পরম হংস বললেন, এক আনা পয়সা দিলে মাঝি নৌকায় করে পার করে দেয়, এর জন্যে তুমি বিশটা বছর নষ্ট করলে?
মুনশি হো হো করে হেসে উঠল। গল্পটার ভেতর যে সূক্ষ্ম রস আছে তা সে ধরতে পারবে বলে আমি মনে করি নি।
আমার কাছে নলিনী বাবু B.Sc. উপন্যাসের একটা কপি ছিল। তাকে বইটা দিলাম। সে অত্যন্ত আগ্রহে হাত পেতে বইটা নিল যেন সাত রাজার ধন তাকে দেওয়া হয়েছে। তার এই বিনয়ও ভালো লাগল।
খাওয়ার ডাক এসেছে। আমি বললাম, চলুন খেতে যাই।
মুনশি বলল, জনাব গোস্তাকি মাফ হয়। আমি মাছ-মাংস খাই না। একবেলা আহার করি।
আপনি একাহারি?
জি জনাব। মাছ-মাংস খেলে শরীর ফুলে যায়। জ্বালাযন্ত্রণা হয়।
ম্যাজিক মুনশি চলে গেল।
সকাল আটটা।
ডিজেল পাওয়া গেছে। লঞ্চ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই বিশেষ ঘটনা দেখার জন্যে অঞ্চলের সকল শিশুকিশোর জড়ো হয়েছে। টাইটানিক প্রথম যাত্রা করার সময়ও তীরে এত মানুষ ছিল না।
মুনশি আমাকে বিদায় দিতে এসে বললেন, স্যার কাল রাতেই আপনার বইটা পড়ে শেষ করেছি। বইয়ের ঘটনা কি সত্যি?
আমি বললাম, আপনি যেমন কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন না, আমিও দেই। এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।
জনাব, কোনো অসুবিধা নাই। আপনি আমার কাছে কিছু আতর চেয়েছিলেন। এই আতর আপনার স্ত্রীর কাছে আছে বলে দিলাম না।
আমার স্ত্রীর কাছে এই আতর আছে?
মুনশি উঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কোনো কথা বলল না।
ঢাকায় এসে শাওনকে প্রথম যে প্রশ্ন করলাম, তোমার কাছে কি কোনো আতর আছে?
শাওন বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে আতর থাকবে কেন? আতর পুরুষদের ব্যাপার, মেয়েদের না।
আমি বললাম, চা-পাতার গন্ধ আছে এমন কোনো আতর?
শাওন বলল, আমার কাছে একটা পারফিউম আছে, নাম Elizabeth Arden, যার অবিকল চায়ের গন্ধ। এটার কথা বলছ?
হুঁ।
কী করবে?
কিছু করব না। কিছুক্ষণ গায়ে মেখে বসে থাকব।
ঢাকা শহর অদ্ভুত এক শহর। এই শহর তার বাসিন্দাদের গিলে পেটের ভেতর রেখে দেয়। বাসিন্দারা কিছুদিন বাইরে থেকে ফিরে আসামাত্র শহর তাদের নিজের মধ্যে টেনে নেয়, বাইরের স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়।
ম্যাজিক মুনশির ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গেলাম। ঢাকা শহরে এসে মুনশিকে আমার আর তেমন রহস্যময় মনে হলো না। তাকে নিয়ে আলাদা করে চিন্তাভাবনা করাও হয়ে উঠল না। আমি নানান ব্যস্ততায় জড়িয়ে গেলাম। ঘেটুপুত্র কমলা ছবির গান রেকর্ড করা, সেট বানানো, হাজারো সমস্যা।
তার চেয়েও বড় সমস্যা অর্থনৈতিক। যাঁরা এই ছবিতে অর্থলগ্নির কথা বলেছিলেন তাঁরা গা ঢাকা দিলেন! টেলিফোন করলে টেলিফোন ধরেন না। তাদের একজন (দেশ টিভির আসাদুজ্জামান নূর, নেতা এবং অভিনেতা) জার্মানি গিয়ে বসে রইলেন। মনে হয় আমার ভয়েই পালিয়ে যাওয়া।
