কলিং বেল টিপতেই তাহের দরজা খুলে দিল। তাহেরের পেছনে উঁকি দিল মিলি, দুজনই সেজেণ্ডজে আছে, মনে হচ্ছে কোথাও বেরুচ্ছে। আখলাক সাহেব বললেন, কোথাও যাচ্ছিস?
মিলি হড়বড় করে বলল, তোমার কাছে যাচ্ছি।
আমার কাছে কেন?
মিলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মোতালেব এসে কী সব উলটা পালটা খবর দিয়ে গেল। চিন্তায় অস্থির হয়ে .
কী বলেছে মোতালেব?
দাদা তুমি নাকি এখন চারপায়ে হাঁটা। তুমি নাকি রাতে ঘুমাও না। মশাবি খাটিয়ে তার ভেতর চারপায়ে দাঁড়িয়ে থােক। মাঝে মাঝে ঘোড়ার মতো চিহি করে ডাক ছাড়।
বলতে বলতে মিলির চোখে পানি এসে গেল। গলা ধরে গেল। তাহের বলল, তুমি ভাইজানকে আগে ভেতরে এসে বসতে দাও। দরজাতেই কী শুরু করলে? মোতালেবের সব কথা বিশ্বাস করতে হবে তার কোনো মানে আছে? ভাইজান আপনি এসে আরাম করে
বসুন তো।
আখলাক সাহেব বসার ঘরের সোফায় এসে বসলেন। তাহের গম্ভীর মুখে তাঁর সামনে এসে বসল। মিলি তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো চোখ মুছছে। তাহের বুকে এসে বলল, মোতালেবের কথা সত্যি না, তাই না ভাইজান?
আখলাক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন, চিহি করে ডাক দেয়ার ব্যাপারটা সত্যি না। ঐ অংশটা বানানো।
বাকিটা সত্যি?
মোটামুটি সত্যি বলা যেতে পারে।
তাহেরের মুখ হা হয়ে গেল। অনেক কষ্টে সে মুখের হা বন্ধ করে বলল, আপনি তাহলে চারপায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
সব সময় না, মাঝে মাঝে।
মাঝে মাঝে?
হ্যাঁ। এটা এক ধরনের একসারসাইজ। এর নাম হলো তোমার ফিক্স হ্যান্ড একসারসাইজ। এই একসারসাইজের অনেক উপকারিতা। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্যে এরচেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।
মিলি চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বলল, কে শিখিয়েছে তোমাকে এই একসারসাইজ?
কেউ শেখায় নি, নিজে নিজেই বের করেছি।
মিলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তুমি নিজে নিজে এই একসারসাইজ বের করেছ?
ঠিক নিজে নিজে বলাটা ঠিক হবে না। ভূতেল সাহায্য নিয়েছি।
দাদা, কার সাহায্য নিয়েছ?
ঐ যে একটা ভূত যে আমার কাছে প্রায়ই আসে, নাম হলো গিয়ে— লেখক ৭৪…
মিলি ভীত গলায় বলল, লেখক ৭৪?
ওদের নামকরণ পদ্ধতি আর আমাদের নামকবণ পদ্ধতি এক না। প্রথম দিকে ভুতদের নাম শুনলে একটু ধাক্কা লাগবেই।
মিলি বলল, দাদা তুমি যা বলছ সব কিছুতেই আমার ধাক্কা লাগছে। একী সর্বনাশ হয়ে গেল! বলতে বলতে সে আবারো শব্দ করে কেঁদে উঠল। তাহের বলল, মিলি তুমি রান্নাঘরে যাও তো, ভাইজান এবং আমার জন্যে সুন্দর করে চা বানিয়ে আন। অকারণে অস্থির হয়ে না। মাথা ঠাণ্ড রাখ। বি লেভেল হেডেড। সিচুয়েশন আন্ডার কনট্রোলে আছে। আর শোন, তুমি এখনো ভাইজানের মাথার উপর ফ্যানটা ছাড়ছ না কেন? সব কিছু বলে দিতে হবে? ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দাও।
মিলি ফ্যান ছেড়ে দিল। আখলাক সাহেব গম্ভীর হয়ে সেই ফ্যানের নিচে বসে রইলেন। তিনি খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। এই বাড়িতে আসাটা তার জন্যে বোকামি হয়েছে।
তাহের তার দিকে ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ভাইজান একটা কথা বলি?
