- বইয়ের নামঃ বৃষ্টি বিলাস
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
শামা
রিকশা থেকে নেমেই শামা দেখল তাদের বাসার বারান্দার কাঠের চেয়ারে কে যেন বসে আছে। কাঠের চেয়ারের পেছনের একটা পা ভাঙা। চেয়ারটা দেয়ালে হেলান না দিয়ে বসা যায় না। কিন্তু যে বসেছে সে চেয়ারটা বারান্দার মাঝামাঝি এনেই বসেছে। একটু অসাবধান হলেই উল্টে পড়বে। শামার বুক ধুকধুক করতে লাগল। যে-কোন সময় একটা একসিডেন্ট ঘটবে এটা মাথায় থাকলেই টেনশন হয়। শামার সমস্যা হচ্ছে সামান্য টেনশনেই তার বুক ধুকধুক করে। গলা শুকিয়ে যায়। এক সময় মনে হয় হাত-পা শক্ত হয়ে আসছে। নিশ্চয়ই হার্টের কোনো অসুখ। যত দিন যাচ্ছে, তার অসুখটা তত বাড়ছে। আগে এত সামান্যতে বুক ধুকধুক করত না, এখন করে।
গত সপ্তাহেই কলেজ থেকে ফেরার পথে সে দেখল কে যেন ঠিক রাস্তার মাঝখানে একটা ডাব ফেলে রেখেছে। তার বুক ধুকধুক করা শুরু হলো। এই বুঝি একসিডেন্ট হলো। ভাবের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে পড়ল রিকশা। রিকশার যাত্রী ছিটকে পড়ল সিট থেকে, আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে তার ওপর দিয়ে চলে গেল। দৃশ্যটা শামা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখল, তার হাতপা হয়ে গেল শক্ত। নড়ার ক্ষমতা নেই। একসিডেন্ট না হওয়া পর্যন্ত সে যেন নড়তে পারবে না। তার উচিত রাস্তায় নেমে ডাটা সরিয়ে দেয়া। সেটাও সম্ভব না। কুড়ি বছর বয়েসী-রূপবতী একটা তরুণী রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করছে। এই দৃশ্য মজাদার। চারদিকে লোক জমে যাবে। সবাই তার দিকে ডাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। তাদের দৃষ্টিতে পরিষ্কার লেখা থাকবে ‘ব্রেইন নষ্ট মেয়ে। ডাবটা সরিয়ে সে যখন বাসার দিকে রওনা হবে তখন তার পেছনে পেছনে কয়েকজন রওনা হবে। মজা দেখার জন্যে যাবে। ‘ব্রেইন নষ্ট মেয়ে’ নতুন আর কী করে সেটা দেখার কৌতূহলেই পেছনে পেছনে যাওয়া। পাগল মেয়ের পেছনে হাঁটা যায়। তাতে কেউ দোষ ধরে না।
ভাঙা চেয়ারটায় বসে আছেন শামার বাবা আবদুর রহমান। তিনি মালিবাগ অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সন্ধ্যা সাতটার আগে কোনোদিনই বাসায় ফেরেন না। এখন বাজছে তিনটা দশ। অসময়ে বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে আছেন বলে শামা দূর থেকে বাবাকে চিনতে পারে নি। তাছাড়া বাসায় তিনি যতক্ষণ থাকেন, খালি গায়ে থাকেন। আজ পরেছেন ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি। শামার বাবার মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে আনন্দময় কিছু ঘটবে, তার প্রতীক্ষায় চেয়ারে বসে তিনি পা দোলাচ্ছেন।
শামা বাবার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল, বাবা এই চেয়ারটার পেছনের পা ভাঙা। তুমি উল্টে পড়বে।
আবদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, পায়া ঠিক করেছি। তিনটা পেরেক মেরে দিয়েছি। তোর কলেজ ছুটি ঘেমে টেমে কী হয়েছিল। যা ঘরে গিয়ে। গোসল কর। আর তোর মা’কে বল আমাকে একটা পান দিতে।
শামা ঘরে ঢুকল। শামার মা সুলতানা মেয়েকে দেখেই বললেন, এত দেরি কেন রে?
শামা বিরক্ত হয়ে বলল, দেরি কোথায় দেখলে? দু’টার সময় কলেজ ছুটি হয়েছে? এখন বাজছে দুটা পঁচিশ।
যা গোসল করতে যা, বাথরুমে পানি, সাবান, তোয়ালে দেয়া আছে।
ক্ষিধায় মারা যাচ্ছি, আগে ভাত দাও। আর বাবা পান চাচ্ছে। বাবা আজ এত সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরল কেন?
সুলতানা হাসিমুখে বললেন, তার অফিসের কয়েকজন কলিগ আসবে। বিকালে চা খাবে। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গোসলে যা।
শামা শীতল গলায় বলল, ঘটনা কী বলতে মা? আমাকে গোসল করানোর জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে গেছ কেন?
