শিশুদের সঙ্গে এখন কিছু বয়স্ক ব্যক্তিও যুক্ত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্যে সর্পরাজ এগিয়ে গেল।
সর্পরাজ : মুনশি সাব আছুইন নি?
সমবেত উত্তর : অয় অয়। (অর্থাৎ হ্যাঁ হ্যাঁ।)
সর্পরাজ : মুনশি সাবরে খবর দেউক্কা। লিখক হমায়ূন সাব লঞ্চে আইছুইন। মুনশি সাবের লগে উনার খুবই আলাপের খায়েশ।
শিশুর দলের একজন : লইয়া আইরাম। (অর্থাৎ নিয়ে আসছি)
এই শিশু ছুটে যাচ্ছে। তার পেছনে কম করে হলেও আরও কুড়িজন যাচ্ছে। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। সর্পরাজকে স্পষ্ট জানিয়েছি, আমি কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাচ্ছি না। নিতান্ত পরিচিত বলয়ের বাইরে আমি মুখ খুলতে পারি না। আশপাশে কয়েকজন অপরিচিত মানুষ থাকলেই আমার মনে হয় আমি কোনো সেমিনারে এসেছি। সেমিনারে প্রধান বক্তা আমি। কোন বিষয়ে সেমিনার এখনো জানি না। বক্তৃতায় কী বলব তাও জানি না
সর্পরাজ আমার সামনে বসতে বসতে বলল, মুনশিরে খবর দিছি। চইলা আসবে।
মুনশি সাবকে খবর দিতে আমি বলি নি।
সর্পরাজ বলল, উনারে যদি আপনার পছন্দ না হয় আমার দুইগালে দুইটা চড় দিবেন।
উনি করেন কী?
মসজিদের ইমাম। মিজিক দেখায়।
কী দেখায়?
মিজিক। জুয়েল আইচ উনার কাছে দুধের শিশু।
মসজিদের ইমাম ম্যাজিক দেখান?
জি অয়।
আমি খানিকটা অবাক হলাম। মসজিদের ইমাম ম্যাজিশিয়ান? প্রায় দেড় শ বছর আগে নেত্রকোনায় মসজিদের জুনৈক ইমাম গান লিখতেন। গানে সুর দিয়ে গাইতেন। তাঁর নাম উকিল। মসজিদে ইমামতি করতেন বলে নামের শেষে মুনশি যুক্ত হয়েছে। তিনি পরিচিত হয়েছিলেন উকিল মুনশি হিসেবে।
উকিল মুনশির একটি গান—শোয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি? আমি শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে ব্যবহার করেছিলাম। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জ্ঞানী বিচারকরা শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার উকিল মুনশিকে দিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, উকিল মুনশির ঠিকানা কী? তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
আমি বললাম, কবর খুঁড়লেই পাওয়া যাওয়ার কথা। দেড়শ বছর পার হয়েছে এটা একটা সমস্যা।
কোনো ছবির মৌলিক গানের জন্যে গীতিকারকে পুরস্কার দেওয়ার বিধান আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাছন রাজার গান ব্যবহার করলে তাদের শ্রেষ্ঠ গীতিকার পুরস্কার দেওয়া যায় না। উকিল মুনশি যে সেই দলেরই পুরস্কার কমিটি তা জানতেন না। বাংলাদেশের যে-কোনো কমিটিতে বেশিরভাগ সদস্য মূর্খ থাকবেন এটা নিপাতনে সিদ্ধ।
গায়ক উকিল মুনশির পর আরেকজন পাওয়া গেল ম্যাজিক মুনশি। খারাপ কী!
