আমি বললাম, Holy cow.
ম্যানেজার বলল, গরুর মাংসের ব্যবস্থা স্থানীয়ভাবে করা হবে স্যার।
আমি বললাম, সব বাতিল। শুধু আমি যাব, শাওন যাবে আর নিষাদ যাবে। ক্যামেরাম্যান মাহফুজ আর সেট ডিজাইনার কুদ্দুস যাবে। বন্ধুবান্ধব দলবল না। ঢাকা থেকে নিজের গাড়িতে সুনামগঞ্জ যাব। গান শুনতে ইচ্ছা করলে শাওন গাইবে। সে খালি গলায় গান করতে পছন্দ করে, কাজেই হারমোনিয়াম তবলচি কিছু লাগবে না।
ম্যানেজার মাথা চুলকে বলল, ইতিমধ্যে অনেক খরচ হয়ে গেছে। অনেককে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করা হয়েছে।
আমি বললাম, হোক। যা গেছে তা গেছে। কে সারা সারা।
ভোরবেলা গাড়িতে উঠলাম আমি একা। হঠাৎ শাওনের শরীর খারাপ করেছে। সে যেতে পারছে না। নিষাদ মাকে ছেড়েই আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে তৈরি। তার মা ছাড়বে না।
আমি বললাম, তোমার ছেলের কোনো অসুবিধা হবে না। নিশ্চিন্ত মনে ছেড়ে দাও।
শাওন বলল, তুমি যখন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন ছেলের দিকে ফিরেও তাকাবে না। সে খেলতে খেলতে চলে যাবে হাওরের দিকে। তখন?
নিষাদ গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল, আমি বাবার সঙ্গে যাব! আমি বাবার সঙ্গে যাব!
তার এই কান্না অবশ্যি খুবই সাময়িক। আমি চোখের আড়াল হওয়া মাত্র সে কান্না থামিয়ে নতুন কোনো খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিছুদিন ধরে চকলেট গাড়ি নামের এক খেলা সে আবিষ্কার করেছে। চকলেটের একটা প্যাকেট মেঝেতে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়। মুখে ট্রেনের মতো ঝিকঝিক শব্দ করে।
আমি যথেষ্টই মন খারাপ করলাম। শাওন তা বুঝতে পেরেও না-বোঝার ভান করে বলল, সাবধানে থেকো।
সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে গাড়ি রেখে লঞ্চে উঠব এমনই কথা ছিল। সার্কিট হাউসের কম্পাউন্ডে ঢুকে ধাক্কার মতো খেলাম। এস এ পরিবহনের বিশাল গাড়ি আগে থেকেই উপস্থিত। গাড়ির ভেতর এবং বাইরে নুহাশ চলচ্চিত্র এবং নুহাশপল্লীর পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছি। ইসলামউদ্দিন বয়াতি তার লোকজন নিয়ে দলবেঁধে হাঁটাহাটি করছে।
আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নুহাশপল্লীর ম্যানেজার ছুটে এল। আমি বললাম, এসব কী?
ম্যানেজার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, সব পেমেন্ট আগেই করা, তাই চলে এসেছে।
ছবির ক্যামেরাম্যান মাহফুজ কি এসেছে?
তাকে একবার মোবাইল করেছিলাম, তিনি ধরেন নি। পরে আবার করতে ভুলে গেছি।
সেট ডিজাইনার কুদ্দুস?
