আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, যখন চ্যাম্পিযন হব, তখন বুঝবে কাকে বলে চামচিকা ক্লাব।
তোরা চ্যাম্পিয়ন হবি? খোড়া চালাবে বাইসাইকেল?
হ্যাঁ চালাব।
যদি চ্যাম্পিযন হতে পাবিস, তাহলে আমি আমার মাথাব্য চুল কেটে ফেলব। সত্যি বলছি।
এই বলে মাথাভর্তি চুল ঝাকাতে ঝাকাতে অরু আপা চলে গেল। আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। আমাদের দলটা হচ্ছে সবচে খারাপ। আমরা যে লাডডা-গুড়া হব, এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। নান্টু হচ্ছে আমাদের গোলকিপার। এম্নিতে সে চোখে খুব ভালো দেখে, কিন্তু যখন বল গোলের দিকে আসে–তখন নাকি সব অন্ধকার হয়ে যায়। চোখে কিছু দেখে না। আসলেই তাই। বল একদিকে আসে, সে অন্যদিকে ডাইভ দেয়।
আমাদের ব্যাকে খেলে পরিমল। বল তার পায়ে আসতেই সে হোঁচটি খেয়ে পড়ে যায়। কেন এরকম হয় কে জানে! শুকনো খটখটে মাঠ। পা পিছলানোর কোনো কথা নয়, অথচ পরিমলের কাছে বল যেতেই হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে যাবে।
আমরাও একই রকম, শুধু টগর খুব ভালো খেলে। ও হচ্ছে আমাদের স্ট্রাইকার। কোনোমতে ওর কাছে বল পৌঁছে দিলে গোলে বল ঢোকাবেই। একজনের ওপর ভরসা করে কি চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়? যায় না। ফুটবল হলো এগার জনের খেলা। তবু আমরা মন্দ করলাম না। গ্ৰীন বয়েজ ক্লাবের সঙ্গে এক গোলে জিতলাম। টগর একবার মাত্র বল পেয়েছিল। সেটা দিয়ে গোল করেছে। অরুণিমা ক্লাবের সঙ্গে ড্র হলো চার-চার গোলে। আমাদের দিকের চারটা গোলই করেছে টগর। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, আমরা শেষ পর্যন্ত ফাইনালে উঠে গেলাম। অরু আপার মুখ শুকিয়ে গেল। যদি সত্যি সত্যি জিতে যাই, তাহলে মাথাভর্তি চুল কাটতে হবে।
ফাইনাল খেলার দিন শহরে সাজ-সজ রব পড়ে গেল। আমাদের পাড়ায় একজন নেতা আছেন। তিনি শুধু ইলেকশন করেন। আর ফেল কবেন। তাঁর নাম মতিন সাহেব। তিনি ফাইনাল খেলার দিন ভোরবেলা একটা শিন্ড ঘোষণা করে দিলেন–সেই সঙ্গে ফাইনাল খেলা যাতে ঠিকমতো হয় সে জন্য তিন শটাকা চাঁদা দিলেন। নিজেই মাইকের ব্যবস্থা করে দিলেন। সকাল থেকে রিকশা করে মাইক বাজতে থাকল
ভাইসব, আদ্য বৈকাল চার ঘটিকায় আব্দুল মতিন ফুটবল শিন্ডের ফাইনাল খেলা। রয়েল বেঙ্গল বয়েজ ক্লাব একাদশ বনাম বুলেট একাদশ। উদ্বোধন করবেন অত্র অঞ্চলেব বিশিষ্ট সমাজসেবী, জনগণের নয়নের মণি, দেশদরদী সংগ্ৰামী জননেতা জনাব আব্দুল মতিন ময়না মিয়া। ভাইসব…
আমাদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। শুধু আমাদের না, উত্তেজনা বড়দের মধ্যেও। বড়চাচা আমাকে ডেকে বললেন, কী, তোরা পারবি তো?
আমি হচ্ছি দলের ক্যাপ্টেন। কাজেই আমাকে বলতে হলো, ইনশাআল্লাহ পারব।
তোরা তো খেলতে জানিস না, তোরা পারবি কী করে? একমাত্র খেলোয়াড় হচ্ছে টগর। সেই বেচারা একা কী করবে?