সুলতানা হড়বড় করে বললেন, কোনো ঘটনা না। ঘটনা আবার কী? তোর বাবার কয়েকজন বন্ধু বিকালে চা খেতে আসবে। অফিসের বন্ধু-বান্ধবরা চা খেতে আসতে পারে না।
শামা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, চায়ের ট্রে নিয়ে তাদের সামনে সেজেগুজে আমাকে যেতে হবে তাইতো? ঘটনা এরকম কি-না সেটা বল।
সুলতানা চুপ করে রইলেন। শামা বলল, ছেলে কী করে?
তার বাবার অফিসে চাকরি করে। নতুন ঢুকেছে। জুনিয়ার অফিসার। বাহ্ ভালত। শ্বশুর-জামাই এক অফিসে চাকরি করবে। দুপুরে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার ভাগাভাগি করে খাবে। শ্বশুর জামাইকে সেধে খাওয়াবে। জামাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে শ্বশুরের জন্যে চমন বাহার দেয়া পান নিয়ে আসবে।
সুলতানা ফিক করে হেসে ফেললেন। শামা কঠিন গলায় বলল, হাসবে না। মা। তোমার হাসি অসহ্য লাগছে। আমি মরে গেলেও চা নিয়ে কারোর সামনে যাব না। এটা আমার শেষ কথা।
আচ্ছা ঠিক আছে। না গেলে না যাবি। যা গোসল করতে যা। গোসল করে যে শাড়িটা পরবি সেটাও বাথরুমে আছে। তার বাবা কিনে এনেছে। তোর বাবা যে কিনতে পারে তাই জানতাম না।
গোসল করতেও যাব না। গা ঘামা অবস্থায় থাকব। ক্ষিধে বেশি লেগেছে? আগে ভাত খেয়ে নিবি?
ভাত খাব না। গেস্ট না আসা পর্যন্ত ছাদে দাঁড়িয়ে থাকব। গায়ে আরো রোদ লাগাব। রোদে গায়ের চামড়া জ্বালিয়ে ফেলব।
তোর যা ইচ্ছা করিস। একটু ঠাণ্ডা হ। লেবুর সরবত খাবি? গরম থেকে এসেছিস লেবুর সরবত ভাল লাগবে।
লেবুর সরবত খাব না। বাবা পান চাচ্ছে এখনো পান দিচ্ছ না কেন?
শামা মা’র সামনে থেকে সরে গেল। ঢুকল বাথরুমে। বাথরুমে গোসলের। সরঞ্জাম সুন্দর করে সাজানো। বালতি ভর্তি পানি। নতুন একটা সাবান, এখনো মোড়ক খোলা হয় নি। সাবানের পাশে নতুন একটা টুথব্রাশ। বাথরুমের দড়িতে হালকা সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি ঝুলছে। এই শাড়িটা শামার বাৰা আজ কিনে এনেছেন। বাবার রুচি খুবই খারাপ। কটকটে রঙ ছাড়া কোননো রঙ তার চোখে ধরে না। কিন্তু এই শাড়ির রঙটা ভাল।
মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে শামার মনে হলো লাল কাচের চুড়ি থাকলে খুব ভাল হত। সবুজ শাড়ির সঙ্গে হাত ভর্তি লাল চুড়ি খুব মানায়। শাদা শাড়ির সঙ্গে মানায় নীল চুড়ি।
এ বাড়িতে পানির খুব টানাটানি। সাপ্লাইয়ের পানি ঝিঝির করে তিন চার ঘণ্টা এসেই বন্ধ। জমা করে রাখা পানি খুব সাবধানে খরচ করতে হয়। কেউ পানি বেশি খরচ করলে তার দিকে সবাই এমনভাবে তাকায় যেন চোখের সামনে মূর্তিমান পানি-খেকো শয়তান। আজ শামার সেই ভয় নেই। পুরো বালতি শেষ করলেও কেউ কিছু বলবে না। শামা মনের আনন্দে মাথায় পানি ঢালতে লাগল। ঠাণ্ডা পানিতে এত আরাম লাগছে! শামার ধারণা গায়ে প্রচুর পানি ঢাললে শুধু যে। শরীরের নোংরা দূর হয় তা-না, মনের ময়লাও খানিকটা হলেও ধুয়ে চলে যায়। এই জন্যেই মন ভাল লাগে।
যে ছেলেটা তাকে দেখতে আসবে তাদের বাড়িতে প্রচুর পানি আছেতো? সবচে’ ভাল হয় যদি বাড়িতে বাথটাব থাকে। গরমের সময় বাথটাব ভর্তি করে সে পানি রাখবে। বরফের দোকান থেকে চার পাঁচ কেজি বরফ এনে গুড়ো করে। বাথটাবে ছেড়ে দেবে। কয়েকটা টাটকা গোলাপ কিনে গোলাপের পাপড়ি পানিতে ছেড়ে দিয়ে সে ডুবে থাকবে। হাতের কাছে টি পটে চা থাকবে। মাঝে। মাঝে চায়ে চুমুক দেবে। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজতে পারে। নিশ্চয়ই বাথরুমে গান শুনতে ভাল লাগবে। অনেক মানুষই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই গান ধরে। ভাল না লাগলে নিশ্চয়ই ধরত না।
সুলতানা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিলেন। অবাক হয়ে বললেন, শামা ভাত তরকারি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ কী করছিস?
