ভাই বসুন।
ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, শাজারাতি মুমবারাকাতিন যাইতুনাতিন।
আমি বললাম, এর অর্থ কী?
মুনশি বললেন, এটা সূরা আননুনের একটা আয়াত। এর অর্থ পূতপবিত্র জয়তুন বৃক্ষ। আপনি আমার আতরের গন্ধে চমকেছেন। এই আতরটা জয়তুনের তেল থেকে তৈরি।
আমি চমকেছি কীভাবে বুঝলেন?
আপনার চোখের তারা চমকায়েছে। তার থেকে বুঝেছি।
আতরের গন্ধেই যে চমকেছি তা তো নাও হতে পারে।
আপনার চোখের তারা যখন চমকায়েছে তখন নাকের চামড়াও কুঁচকেছেন, সেই থেকে বুঝেছি।
আমি বললাম, আপনার পর্যবেক্ষণশক্তি ভালো। আমি বেশ অবাক হয়েছি। আপনার আতর খানিকটা কি আমাকে দিতে পারবেন? আমি আমার স্ত্রীকে দিতাম। অদ্ভুত আতরের গন্ধে সে খুশি হবে। সুগন্ধির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে।
মুনশি কিছু বললেন না। হাসলেন। ভদ্রলোকের হাসি সুন্দর।
আমি বললাম, শুনেছি আপনি খুব ভালো ম্যাজিক দেখান। আপনার কাছে নাকি জুয়েল আইচ শিশু। জুয়েল আইচকে চিনেছেন তো?
জি জনাব। বাংলাদেশে বাস করব উনাকে চিনব না, তা হয় না।
তাঁর কোনো জাদু কি দেখেছেন?
জি-মা। হাওর অঞ্চলে থাকি, কীভাবে দেখব?
আমি বললাম, মসজিদের একজন ইমাম জাদু দেখান এই প্রথম শুনলাম।
মুনশি জবাব দিলেন না। মনে হচ্ছে তিনি কম কথা বলেন। ভদ্রলোকের ভাষা শুদ্ধ, কিছুটা পোশাকি। বাড়ি মনে হয় সিলেট অঞ্চলে না। তবে কিছুদিন সিলেটে থাকলে ভাষায় সিলেটি ঢুকে যাওয়ার কথা। সিলেটি ভাষার আগ্রাসী রূপ আছে। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত কাহিনী বলি—
নিউইয়র্ক বইমেলায় গিয়েছি। আমি এবং শাওন গানের একটা অনুষ্ঠান দেখব। বইমেলার আয়োজক বিশ্বজিৎ সাহার জনৈক কর্মচারীর হাতে দুঘণ্টার জন্যে পুত্র নিষাদকে ছেড়ে দিয়েছি। নিষাদের বয়স তিন। বিশ্বজিতের কর্মচারীর নাম শাহীন, বাড়ি সিলেট।
দুঘণ্টা পর ফিরে আসতেই নিষাদ বলল, বাবা, আইসক্রিম খাইমু।
এই দুঘণ্টাতেই তার ভাষায় সিলেটি ঢুকে পড়েছে।
আমি ম্যাজিক মুনশির দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি কি চা খাবেন?
মুনশি বললেন, চা খাব না। চা খেলে অজু ভেঙে যাবে। এশার নামাজ শেষ করে চা খাব।
আপনার পড়াশোনা কতদূর?
খুবই সামান্য। উলা পাশ করেছি। মৌলানায়ে মুহাদ্দেস হওয়ার ইচ্ছা ছিল। দরিদ্র ঘরের সন্তান। অর্থের অভাবে পড়তে পারি নাই। কোরানে হাফেজ হওয়ার শখ ছিল। মেধার অভাবে পারি নাই।
মাঝখান থেকে ম্যাজিক শিখে ফেলেছেন?
ম্যাজিক মুনশি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছু বললেন না।
আমি বললাম, এখন কি আমি আপনার ম্যাজিক দেখব?
