হঠাৎ করেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, লঞ্চ প্রবলভাবে দুলে উঠল। টেবিলে রাখা টিপট ছিটকে পায়ের কাছে পড়ল।
যখন যাত্রা শুরু করেছি তখন আকাশে হালকা মেঘ ছিল। এখন দেখি আকাশে ঘন কালো মেঘ। এই মেঘ ঝড়ের রূপ নিয়েছে। বৃষ্টি নেই। শুধুই প্রচণ্ড বাতাস। বাতাস একদিক থেকে আসছে না, ক্ষণে ক্ষণে দিক পরিবর্তন করছে।
আমি সর্পরাজকে নিয়ে লঞ্চের সারেং-এর ঘরে ঢুকলাম। ঝড়ের গতিপ্রকৃতি সে-ই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে।
লঞ্চের সারেং-এর সঙ্গে ল্যাব এইডের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বরেনের মিল আছে। চেহারায় না, কথায়। ডা. বরেন হাসিমুখে রোগীকে দুঃসংবাদ দিতে পছন্দ করেন। লঞ্চের সারেংও তাই। সে হাসিমুখে আমাকে বলল, স্যার লঞ্চ তো ডুবতে ধরছে। খেলনার মতো ছোট লঞ্চ। না ডুইবা উপায় কী?
আমি আঁতকে উঠে বললাম, বলেন কী?
সারেং বলল, বাতাসের নমুনা খুবই খারাপ। ঘূর্ণি বাতাস। বিনা নোটিশে লঞ্চ ডুবব। আপনি কি টাইটানিক ছবিটা দেখেছেন?
আমি প্রচণ্ড ঝড়ে সিনেমা নিয়ে আলাপে উৎসাহ পেলাম না, চুপ করে রইলাম।
সারেং নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এত বড় জাহাজ ডুবে গেল, আর এইটা তো পুলাপানের খেলনা।
শাওন এবং নিষাদ সঙ্গে না থাকার প্রবল দুঃখবোধ হঠাৎ আনন্দে রূপান্তরিত হলো। লঞ্চের সঙ্গে আমি একা তলিয়ে যাব। ওরা যাবে না। এরচেয়ে আনন্দময় সংবাদ আর কিছুই হতে পারে না।
সর্পরাজ বলল, স্যার ভয় পাবেন না। হাওরে পানির গভীরতা কম। দশ বারো ফুটের বেশি হবে না।
আমি বললাম, ডুবে মরার জন্য দশ ফুট পানি যা দশ হাজার ফুট পানিও ত।
আপনি সাঁতার জানেন তো?
আমি বললাম, সাঁতার জানি। সাঁতরে ব্রজেন দাশের পক্ষে হয়তো হাওর পাড়ি দেওয়া সম্ভব। আমার পক্ষে না।
সর্পরাজ বলল, কিছু ধরে ভেসে থাকতে পারবেন না?
কী ধরে ভেসে থাকব?
দেখি কিছু পাওয়া যায় কি না।
সর্পরাজ অনেক কষ্টে নিচে নেমে গেল। ঝড়ের গতি ক্রমেই দেখি বাড়ছে। দুএক ফোটা করে বৃষ্টি পড়ছে। সমুদ্রঝড় আমি কখনো দেখি নি। শুনেছি তখন ঢেউ ফুলে ফেঁপে পাহাড়ের মতো হয়। এখানেও তাই হচ্ছে। প্রকাণ্ড ঢেউ লঞ্চের গায়ে আছড়ে পড়ছে। লঞ্চ ঢেউয়ের উপর উঠে যাচ্ছে না। ঢেউ লঞ্চের একতলায় ঢুকে যাচ্ছে। একতলা পানিতে ভর্তি হলে লঞ্চ ডুববে, এটাই স্বাভাবিক।
সারেং মনে হয় সব আশা ছেড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ হুইল ধরে ছিল, এখন হুইল ছেড়ে সিগারেট ধরিয়ে বলল, আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিলাম।
সাৱেং-এর চেহারা দেখে মনে হলো না সে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। সিগারেট সে বেশ আয়েশ করে টানছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ এভাবে সিগারেট টানে না।
সারেং বলল, হাওরের এই জায়গায় প্রায়ই ঝড় উঠে। আকাশে মেঘের ছিটাফোটা নাই, তারপরেও ঝড়। অনেক নৌকা ডুবেছে। দুই বছর আগে একটা একতলা লঞ্চ ডুবেছে। এগারোজন মানুষ মারা গেছে।
আমি বললাম, এই জায়গাতেই ঝড় কেন উঠে?