শামা হালকা গলায় বলল, বালতির পানি সব শেষ হয়ে গেছে মা। আরো পানি লাগবে।
আর পানি পাব কোথায়?
বাড়িওয়ালা চাচার ঘর থেকে আনাও। সারা গায়ে সাবান মেখে বসে আছি। পানি শেষ। আরেকটা কথা মা, যে ছেলেটা আমাকে দেখতে আসছে তার নাম কী?
ছেলের নাম আতাউর।
কী সর্বনাশ আতাউর আবার মানুষের নাম হয়? নাম শুনলেই মনে হয়। খাতাউর সাহেব হাঁ করে আছেন— খেয়ে ফেলার জন্যে।
খাতাউর না, আতাউর। শামা তুই ইচ্ছা করে ফাজলামি করছিল। এইসব ঠিক না।
পানি আনার ব্যবস্থা কর মা। আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। মা শোন, লাল চুড়ি আছে? তোমার ট্রাংকেতো অনেক জিনিস আছে। খুঁজে দেখতে লাল চুড়ি আছে নাকি। আমি লাল চুড়ি পরব।
সুলতানা আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে সহজভাবে কথা বলছে। তিনি কাজের মেয়েকে বালতি দিয়ে পানি আনতে পাঠালেন। মেয়েটা শখ মিটিয়ে গোসল করুক। মেয়েদের অতি তুচ্ছ শখও সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হয়। মেয়েরা মা-বাপের সংসারে থাকে না। অন্য সংসারে চলে যায়। যে সংসারে যায় সেখানে সে হয়ত মুখ ফুটে শখের কথাটা বলতেও পারে না।
অতিথিরা পাঁচটার সময় উপস্থিত হলেন। তখন শামার চুল বাঁধা হচ্ছে। চুল বেঁধে দিচ্ছে শামার ছোট বোন এশা। এশা এ বছর ক্লাস টেনে উঠেছে। সে খুবই হাসি খুশি মেয়ে। গত ছ’দিন ধরে কী কারণে যেন সে মুখ ভোতা করে আছে। কারো সঙ্গেই কথাবার্তা বলছে না। এশার মুখ ভোঁতার রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা কেউ করছে না। কারণ চেষ্টা করে লাভ নেই। এশা নিজ থেকে মুখ না খুললে কেউ তার মুখ খোলাতে পারবে না।
লোকজন চলে এসেছে এই খবরটা দিল শামার ছোট ভাই মন্টু। সে গত বছর এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিল। টাইফয়েড হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষা শেষ করতে পারে নি। এবার আবারো দিচ্ছে। আগামী বুধবার থেকে তার পরীক্ষা শুরু। মন্টুর ধারণা এবারে পরীক্ষার মাঝখানে তার কোনো বড় অসুখ হবে, সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। এরকম স্বপ্নও সে দেখে ফেলেছে। স্বপ্নে পরীক্ষার হল থেকে এম্বুলেন্সে করে তাকে সরাসরি হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে ডাক্তাররা ছোটাছুটি শুরু করেন। কারণ তাকে রক্ত না দিলে সে মারা যাবে। কারো রক্তের সঙ্গেই তার রক্ত মিলছে না। শেষে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মিলল। সেই একজন তাদের স্কুলের হেড স্যার। তিনি রক্ত দিতে এসে তাকে দেখে প্ৰচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, কীরে তুই এ বছরও পরীক্ষা দিচ্ছিস না? ফাজলামি করিস?
মন্টু এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপা, এসে গেছে। চারজন এসেছে।
শামা বিরক্ত গলায় বলল, চারজন এসেছে খুব ভাল কথা। তুই ফিসফিস করছিস কেন? এর মধ্যে ফিসফিসানির কী আছে।
ট্যাক্সি করে এসেছে।
শুনে খুশি হলাম। ট্যাক্সি করেইতো আসবে। ঠেলাগাড়িতে করে তো আসবে না। না-কি তুই ভেবেছিলি ঠেলাগাড়ি করে আসবে?