আপনি চাইলে অবশ্যই দেখবেন।
আমি ম্যাজিক দেখার প্রস্তুতি নিলাম।
অদ্ভুত কিছু দেখবু তা ভাবলাম না। গ্রামের মুনশি মানুষ শুত ম্যাজিক জানবেন কীভাবে? দড়ি কেটে জোড়া লাগানো, কিংবা পয়সার কোনো খেলা।
তবে ম্যাজিশিয়ান না এমন অনেকের কাছ থেকে আমি বিস্ময়কর কিছু ম্যাজিক দেখেছি। অভিনেতা রহমত (বিভাগীয় প্রধান, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এমন একজন।
নাটকের শুটিং শেষে রহমতকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ সে বলল, স্যার একটা কয়েন দিন।
আমি কয়েন দিলাম। রহমত বলল, স্যার দেখুন কয়েনটা ঘসতে ঘসতে কীভাবে ভ্যানিশ করি। বলেই সে কয়েনটা বাঁ হাতের কনুইতে ঘসতে শুরু করল। চোখের সামনে কয়েন অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আমার এক শিক্ষক ড. তৌফিকুর রহমান অপূর্ব সব তাশের ম্যাজিক জানেন।
একবার নুহাশপল্লীতে রাত্রি যাপন করতে এসে আমাদের এক ঘণ্টা তাশের ম্যাজিক দেখিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন।
পামিং-এর অদ্ভুত এক কৌশল আমি দেখেছিলাম একজন মাঝির কাছে। সে নিজের মনে সিগারেট টানছিল। আমাকে দেখে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে লুকিয়ে ফেলল। তার দুটা হাতই আমার সামনে মেলে ধরা। হাতে সিগারেট নেই। অথচ আঙুলের ফাঁক দিয়ে ধােয়া আসছে।
সিগারেট পামিং-এর কৌশল আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। তবে তার মতো ভালো পারি না।
ম্যাজিক মুনশি কী করবে কে জানে!
ম্যাজিকের জন্যে কেবিনঘর খুব উপযুক্ত
ম্যাজিকের জন্যে কেবিনঘর খুব উপযুক্ত। আলো কম। দুটি মোমবাতি, একটি হারিকেন। বাতাস আটকানোর জন্যে কেবিনের জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দর্শক আমি একা। সর্পরাজ ভেতরে আসতে চাচ্ছিল। আমি দেই নি। ম্যাজিক মুনশির গায়ের অদ্ভুত চা-পাতা গন্ধওয়ালা আতরের স্নিগ্ধ গন্ধ নষ্ট হোক তা চাই নি। সর্পরাজ ঢুকবে জর্দার কড়া গন্ধ নিয়ে। তার এই স্পেশাল জর্দা নাকি ইন্ডিয়া থেকে আসে। জর্দার নাম গোপাল জর্দা।
আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললাম, ভাই দেখন একটা ম্যাজিক।
স্যার, আপনার সিগারেটটা টেবিলে শুইয়ে রাখুন।
আমি তাই করলাম। সিগারেট গড়াতে গড়াতে আমার দিকে আসতে শুরু করল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি সিগারেট ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছে। ম্যাজিক মুনশি শীতল চোখে তাকিয়ে আছে সিগারেটের দিকে।
চমকে ওঠার মতো কোনো ম্যাজিক না। এর কৌশল অত্যন্ত সহজ। সিগারেটে মুখ দিয়ে ফুঁ দিতে হয়। ফুটা এমনভাবে দিতে হয় যেন দর্শক দেখতে না পারে। নিচের ঠোঁট খানিকটা ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে ফুঁ দেওয়া নিয়ম। এইসময় মাথা খানিকটা ঝুঁকে থাকবে যেন দর্শক স্পষ্টভাবে ঠোঁট দেখতে পারেন। একই পদ্ধতিতে বই হাতে নিয়ে ফুঁ দিলে আপনাআপনি বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। যারা ম্যাজিকের ভেতরের কৌশল জানেন না তারা ঘটনা দেখে চমৎকৃত হন। সমস্যা হচ্ছে আমি কৌশলটা জানি।