বুঝলেন ভাইজান, ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বেন, লম্বা ঘুম দেবেন। ভূতের কথা মনে স্থান দেবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন–ভূতের বাস হচ্ছে মানুষের মনে। ভুল বললাম, আসলে মন বলেও কিছু নেই। যদিও আমরা কথায় কথায় মন বলি। আসল জিনিস হচ্ছে মস্তিষ্ক, দি ব্রেইন। ভূতের বাস হচ্ছে আমাদের ব্ৰেইনে, মস্তিষ্কে। আমাদের একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে .
আচ্ছা খেয়াল রাখব।
প্রয়োজনে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আপনাকে নিয়ে যাব। আমার বন্ধু মানুষ।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ভাইজান, কী বললাম মনে থাকবে তো?
হুঁ। মনে থাকবে।
রাতে তিনি ঘুমের ওষুধ খেলেন। ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি খেলেন। ওষুধ খাওয়ার আধা ঘণ্টা পর ঘুমুতে যাবার কথা, তার আগেই ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। খুব কড়া ওষুধ, বোঝাই যাচ্ছে। দুটা না খেয়ে একটা খেলেই হতো। তিনি বিছানায় গেলেন প্রায় চোখ বন্ধ করে। বালিশে মাখা রাখতে না রাখতেই তাঁর ঘুম কেটে গেল। চোখে এখন আর একফোঁটা ঘুম নেই। অবশ্য তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হতে লাগল যে তিনি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবে স্বপ্নে দেখছেন যে জেগে আছেন।
স্যার কেমন আছেন?
আখলাক সাহেব পোশ ফিরলেন। কিছু দেখা যায় কিনা। না কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারদিক ফাঁকা।
ঐ দিনের জন্যে স্যার খুবই লজ্জিত।
ঐ দিন কী হয়েছিল?
আপনি আমার লেখা পড়তে চাইলেন, আমার নিয়ে আসতে দেরি হলো। এসে দেখি আপনি আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। আর আপনাকে জোগালাম না। আপনার আবার সকালে ক্লাস থাকে। লেখা স্যার আজ নিয়ে এসেছি।
কোনটা এনেছ?
অনেকগুলি এনেছি।
তোমরা কি বাংলা ভাষাতেই লেখা?
আমরা স্যার বাঙালি ভূত। আমরা বাংলা ছাড়া কীসে লিখব?
ভূত-ভাষা বলে কিছু নেই তাহলে?
জি না।
কথা বলার সময় তোমরা শুধু চন্দ্ৰবিন্দু বেশি ব্যবহার কর, তাই না?
এটাও স্যার আপনাদের ভুল ধারণা। আপনারা ভূতের গল্প লেখার সময় ভূতের মুখে চন্দ্ৰবিন্দু দেন। ভূত বলে–আঁমারে মাছ দেন। এটা স্যার ঠিক না। কারো নাকে যখন সমস্যা থাকে তখন সে চন্দ্ৰবিন্দু ব্যবহার করে নাকে কথা বলে। আমাদের নাকই নেই।
তোমাদের নাক নেই নাকি?
জি না স্যার। আমরা তো আসলে বাতাসের তৈরি। বাতাসের আবার নাক কী? আমাদের সম্পর্কে আসলে আপনারা কিছুই জানেন না। না জেনেই গল্প লেখা হয়। অথচ আমাদের দেখুন–মানুষদের সম্পর্কে আমাদের প্রতিটি লেখার পেছনে আছে দীর্ঘ দিনের বিসার্চ। ইহা মানুষ প্ৰবন্ধটা লেখার জন্যে আমাকে দশ বৎসর নিরলস গবেষণা করতে হয়েছে।
বলো কী!
প্ৰবন্ধটা কি স্যার পড়ব?
