রাতে আখলাক সাহেবকে খেয়ে যেতে হলো। মিলি শখ করে রোধেছে। সাধারণ খাওয়া না। পোলাও কোর্মা। পোলাও হয়েছে শক্ত চাল চাল। কোর্মা লবণের জন্যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না। এত আগ্রহ করে রোধেছে, কিছু বলা যাচ্ছে না। শুধু আবু তাহের মুখ শুকনো করে বলল, আবার তুমি রোধেছা? রান্নার জন্যে বাবুর্চি তো আছে। নিজে রাঁধতে গেলে কেন?
মিলি বিরক্ত মুখে বলল, দাদা এসেছে আমি রাধব না তো কি পাড়ার লোকে এসে রোধে দিয়ে যাবে? বাবুর্চির রান্না আমি দাদাকে খাওয়াব? তোমার খেতে ইচ্ছে না হলে খেয়ো না। আমি তো তোমার পায়ে ধরে সাধি নি যে খেতেই হবে। খেতে কি খারাপ হয়েছে?
তাহের বলল, খেতে ভালোই হয়েছে। তবে পোলাও মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চাবাতে হয়। এতক্ষণ চাবানোর ধৈর্য থাকে না।
মিলি স্বামীর দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ভাইয়ের পাতে পোলাও তুলে দিতে দিতে বলল, দাদা যে ভূতটা তোমার কাছে আসে তার নাম কী?
আখলাক মনের ভুলে বলে ফেললেন, ওর নাম লেখক ৭8।
ভূতের প্রসঙ্গটা তিনি আনতে চাচ্ছিলেন না। তারপরেও এসে গেল।
মিলি কিছু বলার আগেই আবু তাহের বলল, ভূতের কী নাম বললেন?
লেখক ৭8।
এটা কী ধরনের নাম?
ভূত সমাজের নাম রাখার এই ধারা। আমরা এই ধারার সঙ্গে পরিচিত নই বলে আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। ওদের কাছেও ঠিক এমনিভাবে আমাদের নামগুলিও খুব হাস্যকর লাগে।
মিলি বলল, হাস্যকর নাম তো আমাদের আছেই। আমার এক বান্ধবী তার ছেলের নাম রেখেছে–গুলকি। আমি বললাম কীরে এত নাম থাকতে গুলকি নাম রাখলি কেন? সে কিছু বলে না, শুধু হাসে।
তাহের একবার বিরক্ত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল। যে দৃষ্টির অর্থ হলো–চুপ কর তো, সব কিছুতে কথা বলবে না। মিলি সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, আমাদের পাশের বাড়ির কাজের মেয়েটার নাম কী জানো দাদা? তার নাম তক্তি বেগম।
তাহের বলল, একটু চুপ করবে? ভাইজানের সঙ্গে একটা জরুরি কথা বলছি। মিলি বলল, আমিও জরুরি কথাই বলছি। আমার কথাগুলি কম জরুরি না।
তোমার জরুরি কথাগুলি একটু পরে বলো, আমারটা শেষ করে নিই। তুমিতে একবার কথা শুরু করলে শেষ করতে পার না। নদীর স্রোতের মতো চলতেই থাকে।
তাহের আখলাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান আপনার এই ভূতের ব্যাপারটা ঠিক কী বলুন তো। আমি ভাসাভাসা ভাবে শুনলাম। সত্যি কি কিছু দেখেছেন?
বুঝতে পারছি না, মনে হয় স্বপ্ন।
রোজই দেখছেন?
