শোবার ঘর থেকে আবার শব্দ হলো–পানি, পানি।
আমি গ্লাস ভর্তি করে পানি নিলাম। রুবার নিজের গ্রাসেই নিলাম। সে অন্যের গ্লাসের পানি খেতে পারে না। এখন সে বেঁচে নেই। সে সে… কী বলতে চাচ্ছি। বুঝতে পারছি না। মৃত মানুষের জন্যে পানি নিয়ে যাচ্ছি, এটা কি দ্বিতীয় ভুল না? আচ্ছা, আমি একজন মৃত মানুষের জন্যে পানি নিয়ে যাচ্ছি কেন?
পানির গ্লাস রুবার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে হাত বাড়িয়েছে কিন্তু গ্লাস ধরতে পারছে না। তার আঙ্গুল কাঁপছে। আমি বিছানার পাশে সাইড টেবিলে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম। সে পারলে টেবিল থেকে গ্রাস নেবে। না পারলে নেবে না। আমার পানি দেবার কথা, আমি দিয়েছি। বাকিটা তার ব্যাপার।
রুবা এগুচ্ছে। হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে। তাকে দেখাচ্ছে কুকুরের মতো। জলাতঙ্ক রোগি শেষের দিকে কুকুরের মতো হয়ে যায়। কুকুরের মতো ঘড়ঘড় শব্দ করে, মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে এবং জিহবা বের করে দেয়। এটা আমার কথা না; ইদ্রিস বলে আমাদের যে কাজের ছেলে ছিল তার কথা।
মার যখন জলাতঙ্ক ধরা পড়ল তখন সে চুপি চুপি আমাকে বলল। আমার তখন সাত বৎসর বয়স। ইদ্রিস আমার শিক্ষাগুরু। কত কিছু আমাকে সে শেখায়। তার প্রতিটি শব্দ আমি বিশ্বাস করি।
বুঝছেন ছোট মিয়া, কুত্তায্য কামড়াইলে পেডে কুত্তার বাচ্চা হয়। মেয়েছেলের পেডেও হয়। পুরুষ ছেলের পেডেও হয়। আব্ব মানুষটা আস্তে আস্তে কুত্তার লাহান হয়। তার শইল্যে লোম উইঠা যায়–ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। এক আচানক দৃশ্য ছোট মিয়া.।
তুমি দেখেছ?
কত দেখলাম। অখন তুমিও দেখবা।
স্টোর রুমের আশেপাশে আমাদের যাওয়া নিষেধ ছিল। তারপরেও মাঝে মাঝে উঁকি দিতাম মা কতটা কুকুর হয়েছেন দেখার জন্যে। মা আমাকে চিনতে পারতেন না। কাউকেই পারতেন না। শুধু আমার বড়বোনকে চিনতেন। বড়বোনকে দেখলেই বলতেন–মিনা, বাতাস বাতাস।
কেন বলতেন। আমরা জনতাম না। বোধহয় তার গরম লাগত। স্টোর ঘরটা ছিল ছোট। একটাই জানালা। মা শেষদিকে টেনে টেনে তাঁর গায়ের সব কাপড় ছিঁড়ে ফেললেন। পুরো নগ্ন হয়ে মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলেন। যা পেতেন, কামড়ে ধরতেন। একদিন দেখি, পুরনো জুতা চিবুচ্ছেন। ইদ্রিস বলল, ছোটমিয়া দেখছেনক্যামনে কুত্তা হইতাছে? খিক্ খিকখিক।
ব্যাপারটা তার কাছে খুব মজার মনে হচ্ছিল। সে বলতে গেলে সারাক্ষণই স্টোররুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। বাবা একদিন তাকে মারলেন। ভয়ঙ্কর মার। ইদ্রিসের ঠোঁট কেটে গেল। দাঁত ভেঙে গেল। রক্তে তার গেঞ্জি মাখামাখি। সে নাকি স্টোর রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে খিকখিক করে হাসছিল। বাবা হুঁঙ্কার দিলেন। হারামজাদা, তোকে আমি খুন করে ফেলব। হুঁঙ্কার এবং চড় থাপ্পড়, কিল ঘুসি। বাবারও বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মার মৃত্যুর কাছাকাছি সময় তিনি যা করে সবই পাগলের কাজ। সুস্থ মানুষের কাজ না। সুস্থ মানুষ এইসব করে না। যেমনমঙ্গলবার শেষরাতে বাবা বিছানা থেকে আমাদের টেনে নামালেন। চাপা হুঁঙ্কার–অজু বুদ্ধ কর। আমরা চার ভাইবোন অজু করলাম। আর আমার সাথে—তোর মাকে দেখবি।
আমরা স্টোর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। স্টোর রুম অন্ধকার। বাবা মার ওপর টর্চের আলো ফেললেন। কী কুৎসিত দৃশ্য! যেন একটা পশু চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে–ধো ঘো শব্দ হচ্ছে। বাবা বললেন, দেখলি?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, হুঁ।
এখন আয় আমার সাথে।
আমরা বাবার শোবার ঘরে ঢুকলাম। সেখানে বিছানায় পাটি পাতা। বাবা বললেন, পাটিতে বসে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বল, হে আল্লাহপাক, আমার মার সব কন্টের অবসান কর। আমার মার মৃত্যু দাও। স্বামীর কথা আল্লাহ শুনবে না। স্বামীরা প্রায়ই স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে। ছেলেমেয়ের কথা শুনবে। তোয়া করে।
আমরা দোয়া করলাম।
বাবা পাথরের মতো মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দোয়া শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, আমাদের কাজের মেয়ে রহিমাবু এসে বললআম্মাজান নড়াচড়া করতেছে না, মনে হয়। উনার মৃত্যু হইছে।
আমা তোয়া করেছি বলে মার মৃত্যু হয়েছে এটা আমি মনে করি না। আমি আমার অন্য ভাই বানদের কথা জানি না। কিন্তু আমি নিজে মার মৃত্যুর কথা আল্লাহকে বলি নি। আমি হাত তুলে চুপচাপ বসেছিলাম। ভাইবোনদের তোয়ার কারণে মার মৃত্যু হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমার ধারণা, দোয়া না করলেও মঙ্গলবার ভোরবেলা তাঁর মৃত্যু হতো।
মার মৃত্যুর পর বাবা চাকরি ছেড়ে দিলেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি স্টোর রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতেন। খাওয়া-দাওয়ার খুব অনিয়ম করতেন। হয়তো টেবিলে খাওয়া দেয়া হয়েছে, তাকে খেতে ডাকা হলো, তিনি বললেন, না।
আমার মনে হয় তার মাথার গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। একদিন হঠাৎ বললেন, তিনি আর পানি খাবেন না।–আমার স্ত্রী পানির জন্যে ছটফট করেছে, পানি পায় নাই। जांभि९3 नेि शान्त না।
তামে পানি অবশ্যি খাওয়ানো হয়। আমার ছোটখালা কাঁদতে কাঁদতে যখন বলেন, পানি খান দুলাভাই। আপনি মারা গেলে বাচ্চাদের কে দেখবে? বাবা পানি খান। তাঁর মাথা কিন্তু সারে না। কথাবার্তা বন্ধ করে দেন।
তাঁর একটাই কথা–একটা মানুষ যে কোনোদিন কোনো অন্যায় করে নাই, কোনো পাপ করে নাই, মানুষের দুঃখ দেখলে যে অস্থির হয়ে যেত— তার কেন এই কষ্ট?