অনেক বকবক করে ফেলেছি। নিজের বকবকানিতে আমি নিজেই মুগ্ধ। এখন চুপ করা যাক। নীরবতা হিরন্ময়।
ম্যাজিক মুনশিকে ঢাকায় নিয়ে আসতে ছয়-সাত দিনের বেশি লাগার কোনো কারণ নেই। পনের দিন পার হয়ে গেল, আমার দুই কর্মচারীর কোনোই খোঁজ নেই। তারা সুনামগঞ্জ থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় রওনা হয়েছে এই খবর পাওয়া গেল। কোন নৌকায় গিয়েছে নৌকার মাঝি ফিরেছে কি না তা জানা গেল না।
নৌকাডুবি হয়ে তারা মারা গেছে তাও মনে হচ্ছে না। মারা গেলে খবর পাওয়া যেত। এর মধ্যে খবর রটে গেছে আমি দুই কর্মচারীকে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডে পাঠিয়েছিলাম, পথে সমুদ্রে ডুবে এরা মারা গেছে।
এর মধ্যে শাওন স্বপ্নে দেখল, নুহাশপল্লীর দিঘিতে দুটা লাশ উপুড় হয়ে ভাসছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। গায়ের কাপড় দেখে মনে হচ্ছে এরা আমার দুই নিখোঁজ কর্মচারী।
তাদের দুজনের নামে দুটা মুরগি ছদগা দেওয়া হলো (এটাও কিন্তু ম্যাজিক)।
কুড়ি দিনের মাথায় আমি ধানমণ্ডি থানার ওসি কামরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কামরুল আমার অনেক নাটকে ওসির ভূমিকায় অভিনয় করেছে।
কামরুল বলল, স্যার, এরা কি টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে?
আমি বললাম, না। অযথা টাকা খরচ করার বিষয়ে তাদের অসাধারণ দক্ষতা আছে, কিন্তু টাকা নিয়ে পালানোর মানসিকতা নেই।
কামরুল বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সাত দিনের মধ্যে আমি পাত্তা লাগাব।
এক মাস পার হলো কোনো পাত্তা লাগানো গেল না। আমি থানায় জেনারেল ডায়েরি করালাম।
একমাস ছদিন পর তারা ফিরল। দুজনের চেহারাই কাকলাসের মতো। কাপড় মলিন। একজনের পায়ে জুতা স্যান্ডেল কিছুই নেই। সে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তারা নাকি ভুল করে ইন্ডিয়ান বর্ডারে চলে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ওদের জেলে এতদিন ছিল।
আমার চিঠি মুনশির হাতে তারা দিতে পারে নি। চিঠি আছে ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের কাছে। এই চিঠি দিয়েই তারা নাকি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পেরেছে বিশেষ একজনকে খুঁজতে এসে ভুলে বর্ডার ক্রস করেছে।
মুনশির সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ করা হয় নি। সর্পরাজ আরজুর কাছে জানলাম, এক ভরাপূর্ণিমায় মুনশির মৃতদেহ দিঘির জলে ভেসে উঠেছে। মুনশির বিছানায় উঠে বসা বা নড়াচড়ার কোনো সামর্থ্যই ছিল না। দিঘি পর্যন্তু সে কীভাবে গেল সেটাই তারানগরের বর্তমান আলোচ্য বিষয়।
রহস্যময় এই জগতের বিপুল রহস্যের অতি সামান্যই আমরা জানি। আমাদের উচিত এই সামান্য জ্ঞান নিয়েই তুষ্ট থাকা। বেশি জানতে না চাওয়া। Ignorence is bliss.
