আমি কাকে অর্ডার দিলাম।
মেয়েকে দিয়েছেন স্যার। সে আপনার আত্মীয় হয়। খালাতো বোন।
তাকে ডাকো।
খালাতো বোন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মধুর ভঙ্গিতে হাসল। এই হাসি অনেক সাধনা করে শেখা, নাকি প্রকৃতিপ্রদত্ত বুঝলাম না।
নাম কী?
আমার শোবিজের নাম সোনালি।
আসল নাম কী?
সালমা।
গ্রামের বাড়ি কোথায়?
দিনাজপুরে।
দিনাজপুরে আমার কোনো খালা থাকেন বলে জানি না। তুমি নাকি বলেছ তুমি আমার খালাতো বোন?
সরি স্যার, মিথ্যা করে বলেছি। মিথ্যা না বললে আসতে পারতাম না।
শোবিজে করো কী?
র্যাম্প মডেল। এখন অভিনয় করতে চাই বলেই আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। আজকাল পরিচয় ছাড়া কিছু হয় না।
একা এসেছ?
হুঁ।
বাবা-মা তোমাকে একা ছেড়ে দিল?
আমার বয়স একুশ। একা কেন ছাড়বে না? স্যার, আপনি নতুন যে ছবিটা বানাচ্ছেন সেখানে আমাকে ছোট হলেও একটা রোল দিতে হবে। আমি কোনো কথা শুনব না। যে-কোনো মূল্যে আমার একটা ব্রেক লাগবে।
আমি ম্যানেজারকে বললাম, এই মেয়েকে কানে ধরে বিদায় করে দাও।
ম্যানেজার বলল, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই।
আমি লক্ষ করেছি, ইদানীং মানুষকে আহত করে আনন্দ পাচ্ছি। বয়সের একটা পর্যায়ে এরকম হয়।
জর্জ বার্নাড শ নাকি লাঠি হাতে মারার জন্যে তেড়ে যেতেন। মার্ক টোয়েন থান ইটের সাইজের বই ছুড়ে মেরে এক সাংবাদিককে আহত করেছিলেন।
আমি তাঁদের মতো বড় মাপের কেউ না বলে কঠিন রসিকতায় নিজেকে আটকে রেখেছি। এটাই বা খারাপ কী?
লঞ্চের নাম এম এল কুশিয়ারা
লঞ্চের নাম এম এল কুশিয়ারা। সাধারণত জলযানের নামের আগে এম এল কিংবা এম ভি থাকে। এম এল-এর অর্থ মোটর লঞ্চ। বড় লঞ্চগুলি হয় এম ভি, এর অর্থ মোটর ভেহিকেল।
ছোট্ট একতলা লঞ্চ। ছাদে সোফা পেতে আমার বসার ব্যবস্থা। নুহাশপল্লীর ম্যানেজার সামরিক আইন জারি করেছে—ছাদে কেউ থাকবে না। শুধু স্যার।
আকাশ মেঘলা বলে মাথার উপর শামিয়ানার প্রয়োজন নেই। তারপরেও শামিয়ানা খাটানো আছে।
লঞ্চ ছাড়ার পর মন বেশ খারাপ হলো।
নিষাদ থাকলে আনন্দে ছোটাছুটি করতে পারত। শাওন বেড়াতে পছন্দ করে। হাওর আগে দেখে নি। সে মুগ্ধ হতো। পৃথিবীর সমস্ত স্বামীদের মতো আমিও স্ত্রীর মুগ্ধ চোখ দেখতে পছন্দ করি। এই মুগ্ধতার জন্যে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। প্রকৃতি ব্যবস্থা করে রেখেছে।
লঞ্চ ছেড়েছে ভোরবেলায়, আমরা দুপুরের মধ্যে পৌছে যাব। আমাকে লোকেশনে নিয়ে যেতে সিলেট থেকে এসেছে নাট্যকর্মী আরজু। আমি তাকে ডাকি সর্পারাজ। কারণ একসময় তার মাথায় বাণিজ্যিকভাবে সাপ চাষের আইডিয়া এসেছিল। প্রকল্প অনেকদূর এগুনোর পর পরিত্যক্ত হয়। একটা দুষ্ট গোখরো সাপ তাকে তাড়া করেছিল। নিজের পোষা সাপের এই ব্যবহারে আরজু মর্মাহত হয়েই প্রকল্প ত্যাগ করল। তবে তার টাইটেল ত্যাগ করল না। সে টেলিফোন করলে আমি হ্যালো বলার আগেই বলে, স্যার আমি সর্পরাজ আরজু।