অনেক মিষ্টি এনেছে। পাঁচ প্যাকেট।
সামনে থেকে যা তো, কানের কাছে বিজবিজ করবি না। কয় প্যাকেট মিষ্টি এনেছে—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুণেছিল। শুনতেইতো লজ্জা লাগছে।
মেহমানরা বসার ঘরে বসেছেন। তাদেরকে চা নাস্তা এখনো দেয়া হয় নি। আরো দু’জন নাকি আসবেন। তাদের জন্য অপেক্ষা। মজার গল্প হচ্ছে। হাসি শোনা যাচ্ছে।
শামা সেজেগুজে অপেক্ষা করছে। চা নিয়ে যেতে বললেই সে ট্রেতে করে চী নিয়ে যাবে। এই উপলক্ষে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে সুন্দর একটা ট্রে আনা হয়েছে। ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে। এক ধরনের চায়ের কাপ আছে ছ’টা। চারজন গেস্ট আছেন। আরো দু’জন আসবেন। ছ’টা কাপ হয়ে গেল। আবদুর রহমান সাহেবকে চা দিতে হবে, তার জন্যে একটা কাপ লাগবে। তারা হয়ত শামাকেও চা খেতে বলবেন। আরো দু’টা ভাল কাপ দরকার।
সুলতানা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। তিনি ঠিক করেছেন মেহমানদের কোনো বাইরের খাবার দেবেন না। সব খাবার ঘরে তৈরি হবে। তিনি কলিজার সিঙ্গাড়া বানানোর চেষ্টা করছেন। সিঙ্গাড়ার তিনটা কোণা ঠিক মতো উঠছে না। সিঙ্গাড়া তিনি আগেও বানিয়েছেন। তখন ঠিকই কোণা উঠেছে। এখন কেন উঠছে না? বিয়েতে কোন অলক্ষণ নেই তো? আজ সকালবেলা বেশ কয়েকবার তিনি এক শালিক দেখেছেন। এক শালিকের ব্যাপারটা অনেকেই বিশ্বাস করে না। তিনি খুব করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি লক্ষ করেছেন যতবার এক শালিক দেখেছেন ততবারই ঝামেলা হয়েছে।
এশ এসে মাকে সাহায্য করার জন্যে বসল। এশার মুখ আগের চেয়েও গম্ভীর। চোখ ফোলা ফোলা। মনে হয় কেঁদেটেদে এসেছে। এশার কী হয়েছে কে জানে! এমন চাপা মেয়ে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলেও সে মুখ খুলবে না।
সুলতানা বললেন, কী সমস্যা হয়েছে দেখ না। সিঙ্গাড়ার কোণা উঠছে না।
এশা বলল, খেতে ভালই হল। কোণা ওঠার দরকার নেই। দোকানের সিঙ্গাড়ায় লোকজন কোণা খোজে। ঘরের সিঙ্গাড়ায় খোঁজে না।
সুলতানা বললেন, একটা খেয়ে দেখ।
খেতে ইচ্ছা করছে না।
তোর কি কোনো কারণে মন টন খারাপ?
না। এক কথা পাঁচ লক্ষবার জিজ্ঞেস করো না তো মা। আমার মন খারাপ কি-না এটা তুমি এই ক’দিনে পাঁচ লক্ষবারের বেশি জিজ্ঞেস করে ফেলে।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, শামা কী করছে?
খাটে বসে আছে।
সাজার পর তাকে কেমন দেখাচ্ছেরে?
পরীদের রাণীর মতো লাগছে।
সুলতানা তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, শামাকে যে-ই দেখবে সে-ই পছন্দ করবে। মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকালে বুকে ধাক্কার মতো লাগে। ভেবেই পাই না এত সুন্দর মেয়ে আমার পেটে জন্মাল কীভাবে!
এশ বলল, আপা বেশি সুন্দর। বেশি সুন্দরকে আবার মানুষ পছন্দ করে না।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, পছন্দ করবে না কেন?
এশা উত্তর দিল না। সুলতানা বললেন, পছন্দ করবে না কেন বল? কারণ জানিস না?
কারণ জানি কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। মা শোন, তুমি আর বাবা, তোমরা দু’জন কি আসলেই চাও যে ছেলেটা এসেছে তার সঙ্গে আপার বিয়ে হোক?
তোর বাবা চায়, তার ধারণা ছেলেটা খুবই ভাল। অসম্ভব ভদ্র, বিনয়ী। ফ্যামিলিও ভাল। ছেলের অবশ্যি বাবা নেই। কিছুদিন হলো মারা গেছেন। শামা শ্বশুরের আদর পাবে না। তোরাতে জানিস না শ্বশুরের আদর বাপের আদরের চেয়েও বেশি হয়।
আপা যেভাবে সাজগোজ করেছে এভাবে সাজগোজ করে থাকলে কিন্তু ওরা আপাকে পছন্দ করবে না। আপার উচিত খুব সাধারণ একটা শাড়ি পরে ওদের সামনে যাওয়া। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক এইসব কিছু না।
কী বলছিস তুই!
কোনোরকম সাজগোজ ছাড়া আপা যখন ওদের সামনে দাঁড়াবে তারা বলবে, বাহু কী সহজ সরল সাধারণ একটা মেয়ে! বউ হিসেবে সবাই সাধারণ মেয়ে। খোজে। আপার ঠোটে লিপস্টিক, গালে পাউডার কোনো কিছুরই দরকার নেই। গোসল করে আপা যখন ভেজা চুলে বের হলো তখন তাকে যে কী সুন্দর লাগছিল। লক্ষ কর নি?
