষণ বসাযাক। Something is wrong, Something is very wrong.
ঘরের ভেতরের তুলনায় বাইরে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। উত্তরের বারান্দা, ঠাণ্ডা হবেই। হিমালয় থেকে ঠাণ্ডা বাতাস মনে হয় ছাড়তে শুরু করেছে। বারান্দায় দুটা প্লাষ্টিকের ফোন্ডিং চেয়ার। রুবা গুলশান এক নম্বর মার্কেট থেকে কিনে এনেছিল। হলুদ ফ্রেমের ভেতব সবুজ প্লাস্টিকের ফিতার বুনোনের চেয়ার। সুন্দর। চেয়ার দুটা কেনার পর সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মানানসই টেবিলের জন্য। কোনো টেবিলই তার পছন্দ হয় না। সুন্দর চেয়ার দুটির সঙ্গে নাকি কোনো টেবিলই মিশ খায় না। শেষটায় সে খবর দিয়ে আনল। তার এক মামাতো ভাই মাজহারকে। আর্ট কলেজের ছাত্র। সে নাকি ডিজাইন করবে। এই ডিজাইন মতো টেবিল হবে। মাজহারের কোনো ডিজাইনই রুবার পছন্দ হয় না। যেটা পছন্দ হলো সেই টেবিলই এই মুহুর্তে আমার সামনে। বদখত একটা জিনিস। আমি অবশ্যি রুবাকে বলেছি–ভালো। তেমন উচ্ছ্বাস দেখাই নি। উচ্ছ্বাস আমি কখনো দেখাই না।
বারান্দাটা রুবা আমাদের দুজনের জন্যে সাজিয়েছে। বারান্দায় আমরা বসব। চা খাব। অন্য কেউ এখানে আসতে পারবে না। এ বাড়ির এই অংশটিতে কারোরই প্রবেশাধিকার থাকবে না। এখানে আসতেও হবে খালি পায়ে।
এখন অবশ্যি আমি খালি পায়েই আছি। পায়ে ঠাণ্ডা লাগছে। টেবিলের উপর পা তুলে দিলাম। এখন মজা হয়। রুবা যদি ট্রেতে করে দুইেকাপ চা নিয়ে এসে উপস্থিত হয় এবং বলে–নাও, চা নাও। কীভাবে বসেছ? পা নামিয়ে ভদ্র হয়ে বোস।
এখানে যে কাণ্ডকারখানা ঘটছে তা কি কাউকে বলা যায়? বললে কি কেউ বিশ্বাস করবে? আমি যদি আমাদের অফিসের নুরুজ্জামান সাহেবকে ঘটনাটা বলি তিনি কী ভাববেন? বা আমি যদি এখনই উনাকে টেলিফোন করে বলি যে কিছুক্ষণ আগে আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি, তাহলে উনি কী মনে করবেন? তার মুখের ভাব কীভাবে বদলাবে? চিন্তা করেই হাসি পাচ্ছে। খানিকক্ষণ হাসলাম। নিজের মনেই হাসলাম। মনে মনে নুরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছি। উনার মুখের ভাব বদলাচ্ছেকল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, আর আমার হাসি পাচ্ছে। ব্ৰান্ডির প্রভাব। ব্ৰান্ডিটা বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। এতটা খাওয়া ঠিক হয় নি।
হ্যালো নুরুজ্জামান সাহেব?
জি। জি। (নুরুজ্জামান সাহেব বেশিরভাগ কথাই দুবার করে বলেন।)
আমাকে চিনতে পারছেন?
কেন চিনিব না? কেন চিনিব না? আপনি জামান। জামান। ব্যাপার কী, এত রাতে! খবর ভালো?
জি, খবর ভালো। তবে কিছুক্ষণ আগে খুন করেছি।
কী করেছেন?
খুন! মার্ডার।
নুরুজ্জামান সাহেব ফোঁস ফোঁস জাতীয় শব্দ করছেন।
বুঝলেন নুরুজ্জামান সাহেব, ও ঘুমাচ্ছিল। মুখের উপর বালিশ চেপে ধরেছি। দশ মিনিটেই রেজাল্ট আউট।
হুঁ।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হচ্ছে, মরার পরে সে আবার বেঁচে উঠেছে। ঘুর ঘুর করছে। পানি খাচ্ছে।
ও পানি খাচ্ছে। পানি খাচ্ছে।
মানুষের মতো খাচ্ছে না। কুকুরের মতো খাচ্ছে। জিব পানিতে ভিজিয়ে চোটে চেটে নিচ্ছে। আসুন না, দেখে যাবেন।
জি না। জি না।
দেখলে মজা পাবেন রে ভাই–ওর গায়ে কোনো কাপড় নেই–দিগম্বর। অন্যের স্ত্রীকে নেংটো দেখার সৌভাগ্য তো সবার হয় না। তাছাড়া রুবা অসম্ভব রূপবতী।
আমি হো হো করে হাসছি। এরকম একটা টেলিফোন কাউকে করতে পারলে হতো। তবে শুরুতে সবাই আমার কথা মন দিয়ে শুনলেও শেষটায়। তারাও হেসে ফেলত। মৃত মানুষ হেঁটে বেড়ায় না। পানি খায় না। অতীতে কখনো খায় নি। বর্তমানেও খাচ্ছে না। ভবিষ্যতেও খাবে না। আমার মাথায় কিছু হয়েছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে বা এই জাতীয় কিছু। এরকম এক গল্পও তো কোনো এক বিখ্যাত ডাক্তারকে নিয়ে প্ৰচলিত আছে। ডাক্তারটার নাম কি বিধানচন্দ্ৰ না?