- বইয়ের নামঃ ম্যাজিক মুনশি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ঘেটুপুত্র কমলা নামের একটা ছবি বানাব
ম্যাজিক মুনসি
উৎসর্গ
জুয়েল আইচ
জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্টজয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। ইনি নামতে ভুলে গেছেন।
ভূমিকা
ম্যাজিক মুনশিকে কি উপন্যাস বলা যাবে?
উপন্যাস বললে প্রকাশকের সুবিধা হয়। পাঠকরা উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন। সমস্যা হচ্ছে ম্যাজিক মুনশিকে কোনো পর্যায়েই ফেলা যাচ্ছে না। ম্যাজিক মুনশি হলো রহস্যময়তার বর্ণনা এবং কিছুটা বিশ্লেষণ। উপন্যাসের কাঠামো অবশ্যি ব্যবহার করা হয়েছে।
এই লেখায় আমি কাউকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছি না। আমি নিজে বিভ্রান্ত মানুষ কোনোকালেই ছিলাম না, কাজেই নিজের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। তবে আমি সচেতনভাবেই জগতের রহস্যময়তার প্রতি ইঙ্গিত করেছি। এই অধিকার আমার আছে।
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, ম্যাজিক মুনশি বইটি দুবার পড়বেন। প্রথমপাঠের অস্পষ্ট বিষয়গুলি দ্বিতীয়পাঠে স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। বইয়ে বর্ণিত কৃষ্ণশক্তি আহ্বানের ধারেকাছেও কেউ যাবেন না। মানব মস্তিষ্ক অতি বিচিত্র কারণে সাজেশনে বশীভূত। Trance অবস্থায় মস্তিষ্কের বিচিত্র কার্যকলাপের দিকে যেতে পারে। অকারণ হেলুসিনেশনের শিকার হওয়া হবে বিরাট মূর্খামি।।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী
০১.
ঘেটুপুত্র কমলা নামের একটা ছবি বানাব। পুরনো রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। বাড়ির ভেতর নাচঘর থাকতে হবে। টানাবারান্দা থাকতে হবে। বড় দিঘি লাগবে, শ্বেতপাথরের ঘাট থাকতে হবে। দিঘিভর্তি পদ্ম লাগবে। যদি থাকে এখনই লাগাতে হবে। পদ্মগাছ বৈরী অবস্থাতেও ভালো থাকে।
বাংলাদেশের মানুষ পরামর্শ দিতে পছন্দ করে। অনেক পরামর্শদাতা জুটে গেল। একজন বলল, আপনি যেরকম চাচ্ছেন, অবিকল সেরকম বাড়ি একটা আছে মির্জাপুরে। এই বাড়ি আগে কেউ ব্যবহার করে নি। নাচঘরের দেয়ালে কাচ লাগানো। মেঝে কাঠের। কিছু কিছু কাঠ নষ্ট হলেও যা আছে তা-ই যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, দিঘিভর্তি পদ্মফুল। ঘাট আছে কি না মনে করতে পারছি না। থাকার কথা।
ভদ্রলোকের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলাম। বাড়ি বলে কিছু নেই, ইটের স্তূপ। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। স্থানীয় এক ভদ্রলোক বললেন, ওদিকে যাবেন না স্যার। সাপের আস্তানা।
আমি বললাম, দিঘি কোথায়?
ভদ্রলোক বললেন, একসময় দিঘি ছিল। এখন ভরাট হয়ে গেছে।
মেজাজ খারাপ করে ফিরলাম। এরপর থেকে কেউ বাড়ির সন্ধান দিলে নিজে যাই না। নুহাশ চলচ্চিত্রের একজনকে ক্যামেরা দিয়ে পাঠিয়ে দেই। সে ছবি তুলে নিয়ে আসে। ছবি দেখে হই হতাশ। অ্যাসিসটেন্টের যাতায়াত খরচের বিল দেখে হই চমৎকৃত। একটি যাতায়াত বিলের নমুনা–
মাইক্রোবাস ভাড়া ৫,০০০ টাকা স্পিডবোট ভাড়া ৪,০০০ টাকা খাওয়াদাওয়া ৩,০০০ টাকা হোটেল ভাড়া ৭,০০০ টাকা পানি ৩,০০০ টাকা সর্বমোট ২২,০০০ টাকা মাত্র
আমি বললাম, সোনারগাঁ হোটেলের এক রাতের ভাড়া ৭০০০ টাকার কম। তোমার হোটেল বিল এত কেন?