সর্পরাজ আডডাবাজ রসিক মানুষ। পান খেতে খেতে কঠিন মুখে রসিকতা করে। শুনতে ভালো লাগে। তার মুখ থেকে লাল পানের রস গড়িয়ে ধবধবে সাদা শার্ট পড়ে, সেটাও দেখতে ভালো লাগে।
আমার সামনে টি-পট ভর্তি চা। চা খেতে খেতে এগোচ্ছি। দুঘণ্টার মধ্যে হাওরে পড়লাম। যারা হাওর দেখেন নি তাদের হাওরের সৌন্দর্য বুঝানো যাবে না। চোখের দৃষ্টি কোথাও আটকাচ্ছে না। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি! সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঢেউ উঠছে। পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। স্বচ্ছ পানিকে কাকের চোখের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বলা হয় কাকচক্ষু জল। হাওরের পানি তারচেয়েও স্বচ্ছ। প্রচুর পদ্ম ফুটেছে। পদ্মগুলি নাকি দুপুর বারোটার মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নেবে।
শীতের সময় হাওরের পানি নেমে যাবে। ধান চাষ হবে। পানির সমুদ্র থেকে হাওর হবে সবুজের সমুদ্র।
আমি সর্পরাজকে বললাম, হাওরের জমি নিশ্চয় কারোর একার না। অনেকের জমি এখানে আছে।
সর্পরাজ বলল, জি স্যার।
পানি শুকিয়ে গেলে কীভাবে বোঝা যাবে কার জমি কোনটা?
পানি শুকিয়ে গেলে জমির আল দেখা যায়। আল দেখে সীমানা নির্ধারণ হয়। সমস্যা হলে সালিশে মীমাংসা হয়। স্যার কি একটা পান খাবেন? ভালো খাসিয়া পান ছিল।
চা খাচ্ছি। পান খাব কীভাবে?
এক গালে পান রাখবেন, অন্য গালে চা। এর মজা অন্য। আমি তো এইভাবেই চা খাই।
তুমি খাও, আমি খাব না। এখন করছ কী? নতুন কোনো প্রকল্প?
কুমির চাষের প্রকল্প হাতে নিয়েছি। কুমির চাষ করব। বিদেশে রপ্তানি করব।
কুমির কে কিনবে?
সর্পরাজ বলল, কুমিরের মাংস অনেকেই খায়। বিরাট ডিমান্ড। কুমিরের চামড়ার ডিমান্ড।
সর্পরাজ মহা উৎসাহে কুমির চাষের নানান দিক ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। আমি কিছু শুনছি, বেশির ভাগই শুনছি না। চোখের পাতা থাকার কারণে চোখ বন্ধ করা যায়। কান বন্ধ করার কোনো সিস্টেম না থাকলেও আমি কান বন্ধ করতে পারি। যে হড়বড় করে কথা বলছে তার মনে হবে আমি গভীর আগ্রহে শুনছি। আসলে ভা-না।
লঞ্চের একতলায় মহা উৎসব শুরু হয়ে গেছে। গানবাজনার আসর বসেছে। ঢোলের প্রবল বাড়িতে গানের কথা বোঝা যাচ্ছে না। গায়কের লম্বা টান শুনে মনে হচ্ছে বিচ্ছেদ সঙ্গীত।
নিচ থেকে আসছে গানের শব্দ, ডেকে সর্পরাজ এখন কুমিরের ডিম নিয়ে কী যেন বলছে। গান এবং কুমিরের ডিমে একাকার হয়ে গেছে। আমার ঝিমুনির মতো এসেছে। ঝিমাতে ঝিমাতে ছোট্ট স্বপ্নও দেখে ফেললাম। স্বপ্নে পুত্র নিষাদ বলছে, বাবা, আমার জন্যে একটা চকলেট রেলগাড়ি আনবে।