এই লোকটির ম্যাজিক কোন পর্যায়ের? প্রাচীন ম্যাজিক দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছিল। একটিকে বলা হতো আসল ম্যাজিক। অন্যটিকে বলা হতো ভোজবাজি বা নকল ম্যাজিক।
ভোজবাজি শব্দটা এসেছে মালব দেশের রাজা ভোজরাজার কাছ থেকে। তিনি হাতসাফাই-এর খেলায় একজন গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন। ভোজরাজ মাসে একবার প্রজাদের আনন্দ দেওয়ার জন্যে জাদুর খেলা দেখাতেন। রাজার একমাত্র মেয়ে ভানুমতি খেলা দেখানোয় বাবাকে সাহায্য করতেন। এই কারণেই জাদুবিদ্যার আরেক নাম ভানুমতির খেলা। আমাদের দেশের বেদিনীরা ভানুমতির খেলা নাম দিয়েই ম্যাজিক দেখায়।
ভারতের রোপ ট্রিককে আসল ম্যাজিকের পর্যায়ে ফেলা হয়। এই ম্যাজিকে জাদুকর তার সন্তান এবং এক গাছ দড়ি হাতে নিয়ে উপস্থিত হন।
ম্যাজিক শুরু হওয়ার পর দড়ি আপনাআপনি শূন্যে উঠে স্থির হয়ে যায়। তখন জাদুকরপুত্র দড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। অনেকদূর উঠে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর ম্যাজিশিয়ান ধারালো তলোয়ার কামড়ে ধরে দড়ি বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর জাদুকরপুত্রের আর্তনাদ শোনা যায়। তার শরীরের কাটা অংশ একে একে শূন্য থেকে নিচে পড়তে থাকে। দর্শকরা আতংকে অস্থির হয়ে পড়েন। তখন জাদুকর দড়ি বেয়ে নেমে আসেন। পুত্রের শরীরের খণ্ড খণ্ড অংশগুলি ঝুড়িতে ভরে, ঝুড়ি চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জাদুকরপুত্র চাদর সরিয়ে বের হয়ে আসে। এই দড়ির ম্যাজিকের অনেক ভেরিয়েশন আছে, তবে মূলটা এক।।
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এই খেলা দেখেছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরনামায় তার চমৎকার বর্ণনা লিখে গেছেন। সম্রাট বানিয়ে বানিয়ে জাদুকরের খেলা নিয়ে লিখবেন তা মনে হয় না।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজসভায় (সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ) ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত Sir Tomas Roe নিজেও ছিলেন। তিনিও তার আত্মজীবনীতে বোপ ট্রিকের কথা লিখে গেছেন। তাঁর লেখায় একটি মজার তথ্য আছে। যে সাতজন জাদুকর সেদিন রাজসভায় অদ্ভুত সব জাদু দেখিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন বাঙালি। Sir Jomas Roe-র ভাষায় Seven Bengali jugglers।
সম্প্রতি আমার হাতে একটি বই এসেছে (জাদুবিদ্যার মাধ্যমে আপনাআপনি আসে নি, আমি নিউইয়র্ক থেকে কিনেছি), নাম The Rise of the Indian Rope Trick. লেখকের নাম Peter Lamort।
লেখক ২৫০ পৃষ্ঠার বই লিখে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন রোপ ট্রিক নামের কোনো কৌশল ভারতবর্ষে ছিল না। পুরো বিষয়টি কল্পনাবিলাসী ব্রিটিশদের বানানো।
আমি বইটির যুক্তির সঙ্গে একমত হব কি না বুঝতে পারছি না। অকারণে অদ্ভুত এক জাদু নিয়ে মিথ তৈরি হয় না।
জুয়েল আইচের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। তিনিও Peter Lamon এর সঙ্গে একমত। তারও ধারণা এটা মিথ। সাধারণ মানুষ মিথ তৈরি করতে ভালোবাসে বলেই মিথ তৈরি হয়। জাদুকর পি সি সরকারকে নিয়েও
এরকম একটা মিথ আছে। মিথটা এরকম—
হলভর্তি দর্শক। সাতটার সময় শো শুরু হওয়ার কথা। পি সি সরকার আসছেন না। তিনি এক ঘণ্টা পর রাত আটটায় উপস্থিত হলেন।
দর্শকরা চেঁচাচ্ছে, এক ঘণ্টা লেট। এক ঘণ্টা লেট।
পি সি সরকার বললেন, লেট হব কেন? আপনারা ঘড়ি দেখুন। সবাই দেখল, তাদের প্রত্যেকের ঘড়িতে সাতটা বাজে।
বলা হয়ে থাকে ঘড়ির এই মিথ ছড়ানোর পেছনে পি সি সরকারের নিজের ভূমিকা আছে। এই মিথ ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে তার উপর চড়াও হয়েছিল। গল্পটা বলা যেতে পারে।
পি সি সরকার রঙ্গমঞ্চে জাদু দেখাচ্ছেন। হলভর্তি মানুষ। হঠাৎ দর্শকদের একজন বলল, আমরা ঘড়ির ম্যাজিকটা দেখতে চাই।
পি সি সরকার ভান করলেন যেন শুনতে পান নি। তিনি তাঁর জাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন। দর্শকদের গুঞ্জন শুরু হলো। এক পর্যায়ে সব দর্শকই বলল, আমরা ঘড়ির জাদু দেখব। অন্য জাদু না।।
পি সি সরকারকে জাদু প্রদর্শনী বন্ধ করতে হলো।
মিথ হিসেবে পরিচিত ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিকে ফিরে যাই। লাসভেগাসের এক জাদু অনুষ্ঠানে আমি ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক দেখেছি। জাদুকরের নাম মনে নেই। চমৎকার llusion। স্টেজে জাদু দেখানো আর পথেঘাটে জাদু দেখানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক পথেঘাটে দেখানো হতো।
আমার দাদাজান মৌলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ দাবি করেন দড়ির জাদুর এই খেলা তিনি শম্ভুগঞ্জের হাটের দিন অনেকের সঙ্গে দেখেছেন। দাদাজান মাদ্রাসার শিক্ষক, কঠিন মৌলানা। মিথ্যা কথা তিনি বলবেন তা কখনো হবে না। তারপরও আমার ধারণা তিনি মিথ্যা বলেছেন। এই ধারণার পিছনে কারণ ব্যাখা করি।
দাদাজান গল্প করেছেন আমার সঙ্গে। আমার বয়স তখন পাট কিংবা ছয়। শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বানিয়ে গল্প বলা যেতে পারে। তিনি আমার সঙ্গে একদিন মৎস্যকন্যা দেখার গল্পও করলেন। জেলেদের জালে এক মৎস্যকন্যা ধরা পড়ল। তার কোনো হাত নেই। গাত্রবর্ণ নীল। সে শুশুকের মতো ভোঁস ভোস শব্দ করছিল। মৎস্যকন্যা বলে কিছু নেই। কাজেই মৎস্যকন্যার গল্পটি বানানো। যিনি একটি বানানো গল্প করতে পারেন তিনি আরও বানানো গল্প করতে পারেন।
বাকি থাকল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী। এই সম্রাট ডুবে থাকতেন মদ, আফিং এবং চরসের নেশায়। নেশাগ্রস্ত একজন মানুষ কী দেখতে কী দেখেছেন কে জানে!
প্রাচীন ভারত ছিল জাদুবিদ্যারই দেশ। বেদেরা জাদু দেখাত, সাধুসন্ন্যাসীরা জাদু দেখাতেন। জাদুর দেশ কামরূপ কামাক্ষা নিয়ে গল্পগাঁথা এখনো চালু।