অ্যাসিসটেন্ট বলল, রুম তো স্যার একটা নেই নাই। তিনটা নিয়েছি।
তিনটা কেন?
ঢাকা থেকে আমরা চারজন গিয়েছি। স্থানীয় যে মেম্বার সাহেব আমাদের স্পট দেখাবেন তিনিও আমাদের সঙ্গে হোটেলে ছিলেন। তার জন্যেও রুম নিতে হয়েছে।
পানি তিন হাজার টাকা-ঝলাম না। তিন হাজার টাকার পানি খেয়ে ফেলেছ?
মেম্বার সাহেব খেয়েছেন।
মেম্বার সাহেব এক রাতে নি হাজার টাকার পানি খেয়ে ফেলেছেন?
সাধারণ পানি না স্যার। পাগলাপানি। মেম্বার সাহেবের সন্ধ্যার পর পাগলাপানি খাওয়ার অভ্যাস।
শেষ পর্যন্ত ভিডিও দেখে একটা বাড়ি পছন্দ হলো। সুখিয়া জমিদারবাড়ি। নাচঘর আছে। ঘাট আছে। টানা বারান্দা আছে। অতি দুর্গম জায়গা। সুনামগঞ্জ থেকে লঞ্চে চারঘণ্টা যেতে হয়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চার কিলোমিটার।
ভিডিও ছবি দেখে লোকে পছন্দ করা কোনো কাজের কথা না। আমি ঠিক করলাম নিজে গিয়ে দেখব।
পাঠকদের জানাতে লজ্জা বোধ করছি, আমার যাত্রা উপলক্ষে সাজসাজ রব পড়ে গেল। সাজসাজ রবের কারণে আমার সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা। যেমন, একদল বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারি না। বিশেষ ধরনের চিকন চাল ছাড়া খেতে পারি না। খাওয়ার সময় অনেকগুলি পদ লাগে। খাওয়ার পানি হতে হয় বরফশীতল। রাতে গানবাজনার ব্যবস্থা থাকতে হয়। রাতে এসি ছাড়া ঘুমাতে পারি না। মাঘমাসের শীতেও এসি লাগে। তখনো ঘর হিমশীতল করে আমি নাকি ডাবল লেপের ভেতর ঢুকে থাকি। ইত্যাদি।
ব্যাপার মোটেই সেরকম না। আমি যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। আমার প্রয়োজন কিছু R।RM থাকলে কিছু লাগবে না। পাঠকদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন RM হলো মেম্বার সাহেবের পাগলাপানি। তা-না, RM হলো Reading Material. পড়ার বই। প্রতিদিনই নিয়ম করে আমাকে কিছু পড়তে হয় না পড়লে অসুস্থ বোধ করি।
Aisac Asirnov এর Book of Facts এবং স্টিফেন কিং-এর ভূতের গল্পের কালেকশন (Skeleton Crew) ব্যাগে ভরে যাত্রার প্রস্তুতি নিলাম।
নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুলের উপর যাত্রার পুরো দায়িত্ব। সে এসে রিপোর্ট করল, সব ঠিক আছে। এসএ পরিবহনের আধুনিক এসি বাস ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাবে। সুনামগঞ্জ থেকে দোতলা লঞ্চ যাবে। একটা পোর্টেবল এসি পাওয়া গেছে। সিঙ্গার কোম্পানির এসি যাচ্ছে। এসি চালানোর জন্যে জেনারেটর যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা নিরাপত্তার জন্যে দুজন পুলিশ সদস্য দিচ্ছেন। নুহাশপল্লীর বাবুর্চি আর তার দুই অ্যাসিসটেন্ট যাচ্ছে। রান্নাবান্নার সব দায়িত্ব তাদের। টেপিবুড়ো আর কালিজিরা চাল কেনা হয়েছে। দলের অন্য সদস্যদের জন্যে মিনিকেট চলি। গানবাজনা করবে ইসলাম বয়াতির দল। যেদিন রওনা হব তার আগের দিন তারা নেত্রকোনা থেকে চলে আসবে। গায়ক সেলিম চৌধুরীও যাচ্ছেন।