সুলতানা অবাক হয়েই মেয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে এই যেন সেদিন মেয়েটা ছোট্ট ছিল। সারারাত ওঁয়া ওঁয়া করে কাদত। মুখে দুধ গুজে দিলেও কান্না থামত না। দুধ খাচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে কাঁদছে। কান্নাটা যেন তার বিশ্রাম। আর আজ এই মেয়ে গুটগুট করে কী সুন্দর কথা বলছে! কথাগুলি মনে হচ্ছে সত্যি।
এশা বলল, মা আলাকে সাধারণ ঘরে পরার একটা শাড়ি পরতে বলব?
বল। তার বাবা আবার রাগ না করে। শখ করে একটা শাড়ি কিনে এনেছে।
বাবা কিছু বুঝতে পারবে না। বাবা খুব টেনশনে আছে তো। টেনশনের সময় মানুষ কিছু বুঝতে পারে না। বাবা ভালমতো আপার দিকে তাকাবেই না। মেয়েরা যখন বড় হয়ে যায় তখন বাবারা মেয়েদের দিকে কখনো ভালমতো তাকায় না। বাবাদের মনে হয় তাকাতে লজ্জা করে।
সুলতানা ছোটমেয়ের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই মেয়েটার ভাল বুদ্ধি আছে। মেয়েটার বুদ্ধির খবর এই পরিবারে আর কেউ জানে না। শুধু তিনি জানেন। এই নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও আছে। মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না। বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনো সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী।
শামা খুব সহজ ভঙ্গিতেই চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। সে ধরেই নিয়েছিল ঘরে ঢোকা মাত্র সবাই এক সঙ্গে তার দিকে তাকাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার হাত পা শক্ত হয়ে যাবে। দেখা গেল সবাই তার দিকে তাকাল না। আতাউর নামের ছেলেটা মাথা নিচু করেই বসেছিল, সে মাথাটা আরো খানিকটা নিচু করে ফেলল। শামা তার দিকে এক ঝলক তাকাল। এক ঝলকে তার অনেকখানি দেখা হয়েছে।
ছেলেটা ছায়ার কচুগাছের মতো ফর্সা। হাতের নীল নীল শিরা বের হয়ে আছে। অতিরিক্ত রোগা। ঘুমের সমস্যা মনে হয় আছে। চোখের নিচে কালি। বাম চোখের নিচে বেশি কালি। ডান চোখে কম। মাথায় অনেক চুল আছে। চেহারা ভাল। গোফ নেই— এটাও ভাল। পুরুষ মানুষের নাকের নিচে গোঁফ। দেখলেই শামার গা শিরশির করে। মনে হয় ঘাপটি মেরে মাকড়সা বসে আছে। তাড়া দিলেই নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে যাবে।
কালো আচকান পরা মুখভর্তি দাড়ি এক ভদ্ৰলোক শামার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে মা, আমাদের জন্যে চা নিয়ে চলে এসেছ। কেমন আছ গো মা?
শামা বলল, জি, আমি ভাল আছি।
বোস মা, তুমি আমার পাশে বোস। এমন সুন্দর কন্যা পাশে নিয়ে বসাও এক ভাগ্যের ব্যাপার।
আচকান পরা ভদ্ৰলোক সরে গিয়ে শামার জন্যে জায়গা করলেন। শামা সহজ গলায় বলল, আমি খাবারটা হাতে হাতে দিয়ে নি। তারপর বসি।
ঠিক আছে মা। ঠিক আছে। আগে কাজ তারপর বসা, তারপর আলাপ। আর এই জগতে খাওয়ার চেয়ে বড় কাজতো কিছু নেই। কী বলেন আপনারা?
কেউ কিছু বলল না। শুধু আতাউর নামের ছেলেটা কাশতে লাগল। শামা মনে মনে বলল, এই যে খাতাউর ভাইয়া, আপনার এই কাশি ঠাণ্ডার কাশি, না যক্ষাটা আছে?
প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে শামা ভাবল খাবারের প্লেট সবার আগে যিনি মুরুঝি তার হাতে দেয়া দরকার। তা না করে সে যদি যক্ষারোগী খাতাউরের হাতে দেয় তাহলে কেমন হয়? যক্ষারোগী নিশ্চয়ই ভাবছে না তাকে প্রথম দেয়া হবে। তার কাশি আরো বেড়ে যাবে। আচকান পরা মওলানা বেশি ফটফট করছে। মওলানার ফটফটানি কিছুক্ষণের জন্য হলেও কমবে। মওলানা হয়ত মনে মনে বলবে নাউজুবিল্লাহ, মেয়েটাতো মহানিৰ্লজ্জ। বলুক যার যা ইচ্ছা।
শামা খাবারের প্লেট আতাউরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনার কি ঠাণ্ডা লেগেছে? এত কাশছেন কেন?
