জলযানে চমৎকার ঝড়ের বর্ণনা কোনো লেখকের লেখায় আমি তেমনভাবে পাই নি। তবে শরৎচন্দ্রের লেখায় সমুদ্রঝড়ের চমক্কার বর্ণনা আছে। শ্রীকান্ত দ্বিতীয় খণ্ডে শ্রীকান্ত সমুদ্রঝড়ে পড়েছিল।
শরৎচন্দ্র থাকতেন বার্মায়। বার্মা থেকে বঙ্গদেশে জাহাজে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতাই তিনি শ্রীকান্তের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন। কয়েক লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না–
ছোটবেলায় অন্ধকার রাত্রে ঠাকুমার বুকের ভিতর ঢুকিয়া সেই যে গল্প শুনিতাম, কোনো এক রাজপুত্র এক ডুবে পুকুরের ভিতর হইতে রূপার কৌটা তুলিয়া সাতশ রাক্ষসীর প্রাণ সোনার ভোমর হতে পিষিয়া মারিয়াছিল এবং সেই সাতশ রাক্ষসী মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে পদভরে সমস্ত পৃথিবী মাড়াইয়া গুড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল, এও যেন তেমনি কোথায় কী একটা বিপ্লব বাঁধিয়াছে; তবে রাক্ষসী সাতশ নয়, সাতকোটি, উন্মুক্ত কোলাহল এদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে। আসিয়াও পড়িল। রাক্ষসী নয়—ঝড়। তবে এরচেয়ে বোধ করি তাহাদের আসাই ঢের ভালো ছিল। এই দুর্জয় বায়ুশক্তির বর্ণনা করাও ঢের দূরের কথা, সমগ্র চেতনা দিয়া অনুভব করাও যেন মানুষের সামর্থ্যের বাহিরে।
ঝড়ের প্রকোপ কিছুটা কমেছিল, হঠাৎ আবার বাড়ল। লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়ে গেল। আতঙ্কজনক অবস্থা। এর মধ্যে দেখি সর্পরাজ এবং ম্যানেজার বিশাল এক পিতলের ডেগ নিয়ে অনেক কষ্টে আসছে। আমি বললাম, ডেগ দিয়ে কী হবে?
ম্যানেজার বলল, স্যার আপনি ডেগের ভেতর বসে থাকবেন। ডেগ পানিতে ভাসবে।
সর্পরাজ বলল, ডেগের ভিতর একটা লোটা দিয়ে দিয়েছি। বৃষ্টির পানি জমলে পানি সেঁচবেন।
ম্যানেজার বলল, নিচে বিরাট এক ঝামেলা হয়েছে স্যার। আমি বললাম, ঝড়ের ঝামেলা তো চলছেই। আর কী ঝামেলা?
সোনালি মেয়েটা ভয়ে ফিট পড়েছে। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। ছোটানো যাচ্ছে না।
সে যাচ্ছে নাকি?
