কবি বললেন, দশ কপি বই নিয়ে এসেছিলাম। কাড়াকাড়ি করে সবাই নিয়ে গেছে। এটা লাস্ট কপি বলে আপনাকে দিতে পারছি না। তবে দাদা, আমি সবগুলি কবিতা আপনাকে পড়ে শোনাচ্ছি।
আমি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কবি এবং কবিতার হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা আমি করেই রেখেছিলাম। সেই পথে অগ্রসর হলাম। আমি বললাম, আপনার সব কবিতা আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনব। প্রথমে যে-কোনো একটা ফুলের নাম বলুন।
কবি বললেন, গোলাপ।
আপনার কবিতার বইটির দিকে তাকান তো।
ভদ্রলোক চমকে তাকালেন এবং দেখলেন তার কবিতার বইয়ের উপর একটা টকটকে লাল গোলাপ।
হতভম্ব কবি বললেন, দাদা! কীভাবে করলেন?
আমি বললাম, আবার তাকান। ভদ্রলোক তাকালেন এবং দেখলেন লাল গোলাপ না, কালো গোলাপ।
দাদা! এটা কীভাবে করলেন? হিপনোটিজম নাকি মেসমেরিজম?
আমি বললাম, আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে আপনি বরং কবিতার বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকুন।
ভদ্রলোক তাকালেন এবং দেখলেন বইয়ে কোনো গোলাপ নেই। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, হে ভগবান।
আমি বললাম, আমি পাঁচ মিনিটের বেশি কারও সঙ্গেই কথা বলি না। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। আপনি চলে যান।
গোলাপ ফুল কোথায় গেল?
আমি বললাম, লাল এবং কালো গোলাপ দুটি গোলাপই আপনার কাপড়ের ব্যাগে থাকার কথা।
ভদ্রলোক ব্যাগ খুলে দুটা গোলাপ পেয়ে গেলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ ভীত চোখে তাকিয়ে অতি দ্রুত বিদায় নিলেন। তিনি শেষ কপি শিশিরভেজা বিষের শিশি সঙ্গে নিতে ভুলে গেলেন।
অতি জটিল এই জাদু কীভাবে দেখানো হলো তা এখন ব্যাখ্যা করি। প্রিয় পাঠক! দীর্ঘ দিনের প্র্যাকটিস ছাড়া এই জাদু দেখাতে যাবেন না। ধরা খাবেন এবং অপমানিত হবেন। সেধে বাড়িতে অপমান নিয়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা না।
জাদুবিদ্যার অতি সাধারণ একটি কৌশল এই জাদুতে ব্যবহার করা হয়েছে। কৌশলটার নাম মিসডিরেকশন (Misdirection}, এর কোনো বাংলা নেই। দৃষ্টিভ্রান্তি বলা যেতে পারে।
একজন জাদুকর যখন জাদু দেখান দর্শক তার চোখ এবং হাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। জাদুকর যদি ছাদের দিকে তাকান, দর্শকরা ছাদের দিকে তাকাবেন। এর অন্যথা হবে না। দর্শকরা ছাদের দিকে তাকানো মাত্র misdirection তৈরি হলো। এই সময় জাদুকর তার হাত দিয়ে যা করেন দর্শক দেখবে না। জাদুকর দর্শকদের misdirection পথে চালনা করলেন।
আমি কবি সাহেবকে ম্যাজিক দেখানোর প্রস্তুতি নিয়েই বসেছিলাম। আমার পেছনে ছিল একটা লাল গোলাপ এবং একটা কালো গোলাপ। কবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বা দিকের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালাম। কবিও তাকালেন। এই ফাঁকে আমি তার কবিতার বইয়ের উপর লাল গোলাপ রেখে দিলাম। ম্যাজিকের বাকি অংশ এখন নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। সবই মিসডিরেকশনের খেলা।