আখলাক সাহেব বললেন, যা বলতে চাও বলো। ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিস করার মতো কিছু কি হয়েছে? যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।
ভাইজান, আপনার চিকিৎসা হওয়া দরকার।
তোমার সে-রকম মনে হচ্ছে?
জি।
তোমার ধারণা আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে?
জি আমার সেরকমই ধারণা। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট আছেন। আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাব।
কবে নিয়ে যাবে?
যদি বলেন আজই নিয়ে যাব।
উনাকে আপনার ব্যাপারে সব বলে রেখেছি।
আখলাক সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যদি সত্যি কোনোদিন পাগল হই তাহলে তোমাকে নিয়ে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব। এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমাকে বিরক্ত করো না।
আপনি কি একটা রিল্যাক্সেন খেয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকবেন? এতে মাথাটা ঠাণ্ডা হতো।
আমার মাথা নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
জি আচ্ছা।
আখলাক সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। যাচ্ছেন না, কারণ মিলি কষ্ট পাবে। এসেছেন যখন রাতে খেয়ে যেতে হবে। মিলি নিশ্চয়ই কুৎসিত কিছু রান্না করবে। যা মুখে দেয়া যাবে না। রাতে খাবাব সময় আবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলবে। আবারো–৫২। এমন কোনো বয়স না! অসহ্য।
দরজার আড়াল থেকে তৃণা উঁকি দিচ্ছে। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। সে ফিসফিস করে ডাকল, বড় মামা।
আখলাক সাহেব বললেন, ফিসফিস করছিস কেন?
মা তোমার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে, এই জন্যেই ফিসফিস করছি। মা শুনলে বকা দেবে।
কথা বলতে নিষেধ করেছে কেন?
তোমার যে খুব মেজাজ খারাপ। এই জন্যে।
আমার মেজাজ খারাপ না। আয় কাছে আয়।
তৃণা এগিয়ে এলো এবং কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বড় মামা তুমি নাকি পাগল হয়ে গেছ?
আখলাক সাহেব বললেন, কে বলেছে?
বাবা বলেছে। মা সেটা শুনে সারা দুপুর কেঁদেছে। বড় মামা, তুমি কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছ, না একটু বাকি আছে?
একটু বাকি আছে।
মোতালেব বলছিল তুমি নাকি এখন ঘোড়ার মতো হাঁট আর চিহি করে ডাক দাও।
ও একটু বেশি বেশি বলছে। চিহি করে ডাক দিই না।
যখন চিঁহি করে ডাক দেবে তখন পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে, তাই না মামা?
হুঁ।
ঐ ভূতটা কি তোমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে মামা?
বুঝতে পারছি না, বোধহয় দিচ্ছে।
মিলি অনেক কিছু রান্না করেছে। পাবদা মাছ, কাতলা মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট। কই মাছের ঝোল। ইলিশ মাছের সর্ষে বাটা। প্রতিটি পদই হয়েছে অখাদ্য। শুধু শুধু যে ভাত খাবেন সে উপায়ও নেই। চাল কিছু সেদ্ধ হয়েছে, কিছু হয় নি। একই হাঁড়ির ভাত অর্ধেক সেদ্ধ হয়, অর্ধেক হয় না কেন তা বোধহয় শুধু মিলিই জানে।
আখলাক সাহেব বাড়ি ফিরলেন
আখলাক সাহেব রাত এগারোটার দিকে বাড়ি ফিরলেন। মোতালেবকে বললেন, চা করতে। মোতালেব চা বানিয়ে আনল। চায়ের কাপটা তাঁর সামনে বাখল। খুব ভয়ে ভযে। যেন তিনি ভয়ঙ্কব কোনো হিংস্ৰ জানোয়ার, এক্ষুনি মোতালেবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। সে তার সামনেও আসছে না। দরজার আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে। চোখের উপর চোখ পড়া মাত্র চোখ সবিয়ে নিচ্ছে। আখলাক সাহেব শীতল গলায় ডাকলেন, মোতালেব!