সর্পরাজ বলল, স্যার কি আমার উপর নারাজ হয়েছেন? মিজিক মুনশি খবর দিলাম এই কারণে।
কিছুটা নারাজ হয়েছি। আমার একা থাকতে ভালো লাগছিল।
আপনি তো মিজিক ভালো পান।।
তা অবশ্য পাই।। তাহলে উনার মিজিক দেখলে আপনার দিলখোশ হবে।
আমি দিলখোশ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছি। মুনশি সাহেব আসছেন না। সন্ধ্যা পুরোপুরি মিলিয়েছে। আকাশে আলোর আভা নেই। শত শত জোনাকি পোকা বের হয়েছে। অনেকদিন পর একসঙ্গে এত জোনাকি পোকা দেখলাম।
এক যাত্রায় অনেক অভিজ্ঞতা। শাওন সঙ্গে থাকলে বলতাম, জোনাকি ঝিকিমিকি গানটা করো তো। সঙ্গে সঙ্গে সে গান ধরত কি না জানি না। বিয়ের আগে তাকে গান গাইতে বললে এক সেকেন্ডের মাথায় গান ধরত। বিয়ের পর সাধ্যসাধনা করতে হয়।
পুত্র নিষাদকে খুব মিস করছি। একসঙ্গে এত জোনাকি পোকা দেখে সে কী কত কে জানে। নুহাশপল্লীতে মাঝে মাঝে কিছু জোনাকি পোকা দেখা যায়। নিষাদ তাদের ধরার জন্য পেছনে পেছনে ছছাটে। তার কী আনন্দ!
শিশুর দল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত বাড়িতে তাঁদের করার কিছু নেই। বাবা-মারাও চান না তারা ঘরে ফিরুক।
আমি সর্পরাজকে বললাম, তোমার ম্যাজিক মুনশি সাহেব সম্ভবত আসবেন। আমি আমার কেবিনে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ একা থাকব।
লেখালেখি করবেন?
কাগজে-কলমে করব না, মনে মনে করব।
মনে মনে কীভাবে লিখবেন?
আমি বললাম, লেখকরা মনে মনে যত লেখা লিখেন তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ লিখেন কাগজে কলমে।
সর্পরাজ পান মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, অয় অয়। তার অয় অয় ধ্বনির পরপরই সোনালি মেয়েটি প্রায় দৌড়ে উপস্থিত হয়ে প্রথমে আমাকে তারপর সর্পরাজকে কদমবুসি করল। সর্পরাজ এই ঘটনায় কোনো অস্বাভাবিকত্ব খুঁজে পেল না। তরুণী মেয়েরা ছুটে এসে তাকে কদমবুসি করবে এটাই যেন স্বাভাবিক। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে পান চিবুতে লাগল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ব্যাপার কী?
সোনালি বলল, আপনি আমাকে সিনেমায় রোল দিবেন এটা শোনার পর থেকে মাথা আউলা হয়ে গেছে।
ঝোল দেব তোমাকে কে বলেছে?
ম্যানেজার স্যার বলেছেন।
সামনের চেয়ারটায় বসো।
মেয়েটি বসল। আমি বললাম, পড়াশোনা কতদূর করেছ?
ইন্টার পর্যন্ত পড়েছি। পরীক্ষা দিতে পারি নাই। পরীক্ষার আগের দিন ডিরেক্টর সবুজ ভাই বললেন, ব্যাংককে ধারাবাহিক নাটক করব, ভগ্ন সৈকত। চলো আমাদের সঙ্গে, একটা সাইড রেলি দিয়ে দিব।
সাইড রোল পেয়েছিলে?
জি-না। আমি আর সবুজ ভাই ব্যংককে গেলাম শনিবারে। রোববারে নাটকের দলের বাকি সবার আসার কথা। তারা ভিসা পায় নাই বলে আসতে পারল না।
তুমি সবুজ ভাইয়ের সঙ্গে কত দিন ব্যংককে ছিলে?
সাত দিন। সবুজ ভাই অপেক্ষায় ছিলেন যদি নাটকের দল চলে আসে। ব্যাংককে খুব মজা করেছিলাম। সবুজ ভাই খুব আমুদি মানুষ।