- বইয়ের নামঃ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
কাজটা যত জটিল হবে ভেবেছিলাম
কাজটা যত জটিল হবে ভেবেছিলাম ততটা জটিল হলো না।
কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই কাজ শেষ হলো। ঘড়িতে এখন বাজছে আটটা কুড়ি মিনিট। শুরু করেছিলাম আটটা পাচে। পনেরো মিনিট সময় লাগল। জলজ্যান্ত একটা মানুষ পনেরো মিনিটে মেরে ফেলা সহজ ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়। কঠিন ব্যাপার। তবে রুবা নিজেই ব্যাপারটা আমার জন্যে সহজ করে দিয়েছে।
আজ আমাদের একটা বিয়ের দাওয়াতে যাবার কথা ছিল। রুবার সাজগোজ শুরু হলো বিকেল থেকে। শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পছন্দ হয় না, আবার বদলায়। আমাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কেমন দেখাচ্ছে। আমি প্রতিবারই বললাম–খুব সুন্দর লাগছে। আসলেই সুন্দর লাগছিল। শেষ পর্যন্ত বেগুনি রং একটা শাড়ি তার পছন্দ গুলো। সেই শাড়ি পরার পর দেখা গেল, চায়ের দাগের মতো কী একটা দাগ লেগে আছে। কিছুতেই সেই দাগ আড়াল করা যাচ্ছে না। সে ঠিক করল বিয়েতে যাবে না। রুবাব মাথা ধরল। তখন। শাড়িতে দাগ পাওয়া না গেলে মাথা ধরত না। আমাদের বিয়েবাড়িতে যাওয়া বাতিল হতো না। আমার কাজটা পিছিয়ে যেত।
রুবা মুখ শুকনো করে বসে বইল বাবান্দায়।
আমি বললাম, দুটা সিডাকসিন খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। মাথাধরা সেরে যাবে। দুটা সিডাকসিন একটা প্যারাসিটামল। সে বাধ্য মেয়ের মতো তাই করল। ঘরে প্যারাসিটামল ছিল না। আমিই ডিসপেনসারি থেকে এনেছিলাম। সে ওষুধ খেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি বললাম, মাথা টিপে দেব? সে বলল, দাও। আমি বসলাম তার মাথাব পাশে। সে ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে দেখতে। এখন আমার কাজ হচ্ছে বালিশটা মুখেব উপর চেপে ধরা। এই কাজটা পায়ের দিকে বসে কখনো করতে নেই। সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ, জীবন বাঁচানোর জন্যে শেষ মুহুর্তে প্ৰচণ্ড লাথি বসাবে। কাজেই বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরার আগে বসার জায়গাটা ঠিক করে রাখতে হবে। সবচে ভালো হয় কাজটা যদি দাঁড়িয়ে করা যায়। দাঁড়িয়ে থেকে যতটা চাপ মুখের উপর দেয়া যাবে বসে থেকে ততটা দেয়া যাবে না। তারপরেও সম্ভাবনা থাকে যে, ভিকটিমা হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে মুক্ত করে নেবে। একবার যদি কোনোক্রমে নিঃশ্বাস নিয়ে ফেলতে পারে তাহলেই সর্বনাশ। বুদ্ধিমানরা সেদিকটা খেয়াল রেখে অন্য ব্যবস্থাও হাতেব কাছে রাখেন, যাকে বলে ব্যাক আপ সিস্টেম। আমিও বেখেছিলাম। তার প্রয়োজন পড়ে নি। ঐ তো রুবা আড়াআড়িভাবে বিছানায় পড়ে আছে। চোখ খোলা, যে কেউ দেখলে ভাবাবে শুয়ে আছে। আজ তার পা এত বেশি ফর্সা লাগছে কেন? টিউব লাইটের জন্যে? নাকি মৃত্যুর পর পর মানুষ ফর্সা হতে শুরু করে? এ ব্যাপারটা আমার জানা নেই। তবে মৃত্যুর পর পর রিগোরাস মার্টিস বলে একটা ব্যাপার হয়, শরীরের মাংসপেশি শক্ত হতে শুরু করে। সেটাও এত চট করে হবে না। সময় লাগবে।
আমি উঠে গিয়ে ওর শাড়ি ঠিক করে দিলাম। মাথার নিচে বালিশ দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলাম। একটা হাত কোলবালিশের উপর দিয়ে দিলাম। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে ভাববে, ঘুমুচ্ছে। তবে তার শোয়াটা ঠিক হয় নি। সরোজিনি শুয়ে আছে জানি না সে শুয়ে আছে কিনা। কার কবিতা যেন এটা? যারই হোক, এখন কবিতার সময় নয়। কবিতা আজকে তোমায় দিলাম ছুটি। এটা কার, সুকান্তের?