সে একাই একশ।
মুখে বললাম ঠিকই, কিন্তু ভবাসা পেলাম না। কারণ বুলেট ক্লাব বাইরে থেকে হায়ার করে তিনজন প্লেয়ার এনেছে। এক-একজন ইয়া জোয়ান। এদের একজনের নাম ল্যাংচু, কারণ তার কাজই হচ্ছে ল্যাং মেবে ফেলে দেয়া। সেই ল্যাংও এমন ল্যাং যে প্লেয়ারের পা ভেঙে যায়। ল্যাংচু নাকি এইভাবে এর আগে তিন জনের পা ভেঙেছে। টগরের পা ভেঙে সে এক হালি পুরো করবে। কী সর্বনাশের কথা।
চারটার সময় খেলা শুরু হবে। দুটো বাজতেই টগর শুকনো মুখে এসে উপস্থিত। সে নাকি খেলবে না। আমি বললাম, কেন খেলবি না? ল্যাংচুর ভয়ে?
বুলেট ক্লাবের বগা ভাই বলেছে আমি যদি খেলি, তাহলে আমাকে ফর্দাফাই করে দেবে!
বগা ভাই নিজে বলেছে?
হুঁ।
বগা ভাই বলে থাকলে সত্যি ভয়ের কথা। কারণ বগা ভাই বিরাট গুণ্ডা। তার এতদিনে ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে পড়া উচিত। কিন্তু সে ফেল করে করে ক্লাস এইটে আটকে আছে। কাজের মধ্যে কাজ সে যা করে তা হচ্ছে বিড়ি টানে। খারাপ খারাপ কথা বলে আর আমাদের মতো অল্পবয়সী ছেলেপুলে দেখলে বিনা কারণে মারধোর করে। আমাদের ক্লাসের পুতুল একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি আসছে, হঠাৎ বগা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বগা ভাই বললেন, শুনে যা। পুতুল দেখল পালানো অসম্ভব। সে এগিয়ে এলো। বগা ভাই বলল, পিঁপড়ার কামড় কেমন জানিস?
জানি।
উঁহু, ভালোমতো জানিস না। তবে এখন জানবি।
এই বলেই লাল পিঁপড়ার একটা বাসা ভেঙে পুতুলের মাথায় টুপির মতো পরিয়ে দিল। ভয়াবহ অবস্থা। এই বগা ভাইয়ের কারণে টগর যে খেলবে না, তা তো জানা কথাই।
শুধু টগর না, কিছুক্ষণ পর করিম এসে বলল, সেও খেলবে না। কবিম সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে। খুব খারাপ না। টগরের মতো অবশ্যি না, তবুও ভালো।
আমি বললাম, তুই খেলবি না কেন? বগা ভাই কিছু বলেছে?
না।
তাহলে খেলবি না কেন?
ইচ্ছা হচ্ছে না, তাই খেলব না।
এই বলেই করিম লম্বা একটা ঘাসের ডাটা নিয়ে চিবুতে লাগল। তার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে বগা ভাই তাকেও ভয় দেখিয়েছে।
আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নজন প্লেয়ার নিয়ে কী খেলব? অরু আপা বলল, তোরা খেলা বন্ধ করে পালিয়ে যা। আজ মাঠে তোদের তুলোধুনো করবে। কমসে কম দুজনের পা ভাঙবে। একজনের হবে কম্পাউন্ড ফ্রাকচাব।
ম্যাচে নাম দিয়ে পিছিয়ে পড়া যায় না। সাড়ে তিনটায় মাঠে গিয়ে উপস্থিত হলাম। লোকে লোকারণ্য। বুলেট ক্লাবেব প্লেয়াবাবা বল নিয়ে মাঠে ছোটাছুটি করছে। তাদের সবার মুখভর্তি হাসি।
মাঠের দক্ষিণ দিকে টেবিলের উপর শিন্ড। বিশিষ্ট অতিথিদের জন্যে চেয়ার সাজানো। দেশদরদী জননেতা আব্দুল মতিন সাহেব এসে পড়েছেন। তাঁর গলায় ফুলের মালা। বগা ভাইকেও দেখলাম। খুব ফুর্তি। একটু পবিপর হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে।