কোনো এক ফাঁকে বইটির ১০৮ পৃষ্ঠার ৯ম লাইন দেখে রাখা মোটেই কঠিন কর্ম না।
অতি বিস্ময়কর একটি জাদুর কথা এখন বলি।
প্রাচীন বইপত্রে পাওয়া যায়—মিশরের জাদুকর Dedi একটি বিশেষ খেলা দেখিয়ে ফেরাউনদের বোকা বানিয়েছিলেন। তিনি দুটা হাঁস নিয়ে খেলাটা দেখাতেন। একটি ছিল ধবধবে সাদা, অন্যটি কুচকুচে কালো। জাদুকর দেদি মন্ত্র পাঠ করা মাত্র সাদা হাঁসটির মাথা চলে যেত কালো হাসে। কালো হাঁসটির মাথা যেত সাদা হাঁসে। হাজার হাজার বৎসর এই জাদুর কৌশল অজ্ঞাত ছিল।
১৯৩৫ সনে আমেরিকান জাদুকর নিজের চেষ্টায় জাদুর কৌশল বের করে ফেলেন। নিউইয়র্কের রঙ্গমঞ্চে জাদুটা দেখানো হয়। জাদুকরের নাম ডেভিড। তিনি ছদ্মনাম Fu Manchu ব্যবহার করতেন। তাঁর সাজপোশাক ছিল চীনাদের মতো।
Fu Manchuকে বিশ্বের সেরা জাদুকরদের একজন ধরা হয়। হাঁসের মাথা বদলের জাদুর কৌশলটা আমার জানা আছে। কৌশল ব্যাখ্যা করলে বিস্ময়বোধ নষ্ট কন্যা হবে। তা ঠিক না।
মুনশির জন্যে অপেক্ষা করছি
মুনশির জন্যে অপেক্ষা করছি। এশার নামাজ শেষ করতে সময় লাগবে। মুনশি মানুষ, নামাজ শেষ করে জিকিরে বসবেন। তাতে সমস্যা নেই। আমার হাতে অনেক সময়। রান্না শেষ হতে দেরি হবে। আমার সম্মানে (!) খাসি জবেহ করা হয়েছে। রান্না শেষ হতে সময় লাগারই কথা। ডিজেলের সন্ধানে যে গেছে সে এখনো ফিরে নি। ফিরলেও লঞ্চ রাতে রওনা হবে না।
আমি মুনশির বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। গ্রামের মানুষ অতিরঞ্জন পছন্দ করে। তাদের কাছে কাউকে বৃহস্যময় মনে হলে তার উপর অতিরিক্ত বানানো রহস্যময়তা আরোপ করা হয়। আমাদের মধ্যে রহস্যময়তা নেই বলেই আমরা অন্যের উপর রহস্যময়তা আরোপ করতে পছন্দ করি।
প্রাইমারি স্কুলের জনৈক শিক্ষক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমাকে দেখে তিনি খুব হতাশ হলেন। তিনি শুনেছেন অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি নায়িকা নিয়ে এসেছেন। তার হতাশ হওয়ারই কথা। মুনশি-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হলো। তিনি সব প্রশ্নের জবাব দিলেন কঠিন সিলেটি ভাষায়। এই ভাষা বোঝার সাধ্য আমার নেই। ইন্টারপ্রেটার হিসাবে সর্পরাজ সাহায্য করল।
কথোপখন
আমি : মুনশি সাহেব লোক কেমন?
উত্তর : (দার্শনিক উত্তর পাওয়া গেল। গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত হোন বা অশিক্ষিত হোন, দার্শনিক কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন। মানুষের ভালোমন্দ বুঝা কঠিন। যে ভালো তার মধ্যেও থাকে মন্দ। যে মন্দ তার মধ্যে থাকে কিছু ভালো।
আমি : মুনশির ম্যাজিক দেখেছেন?