পড়।
মানুষ হলো কুড়ি আঙ্গুল বিশিষ্ট প্রাণী। কুড়িটি আঙ্গুলের ভেতর সে মাত্র দশটির ব্যবহাব জানে। বাকি দশটি আঙ্গুল, যাদেব অবস্থান পাযে, তাদের ব্যবহার সে জানে না।
আখলাক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, পায়ের আঙ্গুলের আবার ব্যবহার কী?
অবশ্যই ব্যবহার আছে। প্রকৃতি আঙ্গুল দিয়েছে যখন তখন ব্যবহারও দিয়েছে। মানুষ তা জানে না, জানার চেষ্টাও করে না।
আখলাক সাহেব ই বলেই চুপ কবে গেলেন। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কী তিনি নিজেও কোনোদিন জানার চেষ্টা করেন নি।
স্যার কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
না।
মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির এই সীমাবদ্ধতার কারণ কি জানেন?
না।
একটাই কারণ, মানুষ দুপায়ে হাঁটে। মানুষ চার পায়ে হাঁটলে তার জ্ঞান বুদ্ধিব কোনো সীমা থাকত না।
আখলাক সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, এই জাতীয় উদ্ভট কথা আমাকে বলবে না। মানব জাতির এই যে উত্থান তার কারণ হঠাৎ একদিন আমরা গাছ থেকে নেমে হাঁটার চেষ্টা করতে লাগলাম। সেই চেষ্টা না করলে এখনো আমাদের গাছে গাছে বানর হয়ে ঝুলতে হতো।
ভুত হাসি হাসি গলায় বলল, আসল ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি। মানুষ দুপায়ে হাঁটে, তাকে ব্যালান্স রাখতে হয়। মানুষের ব্ৰেইনের বেশিরভাগই খরচ হয়ে যায় ব্যালান্স রাখার হিসাবনিকাশে। প্রতিনিয়ত ব্রেইনকে এই হিসাব করতে হচ্ছে। এই হিসাব কঠিন ও জটিল হিসাব। মানুষ যদি চারপায়ে হাঁটত তাহলে তার মস্তিষ্কে চাপ থাকত। অনেক কম। সে তার ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারত।
আখলাক সাহেব কিছু বললেন না। ভূতের যুক্তি তিনি ফেলে দিতে পারছেন না। আবার যুক্তি মেনে নিতেও পারছেন না। তিনি অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলার জন্যে কয়েকবার শুকনো ধরনের কাশি কাশলেন। ভূতটা বলল, স্যার আপনার অস্বস্তিতে কাশাকশি করার দরকার নেই। আমি সত্যি কথাই বলছি।
আখলাক সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আমরা যদি এখন দুপায়ে না হেঁটে চারপায়ে হামাগুড়ি দিতে শুরু করি…
তখন স্যার জ্ঞান বুদ্ধিতে আপনাদের নাগাল পাওয়া সমস্যা হবে। আপনারা অনেক দূর এগিয়ে যাবেন।
তবু ব্যাপারটা একটু যেন হাস্যকর।
নতুন সব জিনিসই স্যার হাস্যকর। মানুষ যখন প্রথম জুতা পায়ে দিল তখন সবাই তাদের নিয়ে হাসাহসি করেছে। আর আজ আপনি খালি পায়ে কলেজে ক্লাস নিতে যান আপনাকে নিয়ে হাসোহাসি শুরু হবে। ভুল বললাম স্যার?
না ভুল বলো নি।
স্যারের কি ঘুম পেয়ে গেছে নাকি?
বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে এতক্ষণ যা ঘটছে পুরোটাই স্বপ্নে ঘটছে।
এরকম মনে হওয়ার কারণ কী?
দুটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমালাম তো। আচ্ছা ভালো কথা, ভূতরা কি স্বপ্ন দেখে?
দেখে। তাদের সবই দিবাস্বপ্ন। এরা দিনে ঘুমায় তো, তাই দিবাস্বপ্ন। স্যার কি একটা কবিতা শুনবেন?