যেসব বিদেশী পর্যটক ভারতবর্ষে এসেছিলেন, মার্কোপোলো (Marco Polo} তাঁদের একজন। তিনি কাশ্মিরের এক জাদুকরের কথা লিখেছেন, যিনি আবহাওয়া পরিবর্তন করতে পারতেন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনকে অন্ধকার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, যা মার্কোপোলো নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। (মার্কোপোলো তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে অনেক আজগুবি কথা লিখে গেছেন। তাঁর বক্তব্য বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁর আজগুবি কাহিনীর উদাহরণ : আন্দামানে তিনি একদল মানুষ দেখেছেন, যাদের মুখ কুকুরের মতো। আচার-আচরণও কুকুরের মতো। তার প্রকাশ্যে যৌনক্রীড়া করে।
আবহাওয়া পরিবর্তনকারী জাদুকর এই বাংলাদেশে কিন্তু এখনো আছে। শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষায় তাদের ব্যবহার করা হয়। তারা ফকির নামে পরিচিত। এমন একজনের সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে। তিনি কিছু মন্ত্র বলেছেন, যা আমি ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। আমার স্মৃতিশক্তি মোটামুটি ভালো হলেও বৃতিশক্তি একেবারেই নেই। ডায়েরি হারিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রের প্রথম দুটি লাইন মনে আছে—আলী কালী লালী ত্রিভুবন খালি। মন্ত্রের আলী কি হযরত আলী (রঃ)? কালী কি হিন্দু দেবী? আমি জানি না। লালী কি খালির সঙ্গে মিল দেওয়ার জন্য?
মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনীতে ভারতীয় জাদুকরদের অদ্ভুত সব জাদুর কথা আছে। শূন্যে ভেসে থাকা তার একটি। ইবনে বতুতা একবার জাদু দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন এই তথ্যও উল্লেখ আছে।
আমারও একবার ম্যাজিক দেখে জ্ঞান হারাবার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শৈশবের গল্প। থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। সুযোগ পেলেই একা একা শহরে হেঁটে বেড়াই। মূল আকর্ষণ সিনেমা হলের পোস্টার। একদিন দিলশাদ সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখি ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে। অদ্ভুত ম্যাজিক। কাঠের এক তার সঙ্গে গা লাগিয়ে দুহাত যীশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ ভঙ্গিতে তুলে এক মায়াকাড়া চেহারার বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরীটির দশ-বার ফুট দূরত্বে চোখ বাঁধা অবস্থায় ম্যাজিশিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতভর্তি চুরি।
তিনি বালিকাটির দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুরি ছুড়ে মারছেন। ছুরি বালিকার গা ঘেঁষে বিধে যাচ্ছে, বালিকাটির গায়ে লাগছেন না। তাকে ঘিরে ছুরির বলয় তৈরি হলো। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ম্যাজিক।
সেদিনই আমি প্রথম ম্যাজিকের প্রেমে পড়ি। ছুরি ছুড়ে মারার এই ম্যাজিকের কৌশল খুব সাধারণ। সব ছুরি কাঠের তক্তার পেছনে স্প্রিং দিয়ে লাগানো। ছুরিগুলি পেছন থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। দেখে মনে হয় ম্যাজিশিয়ানের হাতের ছুরি কাঠে বিধছে। আসলে তা-না। দর্শকদের দৃষ্টি মেয়েটির দিকে থাকে বলেই ম্যাজিশিয়ান তার হাতের ছুরি কীভাবে সরাচ্ছেন তা কেউ দেখেন না।
বাবার কাছে গণপতি নামের এক বাঙালি জাদুকরের অদ্ভুত ম্যাজিকের কথা শুনেছি। বাবা তার জাদু দেখেছেন কমলা সার্কাসে। বাবার ভাষ্যমতে, গণপতির জাদু যে না দেখেছে তার জীবন বৃথা। পিসি সরকারের অবস্থান গণপতি বাবুর হাঁটুর নিচে।
জাদুকর গণপতি সম্পর্কে আমি তেমন কোনো তথ্য জোগাড় করতে পারি নি। তিনি জমিদারপুত্র ছিলেন এই তথ্য পেয়েছি। শখের বসে জাদু শিখেছেন। অসম্ভব খেয়ালি মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গেই তার বনত না।
স্যারের অবস্থা কী? একা বসা। মুনশি গেল কই?
গোপাল জর্দার প্রবল গন্ধ নিয়ে আরজু ঢুকল।
আমি বললাম, মুনশি এশার নামাজ পড়াতে গিয়েছেন। নামাজ শেষ করে আসবেন। তিনি আমাকে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে গেছেন। গোলাপ ফুলে কোনো গন্ধ পাচ্ছি না। তুমি গন্ধ পাও কি না দেখো তো।
সর্পরাজ নানান ভঙ্গিমায় গোলাপ শুকতে লাগল। জর্দার কড়া গন্ধ ছাপিয়ে গোলাপের হালকা সৌরভ তার নাকে যাওয়ার কথা না। তবু সে চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
ইউরোপ-আমেরিকার চাষের গোলাপে কোনো গন্ধ থাকে না। দেখতে অপূর্ব সুন্দর কিন্তু গন্ধহীন।
সর্পরাজের হাতের গোলাপটা তা-ই। গন্ধহীন। গ্রামের গোলাপ গাছের গোলাপে গন্ধ থাকতেই হবে। গন্ধ নেই কেন?
গোলাপ নিয়ে আমি একবার এক জাদু দেখিয়ে জনৈক দর্শকের মাথা নষ্ট করে দেওয়ার জোগাড় করেছিলাম। দর্শক ভারতীয়। কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। নিজেও কবিতা লিখেন। বাংলাদেশে এসেছেন জাতীয় কবিতা উৎসবে কবিতা পাঠ করার জন্যে। আমার কিছু উপন্যাস তিনি দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় পড়েছেন। আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা। আমার অতি অপছন্দের বিষয় সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। ওল্ড ফুলস ক্লাব নামে আমাদের যে আডড্রার ক্লাব আছে সেখানে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
দুজন মুখোমুখি বসেছি। আমি যথেষ্টই বিরক্ত। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না তিনি সহজে উঠবেন। কাঁধের ঝুলি থেকে চটি এক কবিতার বই বের করে বললেন, দাদা, আমার নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থ। নাম দিয়েছি শিশিরভেজী বিষের শিশি। নামটা কেমন হয়েছে?
আমি বললাম, খুব সুন্দর হয়েছে। মনে মনে বললাম, ছাগল কোথাকার!
কবি বললেন, নামের শুরু হয়েছে শিশি দিয়ে, শেষও হয়েছে শিশিতে।
আমি বললাম, অদ্ভুত। মনে মনে বললাম, বাচ্চাদের পিসাবকে শিশি বলে। তুই শুরু করেছিস পিসাব দিয়ে শেষও করেছিস পিসাব দিয়ে।
কবি বললেন, বিষের শিশিতে শিশির মাখিয়ে আমি এক ধরনের কোমলতা আরোপ করেছি।
আমি বললাম, খুব ভালো করেছেন। কঠিন পৃথিবীতে কোমলতার প্রয়োজন আছে।