এই পথে জ্বিনের বাদশার যাতায়াত, তার কারণে ঝড় উঠে।
লঞ্চের একতলা থেকে সমবেত কণ্ঠে আযানের আওয়াজ আসছে। আমি সারেংকে বললাম, আযান কেন দিচ্ছে, জ্বিনের বাদশা তাড়াবার জন্যে?
সারেং বলল, মহা দুর্যোগে আযান দেওয়ার বিধান আছে।
আমি বললাম, আযান হচ্ছে নামাজের জন্যে আহ্বান। দুর্যোগ কেটে গেলে সবাই কি নামাজ পড়বে?
সারেং বলল, দুর্যোগ কেটে গেলে কাউরে নামাজ পড়তে দেখি না। আপনি জটিল কথা বলেছেন।
ছোটবেলার ঝড়ের এক স্মৃতি আমার আছে। নানার বাড়িতে আছি। হঠাৎ বিকেলে কালবৈশাখী ঝড় উঠল। এমন অবস্থা যে-কোনো মুহূর্তে বাড়িঘর ভেঙে পড়বে। ছোটদের সব চুকানো হয়েছে খাটের নিচে। মাথার উপর বাড়ি ভেঙে পড়লেও যেন জীবন রক্ষা হয়। পুরুষরা সবাই আযান দিচ্ছেন। উঠানে শিলপাটা ছুড়ে ফেলা হলো। শিলপাটা দেখে ঝড় নাকি তার রাগ সামলে অন্য বাড়ির দিকে যায়। আমার নানিজান জলচৌকিতে দাড়িয়ে যেদিক থেকে বাতাস আসছে সেদিকে আঙুল দেখিয়ে সূরা পাঠ করছেন। ঝড়ের দিকপরিবর্তনের সঙ্গে তার আঙুলের দিকও পাল্টাচ্ছে। নানার বাড়ির সেই ভয়াবহ ঝড় হঠাৎ করেই থেমে গেল। ছোটরা দৌড়ে গেলাম আমবাগানের দিকে।
এই ঝড়ও কি হঠাৎ থামবে?
ফোটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল, এখন প্রবল বর্ষণ শুরু হলো। সারেং বলল, আর ভয় নাই বৃষ্টি নামছে।
বৃষ্টি নামলে ভয় নাই কেন?
জ্বিনের বাদশা আগুনে তৈয়ার। জ্বিন জাতি বৃষ্টির মধ্যে থাকতে পারে না। তার উপর ঘূর্ণি বন্ধ হয়েছে। দক্ষিণা বাতাস ছাড়ছে।
আমি বললাম, আপনার কাছে কম্পাস আছে?
না।
লঞ্চ যেভাবে ঘুরপাক খেয়েছে কম্পাস ছাড়া দিক বুঝবেন কীভাবে? যতদূর চোখ যায় পানি ছাড়া কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। সূর্যও মেঘে ঢাকা।
সারেং বলল, আপনি আরেকটা জটিল কথা বলেছেন।
সারেং অমির জটিল কথায় মুগ্ধ। আমি হাওরের ঝড় এবং বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ। ঝড়ের প্রকোপ মোটেই কমে নি, কিন্তু আমার ভয় কমে গেছে। মানুষ বেশিক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় থাকতে পারে না। প্রকৃতি ব্যবস্থা রেখেছে। আতঙ্কিত মানুষের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে প্রচুর এনড্রেলিন নামের জারক রস বের হয়। আতঙ্কিত মানুষের ভয় কেটে যায়।
লেখকদের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। তারা যে-কোনো সময় তাদের নিজেদের ভুবনে ঢুকে যেতে পারেন। আমি সেই প্রস্তুতি নিলাম। চোখের সামনে হিমুকে দেখলাম। সে লঞ্চে যাচ্ছিল। ঝড়ের মধ্যে লঞ্চ পড়েছে। হিমু তার স্বভাব অনুযায়ী বিচিত্র কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এই বিষয়ে উপন্যাসটি আমি লিখতে শুরু করেছি। নাম দিয়েছি হিমুর আছে জল।