তাঁকে খবর দিতে বিস্মরণ হয়েছি।
তোমার চাকরি এই মুহূর্ত থেকে নট।
জি আচ্ছা স্যার।
ম্যানেজারকে চাকরি চলে যাওয়ায় মোটেই চিন্তিত এবং বিচলিত মনে হলো না। বরং আনন্দিত মনে হলো। নুহাশপল্লী থেকে বেশ কয়েকবার তার চাকরি গেছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর পরই সে ব্যাগ-সুটকেস গুছিয়ে আমাকে কদমবুসি করে বাড়ি চলে যায়। পরিবারের সঙ্গে সপ্তাহখানিক কাটিয়ে আবার হাসিমুখে ফিরে এসে চাকরি শুরু করে, যেন চাকরি যাওয়ার মতো কিছু ঘটে নি।
বারান্দায় তেইশ চব্বিশ বছরের হলুদ গেঞ্জি পরা এক তরুণ ঘুরছে। তার গলায় ক্যামেরা, ঠোঁটে সিগারেট। এই বয়সের তরুণদের কাছ থেকে আমি কিছুটা সমীহ পাই। আমার সামনে পড়লে সিগারেট লুকানোর চেষ্টা করে। এই তরুণ তা করছে না। সে বেশ আয়েশ করে ধোয়া ছাড়ছে। আমি ম্যানেজারকে বললাম, এই ছেলে কে?
ম্যানেজার বলল, স্যার সাংবাদিক। আমাদের সঙ্গে যাবে। পথে আপনার ইন্টারভ্যু করবে। ফটোসেশান করবে।
আমি বললাম, এর ভাবভঙ্গি তো প্রথম আলোর সাংবাদিকের মতো। ধরাকে সরা না, লবণের চামুচ জ্ঞান করছে।
ম্যানেজার বলল, প্রথম আলোর সাংবাদিক না স্যার। সুনামগঞ্জের লোকাল সাংবাদিক।
ডাকো তাকে।
তরুণ সাংবাদিক সিগারেট হাতেই এগিয়ে এল।
আমি বললাম, তুমি কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত?
স্যার আমি প্রথম আলোর লোকাল করস্পনডেন্ট।
ও আচ্ছা। ভাবভঙ্গি সেরকমই।
লঞ্চে আপনার বিশাল ইন্টারভ্যু নেব। আমাকে দুঘন্টা সময় দেবেন।
আমি তো সাংবাদিক নিয়ে চলাফেরা করি না। তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না।
তাহলে এখানেই ইন্টারভ্যু সেরে ফেলি? মিনি ইন্টারভ্যু।
আমি বললাম, তুমি দুটা প্রশ্ন করবে। এর বেশি না।
ঈদের ফ্যাশন নিয়ে দুটা প্রশ্ন করি?
করো। প্রথম প্রশ্ন, ঈদের দিন ভোরে আপনি কী পরবেন?
ঈদের দিন তো তোমাদের পত্রিকা বের হয় না, কাজেই ঠিক করেছি টাইম ম্যাগাজিন পড়ব। দ্বিতীয় প্রশ্ন কী?
আমি জানতে চাচ্ছিলাম নামাজের সময় আপনি কী পরবেন?
নামাজের সময় তো নামাজই পড়ব। আর কী পড়ব? দুটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, এখন বিদায় হও।
সাংবাদিক আহত চোখে তাকিয়ে রইল। আমার কঠিন রসিকতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় সুখকর হওয়ার কথাও না। আমার খানিকটা মায়া লাগল। আমি বললাম, তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পার, তবে ইন্টারভ্যু, ফটোসেশন এইসব বাদ। ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে, এক শত হাত দূরে থাকুন। দেখেছ না?
জি স্যার।
আমার কাছ থেকেও এক শ হাত দূরে থাকবে।
তরুণ সাংবাদিক আগ্রহ নিয়ে বলল, স্যার আমি একজন কবি। আমার দুটো কবিতার বই বের হয়েছে।
আমি নির্বিকার গলায় বললাম, তাহলে দুই শ হাত দূরে থাকবে।
তরুণ সাংবাদিক ছাড়াও এক তরুণীকে দেখলাম মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে কথা বলতে বলতে চক্রাকারে ঘুরছে। তার পোশক যথেষ্টই উগ্র। আমি ম্যানেজারকে বললাম, এই মেয়ে কে?
সে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে স্যার।
কেন যাচ্ছে?
সেটা তো স্যার আমি জানি না। আপনি অর্ডার দিয়েছেন বলে সে যাচ্ছে।