শামা যা ভেবেছিল তাই হলো। আচকান পরা মওলানা হকচকিয়ে গেলেন। তিনি শামার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন। যক্ষারোগীর কাশি কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেমেছে। শামার বাবাও অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে ঘটনা কী ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।
আচকান পরা মওলানা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, মা শোন, পুরুষ মানুষের কাশিকে তুচ্ছ করতে নাই। পুরুষ মানুষ চেনা যায় কাশি দিয়ে। কথায় আছে–
ঘোড়া চিনি কানে
রাজা চিনি দানে
কন্যা চিনি হাসে
পুরুষ চিনি কাশে।
আতাউরকে চিনতেছি তার কাশিতে আর তোমারে চিনতেছি তোমার হাসিতে। হ্যাঁ হা হা।
শামা লক্ষ করল সবাই হাসতে শুরু করেছে। এমনকি তার বাবাও হাসছেন। যিনি কখনো হাসেন না। কারণ হাসিকে তিনি চারিত্রিক দুর্বলতা মনে করেন। সবাই হাসছে, শুধু যক্ষারোগীর মুখে কোনো হাসি নেই। সে মাথা আরো নিচু করে ফেলেছে।
কালো আচকান পর মওলানা পাত্রের মেজো চাচা। সৈয়দ আওলাদ হোসেন। নেত্রকোনা কোর্টে ওকালতি করেন। তিনিই পাত্রের অভিভাবক। বিয়ের কথাবার্তার সময় পাত্রের অভিভাবকরা ক্ৰমাগত কথা বলেন। সৈয়দ সাহেব তার ব্যতিক্ৰম নন। তিনি দাড়ি কমা ছাড়াই কথা বলে গেলেন এবং বিদায়ের আগে আগে অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। কন্যা আমাদের সবারই অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। শুধু কন্যা পছন্দ হয়েছে বললে ভুল বলা হবে- কন্যার পিতাকেও পছন্দ হয়েছে। বেয়ান সাহেবের সাথে দেখা হয় নাই, তার রান্না পছন্দ হয়েছে। সিঙ্গাড়া অনেক জায়গায় খেয়েছি। এরকম স্বাদের সিঙ্গাড়া খাই নাই। বেয়ান সাহেবকে দূর থেকে জানাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে মোবারকবাদ। এখন বিবাহের তারিখ নিয়ে দুটা কথা। আমি সবচে’ খুশি হতাম আজকে রাতেই বিবাহ দিতে পারলে সেটা সম্ভব না। আমাদের নিজেদের কিছু আয়োজন আছে। আমরাতো শহরের লোক না, গ্রামের লোক। বিয়ে শাদি সবাইকে নিয়ে দিতে হয়। কাজেই বিবাহ হবে ইনশাল্লাহ আষাঢ় মাসে। আবদুর রহমান সাহেব আপনার কিছু বলার থাকলে বলেন। আবদুর রহমান সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আপনারা যা ঠিক করবেন তাই হবে। এই মেয়ে এখন আপনাদের মেয়ে।
আওলাদ হোসেন সবগুলি দাঁত বের করে দিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ–এই যে আপনি বললেন আপনাদের মেয়ে, এতে সব কথা বলা হয়ে গেল। মেয়েতো আমাদের অবশ্যই, আপনাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। হ্যাঁ হা হা।
আওলাদ সাহেব আচকানের পকেট থেকে আংটি বের করে শামার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। শুধু আংটি না, আংটির সঙ্গে খামে ভর্তি টাকাও আছে। এক হাজার এক টাকা।
আওলাদ সাহেব বললেন, এই যে এক হাজার এক টাকা দিলাম এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাস না বললে বুঝবেন না। হয়ত ভাববেন টাকা দিচ্ছে। কেন? ছোটলোক না-কি? এখন ইতিহাসটা বলি। আজ আমাদের খুবই গরিবি হালত। সব সময় এরকম ছিল না। আমার পূর্বপুরুষরা ছিল ঈশ্বরগঞ্জের ন’আনি জমিদার। তাদের নিয়ম ছিল কন্যাকে এক হাজার একটা আশরাফি দিয়ে মুখ দেখা। এই নিয়মতো এখন আর সম্ভব না। তারপরেও পুরনো স্মৃতি ধরে রাখা।
শামা বাবার চোখের ইশারায় তার হবু চাচা শ্বশুরকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে মনে হচ্ছে সে একটা নাটকে পাঠ করছে যে নাটকে তার চরিত্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কোনো সংলাপ নেই। পরিচালক তাকে বুঝিয়েও দেন নি স্টেজে উঠে কী করতে হবে। এক হাজার এক টাকা ভর্তি খামটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে খুবই অস্বস্তি লাগছে। এটা যদি কোনো হাসির নাটক হত তাহলে সে খাম খুলে টাকাগুলি বের করে গুণতে শুরু করত এবং একটা নোট বের করে বলত, এই নোটটা ময়লা, বদলে দিন। কিন্তু এটা কোনো হাসির নাটক না। খুবই সিরিয়াস নাটক। