তাহের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, জালাল সাহেব আমি পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি আমার স্ত্রী বা বড়ভাই, নাম আখলাক হোসেন। অধ্যাপনা করেন। আপনাকে তার কথা বলেছিলাম।
জালাল সাহেব হাসি মুখে বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা। বলেছিলেন তো বটেই। উনার কাছেই একটা ভূত আসে। গল্প গুজব করে। তাই না? ভূতের নাম লেখক সাতচল্লিশ।
আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, সাতচল্লিশ না চুয়াতুর।
ও আচ্ছা, আমার আবার সংখ্যা মনে থাকে না। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। আরাম করে বসুন। আজ অবশ্যি আমার হাতে সময় খুব কম। আমার মেয়ের জন্মদিন। এখান থেকে সরাসরি গুলশানে একটা খেলনার দোকানে যাব। খেলনা কিনব। কী কিনব ভেবে পাচ্ছি না। গত আধা ঘণ্টা ধরে শুধু তাই ভাবছি। তার পছন্দের খেলনা হচ্ছে বারবি ডল। গোটা বিশেক তার আছে বলে আমার ধারণা। আরো গোটা বিশেক পেলেও শখ মিটবে না। বারবি ডলই আজ আরেকটা কিনব। যাহা বাহান্ন তাহা একাশি।
আখলাক সাহেব বসলেন। সাইকিয়াট্রিস্টের মাথা যে পুরোপুরি খারাপ তা বোঝাই যাচ্ছে। অকারণে এতগুলি কথা বলল। যাহা বাহান্ন তাহা একাশি আবার কী?
সাইকিয়াট্রিক্ট আখলাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ভূতের ব্যাপারটা কী পরিষ্কার করে বলুন তো। কিছুই বাদ দেবেন না। তবে সংক্ষেপ করে বলবেন। হাতে একদম সময় নেই। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। একটা খেলনা কিনতে হবে। বারবি ডল।
আখলাক সাহেব চুপ করে রইলেন। লোকটার সঙ্গে তাঁর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। যে লোক সারাক্ষণ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, এক মিনিটের মধ্যে দুবার মেয়ের জন্মদিনের কথা বলছে তার সঙ্গে কথা বলবেন কী?
ভূতটা কি রোজ। আপনার কাছে আসে?
মাঝে মাঝে আসে।
দেখতে কেমন?
দেখতে ভূতের মতো।
সেই ভূতের মতোটাই কেমন? লম্বা, না বেঁটে। কালো না সাদা? বড় বড় দাঁত না ছোট ছোট দাতা? মাথায় চুল আছে না। টাক মাথা?
জানি না।
জানেন না কেন? আপনি কি তাকে দেখেন নি?
জি না। অন্ধকারে সে আসে। অন্ধকারে তাকে দেখব কীভাবে? আমি তো বিড়াল না। যে অন্ধকারে দেখব।
তাতো ঠিকই। আচ্ছা ভূতটা সম্পর্কে কিছু বলুন তো।
কী বলব?
তার স্বভাব চরিত্র। তার আচার-আচরণ। সে বোকা না বুদ্ধিমান–এইসব আর কী? আপনার কি ধারণা সে বুদ্ধিমান?
সে যথেষ্টই বুদ্ধিমান।
আপনার চেয়েও বুদ্ধিমান?
সেটা বুঝব কী করে?
সহজেই বোঝা যায়। যেমন ধরুন। একটা ধাঁধা আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো। আপনি সেটা পারলেন না। কিন্তু ভূতকে জিজ্ঞেস করা মাত্র সে পারল। তখন বুঝতে হবে ভূতটা বুদ্ধিমান।
আমি ভুতকে কখনো কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করি নি।
পরের বার যখন দেখা হবে, দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন। এমন একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করবেন যার উত্তর আপনার জানা নেই।
উত্তর জানা নেই এরকম ধাঁধা। আমি নিজেও জানি না। আমি যে সব ধাঁধা জানি তার উত্তরও জানি।
আমি আপনাকে একটা ধাঁধা শিখিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা এই ধাঁধার উত্তর আপনি জানেন না।
বাঘের মতো লাফ দেয়
কুকুবেব মতো বসে।
লোহার মতো জলে ড়ুবে
শোলার মতো ভাসে।
অর্থাৎ অদ্ভুত একটা জিনিস যে বসে কুকুরের মতো, কিন্তু লাফ দেয় বাঘের মত। পানিতে লোহার মতো টুপ করে ড়ুবে যায়, আবার শোলার মতো অবলীলায় ভাসে। আপনি কি জানেন জিনিসটা কী?
জি না।
তাহের সাহেব, আপনি জানেন?
জি না।
সাইকিয়াট্রিক্ট হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে কঠিন একটা ধাঁধা দিতে পেরে তিনি আনন্দিত। আখলাক সাহেবের মনে হলো তার আগে এই ভদ্রলোকের চিকিৎসা হওয়া উচিত।
আখলাক সাহেব।
জি।
আপনার ভূতের ব্যাপার সবটাই আমি জানি। তাহের সাহেব আমাকে খুব গুছিয়ে সব বলেছেন। তবু আপনার মুখ থেকে শোনা দরকার। এত লোক থাকতে ভূতটা আপনার কাছে আসে। কেন বলুন তো?
ও একটা সমস্যায় পড়েছে। সমস্যার সমাধানের জন্যে আমার কাছে আছে।
সমস্যাটা কী?
ওর বাবা-মা ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে, ও বিয়ে করতে চাচ্ছে না। ও ঠিক করেছে চিরকুমার থাকবে।
আমি যতদূর জানি আপনারও একই সমস্যা, তাই না? আপনার আত্মীয়স্বজন আপনাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে, আপনি রাজি না। আপনিও ঠিক করেছেন চিরকুমার থাকবেন। ঠিক তো?
আখলাক সাহেব চুপ করে রইলেন। সাইকিয়াট্রিক্ট বললেন, আপনার সমস্যা খুব সহজ সমস্যা। আপনার অবচেতন মনের চিন্তা-ভাবনাই ভূত হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। অন্য কিছু না। সময় থাকলে আরো পরিষ্কার করে আপনাকে বুঝিয়ে দিতাম। আজ আমার একটু কাজ আছে, আপনাকে বেশি সময় দিতে পারছি না। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। না গেলেই না। সাতটার সময় যাওয়ার কথা ছিল। আটটা বেজে গেছে। আমাকে একটা খেলনার দোকানে যেতে হবে। খেলনা কিনতে হবে। আর দেরি করা যাবে না। আখলাক সাহেব, আপনি পরেরবার আসবেন। আপনার ভূত সমস্যার সমাধান করে দেব। ভালো কথা ধাঁধার উত্তর ভূতের কাছ থেকে নিয়ে আসবেন।
আখলাক সাহেব বললেন, জি আচ্ছা। তার মাথার মধ্যে ধাঁধা ঘুরতে লাগল।
বাঘের মতো লাফ দেয়
কুকুবেব মতো বসে।
লোহার মতো জলে ড়ুবে
শোলার মতো ভাসে।
আশ্চর্য তো! জিনিসটা কী?
সাইকিয়াট্রিন্টের চেম্বার থেকে বের হয়ে তাহের বলল, ভাই সাহেব, আপনি দয়া করে আজ রাতটা আমার বাসায় থাকুন। আখলাক সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন?
আপনার বাসায় কাজের লোক নেই। মোতালেব চলে গেছে, রান্না বান্না…
এইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।