এমন অবস্থায় তারানগরের ম্যাজিক মুনশি মাথায় থাকে না। থাকার কথাও। এই সময় মুনশি সাহেবের চিঠি পেলাম। চিঠি পেয়ে শুরুতে চমকালাম, কারণ আমি তাকে ঠিকানা দিয়ে আসি নি। চমকানো স্থায়ী হলো না। তাকে যে উপন্যাসটি দিয়ে এসেছিলাম সেই উপন্যাসের প্রকাশকের ঠিকানায় চিঠি এসেছে। মুনশি সাহেব কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে ঠিকানা বের করেন নি।
তিনি লিখেছেন–
শ্রদ্ধেয় স্যার হুমায়ূন আহমেদ সাহেব।।
আসসালামু আলায়কুম। জনাব, একটি বিষয় জানার জন্য আপনাকে পত্র লিখিয়াছি। আপনি আমাকে যে বইটি দিয়াছেন তা দ্বিতীয়বার পাঠ করিয়াছি। বইটির ঘটনা কতটুকু সত্য তা জানা আমার জন্য বিশেষ জরুরি।
আমার শরীর খুব খারাপ। এখন কিছুই খাইতে পারি। মসজিদের ইমামতি ছাড়িয়া দিয়াছি। এখন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই বিছানায় থাকি।
জনাব, বইটির ঘটনা সত্য কি না আপনি আমাকে অবশ্যই জানাইবেন। বিনিময়ে আপনাকে আমি অতি গোপন অতি রহস্যময় বিষয় জানাই। ইহা মৃত্যুপথযাত্রীর ওয়াদা।
সালাম।
ইতি মুনশি রইসুদ্দিন
ম্যাজিক মুনশির নাম যে রইসুদ্দিন তা প্রথম জানলাম। তাকে সেদিনই চিঠি পাঠালাম। চিঠিতে লিখলাম—
মুনশি রইসুদ্দিন
প্রিয়জনেষু,
ভাই আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনি অসুস্থ্য, কিছু খেতে পারছেন না জেনে খুব খারাপ লাগছে। আপনি চিঠি পাওয়া মাত্র ঢাকা আসার ব্যবস্থা করবেন। আপনার চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা আমি করব।
নলিনী বাবু B.Sc, বইটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বইটির গল্প বানানো। লেখকরা বিশ্বাসযোগাভাবে মিথ্যা গল্প লেখেন। তবে এই উপন্যাসে আমি যে প্যারালাল জগতের কথা লিখেছি বিজ্ঞান তা স্বীকার করে।।
আপনার শরীরের যে অবস্থা লিখেছেন তাতে আপনার পক্ষে একা ঢাকায় আসা সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
আমি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একজনকে পাঠাচ্ছি। সে আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। আপনি ভালো থাকবেন।
ইতি
হুমায়ূন আহমেদ
আমি নুহাশ চলচ্চিত্রের দুজন স্টাফকে আমার চিঠি সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।
তারা মহা উৎসাহে রওনা হলো।
অনেক দিন পর মুনশি বিষয়ে আমি নিজেও উৎসাহী হলাম। বিশেষ কিছু ক্ষমতা তার অবশ্যই আছে। এই ক্ষমতার উৎস কী?
তিনি যা দেখাচ্ছেন তা হলো আসল ম্যাজিক। এই ম্যাজিক অন্যভুবনের বাসিন্দাদের সাহায্যে করা হয়। পৃথিবীর কোনো ম্যাজিশিয়ানই তা স্বীকার করবেন না। বিজ্ঞান তো কখনোই না।
আমরা কিন্তু শৈশব থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের ভেতর বাস করি। শিশুর প্রথম যখন দাঁত পড়ে এই দাঁত ফেলা হয় ইঁদুরের গর্তে, যেন তার ইঁদুরের মতো দাঁত হয়। এখান থেকেই ম্যাজিকের শুরু। নজর কাটানোর জন্যে শিশুর মাথায় কালো টিপ দেওয়া হয়। এটাও ম্যাজিক।