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের একজন। ঈশ্বরগঞ্জের ন’আনি জমিদারের উত্তরপুরুষ সৈয়দ ওয়ালিউর রহমান এখন আবেগে আপুত হয়ে কাঁদছেন এবং রুমালে চোখের পানি মুছছেন। নাটকের আরেক চরিত্র শামার বাবা আবদুর রহমান সাহেবের চোখেও পানি। অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রেরাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মন্টুকে দেখা যাচ্ছে। সে ব্যাপার দেখে পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়েছে। তার হাতে একটা পানির গ্লাস। শামার মনে হল যে কোনো মুহূর্তে সে হাত থেকে পানির গ্লাস ফেলে দেবে। বিয়ের পাকা কথার দিন হাত থেকে পড়ে গ্লাস ভাঙা শুভ না অশুভ কে জানে! শামার হঠাৎ করেই আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করল। তার চেহারাটা কি আগের মতোই আছে না বদলাতে শুরু করেছে? ছেলেদের চেহারা সমগ্র জীবনে খুব একটা পাল্টায় না, কিন্তু মেয়েদের চেহারা পাল্টাতে থাকে। কুমারী অবস্থায় থাকে এক রকম চেহারা, বিয়ের কথাবার্তা ঠিকঠাক হবার সময় হয় অন্য এক রকম চেহারা, বিয়ের পর আরেক রকম চেহারা। মা হবার পর চেহারা আবার পাল্টায়। যখন শাশুড়ি হয় তখন আরেক দফা চেহারা বদল।
আবদুর রহমান সাহেব ভেতরের বারান্দায় রাখা দু’টা বেতের চেয়ারের একটায়। বসে আছেন। অন্যটায় বসেছেন সুলতানা। আবদুর রহমান সাহেবের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সিগারেট খান না। আজ বিশেষ দিন উপলক্ষে মন্টুকে দিয়ে তিনটা সিগারেট আনানো হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সিগারেট টেনে তিনি খুবই মজা পাচ্ছেন। সুলতানা বললেন, চা খাবে? আবদুর রহমান তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চা এক কাপ খাওয়া যায়। তোমার চা বানানোর দরকার নেই। বড় মেয়েকে বল চা বানিয়ে আনুক। বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাজ কর্ম শিখবে না?
সুলতানা বললেন, মেয়েকে এখন আমি মরে গেলেও চুলার কাছে যেতে দেব না। বিয়ের পাকা কথা হবার পর মেয়েদের চুলার কাছে যেতে দেয়া হয় না।
তাই না-কি?
অনেক নিয়মকানুন আছে। চুল খোলা রেখে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। রাতে বিছানায় একা থাকা নিষেধ।
বল কী! জানতাম নাতো।
সুলতানা চা বানানোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। আবদুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, চা কিন্তু দুই কাপ আনবে। চা খেতে খেতে বুড়োবুড়ি গল্প করি। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এখনতো আমরা বুড়োবুড়িই তাই না? আর এশাকে একটু পাঠাও ওর সঙ্গে কথা আছে।
ওর সঙ্গে কী কথা?
আছে, কথা আছে। সব কথা তোমাকে বলা যাবে না-কি? বাপ-মেয়ের আলাদা কথা থাকবে না! শুধু মা-মেয়ে রাত জেগে গুটুর গুটুর, তা হবে না। হা। হ্যাঁ হা।
স্বামীর আনন্দ দেখে সুলতানার মন কেমন কেমন করতে লাগল। অনেকদিন পর মানুষটাকে তিনি এত আনন্দিত দেখলেন। মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় কোনো বাবা কি এত আনন্দিত হয়। তিনি নিজে আনন্দ পাচ্ছেন না। ছেলেটাকে তার তেমন পছন্দ হয় নি। তার ধারণা শামার মতত রূপবতী মেয়ের জন্য অনেক ভাল পাত্র পাওয়া যেত। একটু শুধু খোঁজ খবর করা। মানুষটা আর কিছুই করল না। অফিসের কোনো একজনকে ধরে এনে বলল, এর সাথে বিয়ে।
এশা বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। আবদুর রহমান হাসিমুখে তার কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর আপার বিয়েতো ঠিক হয়ে গেল। নেক্সট টার্গেট তুই। তৈরি হয়ে যা।
এশা গম্ভীর মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার হালকা রূপ দেখে সে অভ্যস্ত না। তার অস্বস্তি লাগছে।
ছেলেটাকে কেমন দেখলি?
ভাল।
শামা কি কিছু বলেছে ছেলে পছন্দ হয়েছে কি-না।
না কিছু বলে নি।
ও আছে কোথায়?
দোতলায়। বাড়িওয়ালা চাচার বাসা থেকে কাকে যেন টেলিফোন করবে।
আবদুর রহমান টেলিফোনের কথায় নড়েচড়ে বসলেন। খুবই আগ্রহের সঙ্গে গলা সামান্য নামিয়ে বললেন, এক কাজ করতে পাঞ্জাবির পকেটে আমার মানিব্যাগ আছে। মানিব্যাগ খুলে দেখ–হলুদ এক পিস কাগজ আছে। কাগজে টেলিফোন নাম্বার লেখা। কাগজটা শামাকে দিয়ে দিস।
কার টেলিফোন নাম্বার? ঐ ছেলের?