মেয়েটার হাতে টাকা নাই পয়সা নাই, শুরু করেছে এমন কান্দা।
সর্পরাজ বলল, ছবিতে ছোটখাটো একটা রোল তারে দিয়ে দিয়েন। মেয়েটা নাচও জানে। নিচে যখন গানবাজনা হচ্ছিল তখন তালে তালে নাচল। সবাই ভালো বলেছে।
আমি ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। ঝড়-তুফান চলছে, এর মধ্যে ফিল্মে ঢোকার সুপারিশ।
ম্যানেজার বলল, সোনালি বলেছে একটা পাসিং শট পেলেও নাকি তার জীবন ধন্য।
যেসব পাঠক পাসিং শট বুঝতে পারছেন না তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি— পাসিং শট হচ্ছে মূল অভিনেতা অভিনেত্রী কথা বলছে, দূর দিয়ে কেউ হেঁটে চলে গেল। দূর দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়াটাই শট।
নাটকে অভিনয় করার তীব্র আগ্রহ আমি মেয়েদের মধ্যেই বেশি দেখেছি। তারা যে-কোনো মূল্যে অভিনয় করতে চায়। মূল্যটা যে কত বড় তা জেনেও না-জানার ভান করে।
আমি একবার এক বিয়েতে গিয়েছিলাম। বিয়ের কনে আমাকে দেখে আবেগজর্জরিত গলায় বলল, আঙ্কেল, আমার সারা জীবনের স্বপ্ন অভিনয় করা।
আমি বললাম, স্বপ্ন পূরণের সুযোগ তো পেয়ে গেছ। বিয়ে হয়ে গেল, বাকি জীবন কাটবে স্বামীর সঙ্গে অভিনয় করে।
ঝড় থেমে গেছে
ঝড় থেমে গেছে।
আমাদের লঞ্চ ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি একটা জায়গায় থেমে আছে। জায়গাটা দেখাচ্ছে খানিকটা সুন্দরবনের বাড়ির মতো। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশ মেঘশূন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে রূপার থালার মতো প্রকাও চাদ উঠলেও আমি বিস্মিত হব না।
প্রবল উত্তেজনার অবসান হলে শরীরে কোমল আলস্য নেমে আসে। লেখকের ভাষায় কোমল আলস্য বললাম। সাধারণ ভাষায় শরীর ছেড়ে দেয়। আমার শরীর মন দুইই ছেড়ে দিয়েছে। ডেকে চেয়ার পেতে বসেছি। এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে চায়ের কাপ। আমার চমক্কার লাগছে।।
অসংখ্য ছেলেমেয়ে তীরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের চাঞ্চল্য দেখে মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম তারা লঞ্চ নামক জলযান দেখল। শিশুদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। ভাটি অঞ্চল সম্পর্কে প্রচলিত কথা হলো, সাতটার কম কারোর ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে আঁটকুড়া বলা হয়। কথা সত্যি হতে পারে।
সর্পরাজ মুখভর্তি পান নিয়ে আমার পাশে বসে আছে। শুধু ঝড়ের সময় তার মুখে পান দেখি নি। এই সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণ তার মুখে পান। আমার ধারণা ঘুমের মধ্যেও সে পান খায়। তার স্ত্রী (আমি ডাকি সর্পরানী) ঘুমন্ত স্বামীর মুখে পান ঠেলে দেয়।
সর্পরাজ বলল, স্যার, এই জায়গাটার নাম তারানগর।
আমি বললাম, এমন অজপাড়াগাঁর নাম নগর।
এর উত্তরে মুখভর্তি পান নিয়ে সে কী বলল, ঠিক বোঝা গেল না। তার সিলেটি ভাষা আমার কাছে বেশিরভাগ সময় দুর্বোধ্য মনে হয়।
সর্পরাজ লঞ্চের ডেকে টকটকে লাল রঙের পিক ফেলে বলল, স্যার, মুনশি সাবরে খবর দিয়া আনব? আলাপ করলে মজা পাবেন।
আমি বললাম, কাউকে খবর দিয়ে আনতে হবে না। আমি যথেষ্ট মজা এমনিতেই পাচ্ছি। আমরা মূল লোকেশনের দিকে কখন রওনা হব?
সর্পরাজ বলল, সমইস্যা আছে।
সমস্যার বিষয়টা শুনলাম। আমরা মূল লোকেশন থেকে অনেক উত্তরে চলে এসেছি। সুনামগঞ্জ ফিরে যাওয়ার মতো ডিজেল লঞ্চে নেই। ডিজেলের সন্ধানে লোক গেছে।
আমি বললাম, এত সামান্য ডিজেল নিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম?
এই প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত কথা শুনলাম। লঞ্চ যখন আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা হলো তখনই এক ড্রাম ডিজেল ফেলে দেওয়া হলো। আল্লাহ যেন বোঝেন লঞ্চযাত্রীরা এখন সম্পূর্ণ অসহায়। তাঁর রহমত ছাড়া এদের গতি নেই।