পাদটিকা – ডাইনী
কৌতূহলী পাঠকদের জন্যে তারাশঙ্করের ডাইনী গল্পটি দিয়ে দেওয়া হলো।
ডাইনী
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
কে কবে নামকরণ করিয়াছিল সে ইতিহাস বিস্মৃতির গর্ভে সমাহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু নামটি আজও পূর্ণগৌরবে বর্তমান ছাতি-ফাটার মাঠে জলহীন ছায়াশূন্য দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরটির এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া অপর প্রান্তের দিকে চাহিলে ওপারের গ্রামচিহ্নের গাছপালাগুলিকে কালো প্রলেপের মত মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন যেন কেমন উদাস হইয়া উঠে। এপার হইতে ওপার পর্যন্ত অতিক্রম করিতে গেলে তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া মানুষের মৃত্যু হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়; বিশেষ করিয়া গ্রীষ্মকালে। তখন যেন ছাতি-ফাটার মাঠ নামগৌরবে মহামারীর সমকক্ষতা লাভ করিবার জন্য লালায়িত হইয়া উঠে। ঘন ধূমাচ্ছিন্নতার মত ধূলার একটা ধূসর আস্তরণে মাটি হইতে আকাশের কোল পর্যন্ত আছন্ন হইয়া থাকে; অপর প্রান্তের সুদূর গ্রামচিহ্নে সীমারেখা প্রায় নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। তখন ছাতি-ফাটার মাঠের সে রূপ অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর! শূন্যলোকে ভাসে একটি ধূধূসরতা, নিম্নলোকে তৃণচিহ্নহীন মাঠে সদ্য-নির্বাপিত চিতাভস্মের রূপ ও উত্তপ্ত স্পর্শ। ফ্যাকাশে রঙের নরম ধূলার রাশি প্রায় এক হাত পুরু হইয়া জমিয়া থাকে। গাছের মধ্যে এত বড় প্রান্তরটার এখানে ওখানে কতকগুলি থৈৱী ও সেয়াকুল জাতীয় কণ্ঠকগুল্ম। কোনো বড় গাছ নাই—বড় গাছ এখানে জন্মায় না, কোথাও জল নাই, গোটাকয়েক শুভূগর্ভ জলাশয় আছে, কিন্তু জল তাহাতে থাকে না।
মাঠখানির চারিদিকেই ছোট ছোট পল্লী—সবই নিরক্ষর চাষীদের গ্রাম; সত্য কথা তাহারা গোপন করিতে জানে না—তাহারা বলে, কোন অতীতকালের এক মহানাগ এখানে আসিয়া বসতি করিয়াছিল, তাহারই বিষের জ্বালায় মাঠখানির রসময়ী রূপ, বীজপ্রসবিনী শক্তি পুড়িয়া ক্ষার হইয়া গিয়াছে। তখন নাকি আকাশলোকে সঞ্চরমাণ পতঙ্গ-পক্ষীও পঙ্গু হইয়া ঝরা-পাতার মত ঘুরিতে ঘুরিতে আসিয়া পড়িত সেই মহানগরের গ্রামের মধ্যে।
সে নাগ আর নাই, কিন্তু বিষজর্জরত এখনও কমে নাই। অভিশপ্ত ছাতিফাটার মাঠ! তাহারই ভাগ্যদোষে ঐ বিষজর্জরতার উপরে আর এক ক্রুর দৃষ্টি তাহার উপর প্রসারিত হইয়া আছে। মাঠখানার পূর্বপ্রান্তে দলদলির জুলা, অর্থাৎ অত্যন্ত গভীর পঙ্কিল ঝরনা জাতীয় জলটার উপরেই রামনগরের সাহাদের যে আমবাগান আছে, সেই আমবাগানে আজ চল্লিশ বৎসর ধরিয়া বাস করিতেছে এক ডাকিনী—ভীষণ শক্তিশালিনী নিষ্ঠুর ক্রুর একটা বৃদ্ধা ডাকিনী। লোকে তাহাকে পরিহার করিয়াই চলে, তবু চল্লিশ বৎসর ধরিয়া দূর হইতে তাহাকে দেখিয়া তাহার প্রতিটি অঙ্গের বর্ণনা তাহারা দিতে পারে, তাহার দৃষ্টি নাকি অপলক স্থির, আর সে দৃষ্টি নাকি আজ চল্লিশ বৎসর ধরিয়াই নিবদ্ধ হইয়া আছে এই মাঠখানার উপর।