আমি বিছানায় বসলাম। মাথা খানিকটা এলোমেলো লাগছে। এলোমেলো লাগছে। বলেই কবিতার লাইন মনে আসছে। একটু বোধহয় রেস্ট দরকার। কাবার্ডে ব্ৰান্ডির একটা বোতল আছে। আমার না, রুবার। তার শরীর খুব খারাপ করল, তখন ডাক্তার তাকে খেতে দিল। তারপর কার কাছে যেন শুনল ব্ৰান্ডি হচ্ছে কড়া ধরনের মদ–ব্যস, খাওয়া বন্ধ। বোতলের পুরোটাই আছে, খানিকটা গলায় ঢেলে দিলে এলোমেলো ভাব কাটবে। আমি কাবার্ডের দিকে যেতে গিয়েও গেলাম না। এলকোহল যা করবে তা হলো সাময়িক কিছু শক্তি। তারপরই আসবে অবসাদ। I can not take any chance… কোনো চান্স নেয়া যাবে না। এখনো প্রচুর কাজ বাকি আছে।
একটা মানুষ মারা তেমন কোনো জটিল ব্যাপার না। ডেডবডি গতি করাই হচ্ছে সবচে জটিল কাজ। তবে সব ব্যবস্থা করা আছে। আমি হুঁট কবে কিছু করি না, যা করি ভেবে-চিন্তে করি। রুবাকে কী কবে মারব তা নিয়ে আমি খুব কম হলেও এক মাস ভেবেছি। তার ডেডবডি কী করে সরাব তা নিয়ে ভেবেছি প্ৰায় এক বছর। অধিকাংশ খুনী ধরা পড়ে ডেডবডি সরাতে গিয়ে। খুনের পরে পরেই এক ধরনের ল্যাথার্জি এসে যায়। নাৰ্ভ ফেল করে। তখন খুব তাড়াহুড়া করতে ইচ্ছা করে। স্বামী হয়তো স্ত্রীকে গল। টিপে মারল–মানুষের কাছে প্ৰমাণ করতে চায়, ফাস নিয়ে মরেছে। ডেডবডি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল, কিন্তু দড়ির গিটটা দিল ঘাড়ের দিকে। সে ভুলে গেছে একজন মানুষ ফাস নেবাব সময় দড়ির গিট ঘাড়ের কাছে দেবে না। হাত পেছন দিকে নিয়ে গিট দেয়া খুব মুশকিল। সত্যিকার ফাঁসির আসামির গিট থাকবে সামনের দিকে।
অনেকে আবার খুন করার পর ডেডবডির মুখে খানিকটা বিষ ঢেলে দেয়। হাতের কাছে যা পায় তাই। ইদুর-মারা বিষ র্যাটম, তেলাপোকা মারাব বিষ রোঢ়কিলার। এরা একটা জিনিস জানে না যে সুরতহালের সময় মুখে কী বিষ আছে তা দেখা হয় না। ভিসেরার বিষ পরীক্ষা করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো করে শেষে ফেসে যায়। যাকে বলে তীরে এসে তরী ড়ুবা। আমার সেই ভয় নেই। আমি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত মেথডিকাল। একাউন্টেন্টরা সাধারণত মেথডিকাল হয়ে থাকে।