উত্তর : এক দুইবার দেখেছি। তবে দেখা ঠিক না। কুফরি কালামের সাহায্যে এইসব করা হয়। কুফরি কালাম যে ব্যবহার করে সে কবিরা গুনাহ করে। যে দেখে সেও কবিরা গুনাহ করে।
প্রশ্ন : যে কবিরা গুনাহ করছে তাকে মসজিদের ইমাম করে রেখেছেন কেন?
উত্তর; অত্যন্ত জ্ঞানীর মতো একটা প্রশ্ন করেছেন। এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেব, নাম আবদুল খালেক। হজ করেছেন দুইবার। উনি মুনশিকে অত্যধিক পছন্দ করেন বিধায় কিছু করার উপায় নাই।
প্রশ্ন : অতিরিক্ত পছন্দ করেন কেন?
উত্তর : আছে ঘটনা। আপনি বিদেশি মানুষ। আপনার কাছে সব প্রকাশ করা ঠিক না। লোকমুখের রটনা—খালেক সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে মুনশির লটরপটর।
প্রশ্ন : মুনশি কি বিবাহ করেছেন?
উত্তর : আমার জানামতে না। তবে অনেকেই বলে এক পরীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে।
প্রশ্ন : ডানা আছে এ রকম পরী?
উত্তর : জ্বিনদের মধ্যে যারা নারী তাদেরকে পরী বলে। সে স্ত্রী-জাতীয় একটা জ্বিন বিবাহ করেছে। তার স্ত্রী মাঝে মধ্যে আসে, কিছুদিন থেকে চলে যায়।
প্রশ্ন : কেউ কি তাকে দেখেছে?
উত্তর : কয়েকজন দেখেছে। জিনের আনাগোনার কারণে আমাদের অঞ্চলে কোনো পাখি নাই। গাছগাছালি থাকলেই পাখি থাকবে এটা জগতের নিয়ম। আমাদের অঞ্চলে কোনো পাখি নাই।
প্রশ্ন : আমি কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় প্রচুর পাখির ডাক শুনেছি।
উত্তর : দুই একটা পাখি ভুলক্রমে চলে আসে। যখন ঘটনা বুঝতে পারে তখন পালায়া যায়।
প্রশ্ন : পাখিরা জ্বিনদের ভয় পায়? উত্তর : জি। পাখির হাড় হলো জ্বিনের খাদ্য।
প্রশ্ন : ভাই, আপনার সঙ্গে কথা বলে অত্যন্ত আরাম পেয়েছি। এখন বাড়িতে যান। বিশ্রাম করুন।
স্কুলশিক্ষক আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বাড়িতে চলে যাব কেন? আরজু সাব (সর্পরাজ) আপনার সঙ্গে রাতের খানা খাওয়ার জন্য আমাকে দাওয়াত করেছেন।
আমি বললাম, তাহলে তো অবশ্যই থাকবেন।
সর্পরাজ বলল, স্যার চাঁদ উঠেছে। বাইরে বড়ই সৌন্দর্য। আপনি কি ডেকে বসে চাদের আলোর সৌন্দর্য দেখবেন?
আমি বললাম, না। তুমি মাস্টার সাহেবকে নিয়ে যাও। রাতে খেতে যখন দেরি হবে উনাকে চা-নাস্তা খাওয়াও।
সর্পারাজ বিদায় নেওয়ার পরপর নুহাশপল্লীর ম্যানেজার উপস্থিত হলো। তার পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। চোখে সুরমা। হাতে তসবি।
আমি বললাম, তোমার সমস্যা কী?
ম্যানেজার বলল, মিলাদ হবে স্যার। মিলাদের পর শোকরানা নামাজ। তারপর দোয়া। হাজি একরামুল্লাহ সাহেব এসেছেন। দোয়া উনি পড়াবেন।
হাজি একরামুতুল্লাহ সাহেব কে?
বিশিষ্ট আলেম। ম্যাজিক মুনশি যেখানে যায় উনি সেখানে যান না।। আপনার কথা শুনে এসেছেন।
শুনে খুশি হলাম। সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয় সেটা দেখো। আমার প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা। আমি শুয়ে থাকব।