পরপর দুরাত দেখলাম। মনে হয় আজও আবার দেখব।
আজ রাতে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুবেন। যাবার সময় আমার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে যাবেন। বিছানায় যাবার আধা ঘণ্টা আগে খাবেন। ওষুধ খাবার পর ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাবেন। রোজ রোজ ভূত দেখা কোনো কাজের কথা না। শেষ পর্যন্ত একটা মানসিক সমস্যা হয়ে যাবে। শুরুতেই সাবধান হওয়া ভালো।
মিলি বলল, তুমিও তো দেখছি কথা শেষ করতে পারছি না। বকবক করেই যাচ্ছি।
আর করব না। এখন তুমি শুরু করতে পোর।
মিলি বলল, দাদা তুমি আমাকে ভূতের ব্যাপারটা ভালোমতো বলো তো।
আখলাক সাহেব বললেন, ভালোমতো বলার কিছু নেই। দুঃস্বপ্ন। আর কিছু না।
দাদা তুমি পেট ঠাণ্ডা রাখবে। পেট গরম হলেই লোকজন দুঃস্বপ্ন দেখে। একবার কী হয়েছে শোন, আমি মুনার জন্মদিনের পাটিতে গিয়ে এক গাদা ভাজ্যভুজি খেয়েছি। বাসায় এসে আবার খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। পেট হয়ে গেল গরম। রাতে স্বপ্নে দেখি কী লক্ষ লক্ষ পিঁপড়া খুবলে খুবলে আমার গায়ের মাংস খেয়ে ফেলছে। কী যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। এখনো মনে হলে গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে যায়। তুমি দাদা এখন থেকে সহজপাচ্য খাবার খাবে। মশলা একেবারে দেবেই না। পোপে পেটের জন্যে ভালো, চেষ্টা করবে: বোজই পেঁপে খেতে। পেঁপে সিদ্ধ করে বেটে একটু কাঁচা মরিচ, পেয়াজ দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে। সঙ্গে সরষে বেটে দিতে বলবে। নতুন সরষে, পুরনোটা দিলে তিতা লাগবে।
আবু তাহের ছটা ঘুমের ট্যাবলেট দিলেন। প্রতি রাতে শোয়ার আগে দুটা করে খেতে হবে। আখলাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভূতপ্ৰেত এইসব নিয়ে আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না ভাইজান। ভূত-প্রেতের সময় আমরা পার কবে এসেছি।
আখলাক সাহেবকে এইসব কথা বলা অর্থহীন। ভূত-প্রেতের সময় যে আমরা পার কবে এসেছি তা তার থেকে বেশি কেউ জানে না। অথচ তার কপাল এমন যে উপদেশগুলি তাঁকে শুনতে হচ্ছে।
যে ভূতটার কথা বলছেন সেটা দেখতে কেমন?
দেখি নি তো কখনো। ঘর অন্ধকার থাকে, কাজেই দেখা হয় নি।
ও আচ্ছা।
আখলাক সাহেব বিষন্ন মুখে বললেন, ভূতটাকে যে এখনো দেখি নি সেটাই আমার কাছে একটা খটকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী রকম?
স্বপ্ন হলে ভূতটাকে দেখতে কোনো অসুবিধা ছিল না। ভূত-টুত এইসব স্বপ্লেই বেশি দেখা যায়। অথচ এখনো দেখলাম না।
স্বপ্ন অনেক রকম হয় ভাইজান। স্বপ্নে শুধু শব্দও শোনা যায়।
তাও ঠিক।
এটা হচ্ছে বিংশ শতাব্দী। আমরা এই শতাব্দীর প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। চাঁদে মানুষ নেমে গেছে। মঙ্গল গ্রহে খুব শিগগিরই নামবে। আমাদের স্পেস প্ৰোব পাইওনিয়ার সৌর মণ্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে। আমরা ভাইরাস প্ৰায় জয় করতে যাচ্ছি, এই সময় আপনার মতো শিক্ষিত একজন মানুষ …
আখলাক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলেন–তাহের যে মিলির চেয়ে কম কথা বলে তা তো না, বরং বেশিই বলে। মিলির কারণে কথা বলার সুযোগ পায় না বলে বোধহয় বলতে পারে না। খুবই খারাপ লক্ষণ। যে সব ডাক্তার বকবক করে তাদের পশার হয় না।