সাধারণত দেখা যায় অতি রহস্যময় ম্যাজিকের কৌশল খুবই সাধারণ। অকৃবর লেখা জাদুকাহিনী থেকে উদাহরণ দিচ্ছি।
জনৈক খ্রিষ্টান পাদ্রি সন্ধ্যাবেলা ইভিনিং ওয়াকে বের হতেন। বয়সের কারণে তাঁর সঙ্গে থাকত লাঠি (walking stick}, তিনি ছিলেন অঞ্চলের সবার অতিপ্রিয় শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। তিনি মাঝে মধ্যেই কোনো এক বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলতেন, পাত্রে তেল গরম করো। তেল যখন টগবগ করে ফুটত, তখন তিনি তার হাতের লাঠিটা তেলে ছোঁয়াতেন। সঙ্গে সঙ্গে পাত্রে একটা ডিমপোচ কিংবা অমলেট তৈরি হতো। মানুষের বিস্ময়ের সীমা থাকত না।
এই ম্যাজিকের মূল কৌশল লাঠির মাথায়। লাঠির মাথা ফাঁপা। সেখানে অমলেট বা ডিমপোচ করার জন্যে খোসা ছড়ানো ডিম ভরা থাকত। লাঠির মাথা থাকত মোম দিয়ে আটকানো।
গরম তেলে লাঠির মাথা রাখা মাত্র মোম গলে ডিম বের হয়ে আসত। তৈরি হতো অলৌকিক ডিমের অমলেট বা ডিমপোচ।
ওল্ড ফুলস ক্লাবেরু এক ম্যাজিক আসরের কথা বলি। ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন গোলাম মুরশিদ সাহেব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন কালো বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক শফি আহমেদ (গাত্রবর্ণের কারণে তাকে আমরা কালো বুদ্ধিজীবী বলি। তাঁকে ছোট করার জন্য না। শ্রীকৃষ্ণকেও কালো কৃষ্ণ বলা হয়। প্রকাশক আলমগীর রহমান আছেন। সুইডেনের লম্বু মাসুদ আছে। আমি আছি। কালো বুদ্ধিজীবী এবং গোলাম মুরশিদ সাহেব কঠিন সাহিত্য আলাপ শুরু করলেন। সাহিত্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য বললাম, আসুন আপনাদের একটা ম্যাজিক দেখাই। কাগজ কলম হাতে নিন।
গোলাম মুরশিদ কাগজ কলম হাতে নিলেন।
তিন ডিজিটের যে-কোনো একটা সংখ্যা লিখুন।
গোলাম মুরশিদ লিখলেন ৬৪১।
আমি বললাম, এটাকে উল্টে লিখুন (Reverse).
গোলাম মুরশিদ লিখলেন ১৪৬।
আমি বললাম, দুটোর বিয়োগফল বের করুন। বড়সংখ্যা থেকে ছোটটি বাদ দিন।
বাদ দিলেন। পাওয়া গেল ৪৯৫।
আমি বললাম, এই সংখ্যাটি আবার Reverse করুন। এবং এই দুটি সংখ্যা যোগ করুন।
৪৯৫+৫৯৪=১০৮৯
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে যে বইটি আছে (Minority Report) তার ১০৮ পৃষ্ঠা বের করুন। কারণ আপনার যোগফলের প্রথম তিনটি ডিজিট হলো ১০৮। তিনি তা-ই করলেন। আমি বললাম, আপনার পরের সংখ্যাটি ৯। কাজেই ১০৮ পৃষ্ঠার নবম লাইনটি বের করুন। নবম লাইন শুরু হয়েছে Head শব্দটি দিয়ে। পরীক্ষা করুন।
উপস্থিত সবাই চমকৃত হলেন। চমৎকৃত হওয়ারই কথা। কৌশলটা এবার ব্যাখা করি। অংকের নিয়ম অনুযায়ী যে যোগ-বিয়োগ করা হলো তার শেষ উত্তর সবসময় হবে ১০৮৯। যে-কোনো তিন সংখ্যা নিয়ে করলেই একই উত্তর (তিনটি সংখ্যা আলাদা আলাদা হতে হবে)।