হ্যাঁ আতাউরের। সে তার বড়ববানের সঙ্গে এখন আছে। বড়বোনের টেলিফোন নাম্বার। শামা যদি ছেলের সঙ্গে কিছু বলতে চায় বলুক। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে, এখন টেলিফোনে কথাবার্তা বলা দোষনীয় কিছু না। তবে দেখা সাক্ষাৎ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
আর কিছু বলবে বাবা?
আবদুর রহমান সাহেবের মেয়ের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল। মেয়েদের সঙ্গে দিনের পর দিন তার কোনো কথা হয় না। কথা বলার মতো সুযোগই তৈরি হয় না। আজ একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি সুযোগটা ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। সেটা সম্ভব হলো না। এশা তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বোধ করছে না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচে। যেন সে বাবার সঙ্গে কথা বলছে না, কথা বলছে তার স্কুলের রাগী এসিসটেন্ট হেডমাস্টারের সঙ্গে।
আবদুর রহমান সাহেবের মন সামান্য খারাপ হলো, তবে তিনি মন খারাপ ভাবটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। মেয়েরা বড় হলে বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। জগতের অনেক সাধারণ নিয়মের মধ্যে একটা নিয়ম হলো মেয়েরা বড় হলে মা’র দিকে ঝুঁকে পড়ে, ছেলেরা ঝুঁকে বাবার দিকে। তাঁর ক্ষেত্রে এটাও সত্যি হয় নি। মন্টু তার ধারে কাছে আসে না। মন্টু হয়ত টিভি দেখছে, বাবার পায়ের শব্দ শুনলে ফট করে টিভি বন্ধ করে দেবে। চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকবে। বাবা ঘরে ঢুকলে সে উঠে পাশের ঘরে চলে যাবে। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আবদুর রহমান ঠিক করলেন এখন থেকে সম্পৰ্ক সহজ করার চেষ্টা করবেন। মন্টকে সঙ্গে নিয়ে মাঝে মধ্যে টিভি প্রোগ্রাম দেখবেন। ডিশের লাইন না-কি নিয়েছে অনেক কিছু দেখা যায়। তাই বাপ বেটায় মিলে দেখবেন। তিনি এখনো কিছু দেখেন নি। টিভির সামনে বসলেই তার মাথা ধরে যায়। মনে হয় চোখের কোনো সমস্যা। ডাক্তার দেখাতে হবে। ছানি পড়ার বয়স হয়ে গেছে। চোখে ছানি পড়ে গেছে হয়ত।
সুলতানা চা নিয়ে এলেন না। মন্টু এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে দাঁড়াল। সে চায়ের কাপটা বাবার হাতে দেবে না মেঝেতে নামিয়ে রাখবে সেটা বুঝতে পারছে না। বাবার সামনে কোনো টেবিল নেই।
আবদুর রহমান ছেলের হাত থেকে কাপ নিতে নিতে বললেন, তোর মা কোথায়?
রান্না করছেন।
আবদুর রহমান বিরক্ত বোধ করলেন। ছেলেকে দিয়ে চা পাঠানো ঠিক হয় নি। বাবাকে চা নাশতা দেয়া মেয়েদের কাজ। ছেলেকে দিয়ে এইসব কাজ করালে ছেলেদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব চলে আসে। আজকাল একটা কথা খুব পুনতে পাচ্ছেন ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, ছেলেও যা মেয়েও তা। খুবই হাস্যকর কথা বলে তার মনে হয়। ছেলেমেয়ে যদি একই হয় তাহলে ছেলেগুলি মেয়েদের মতো শাড়ি ব্লাউজ পরে না কেন?
মন্টু চলে যাচ্ছিল, আবদুর রহমান বললেন, এই তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে রে?
মন্টু বাবার দিকে তাকাল না। চলে যেতে যেতে বলল, ভাল।
তার একটাই ভয়, বাবা যদি ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করে বসেন! আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালেন। এবারের চা ভাল হয় নি। তিতা তিতা লাগছে। সিগারেট টেনেও মজা পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে। ভ্যাম্প সিগারেট।
শামাদের বাড়িওয়ালা মুত্তালিব সাহেবের বয়স পঁচপঞ্চাশ। তিনি চুলে কলপ দিয়ে রঙিন শার্টটার্ট পরে বয়সটাকে কমিয়ে রাখার নানান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। বয়স মোটেই কম দেখাচ্ছে না। বরং যা বয়স তার চেয়েও বেশি দেখাচ্ছে। এই বয়সে কারোই সব দাঁত পড়ে না। তার প্রায় সব দাতই পড়ে গেছে। সামনের পাটির দুটা দাঁত ছিল। বাঁধানো দাঁত ফুল সেট থাকলে অনেক সুবিধা এই রকম বুঝিয়ে দাঁতের ডাক্তার সেই দুটা দাতও ফেলে দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে তিনি বাঁধানো দাত পরেন। তার কাছে মনে হয় তিনি কলকজা মুখে নিয়ে বসে আছেন। তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছে প্রতিদিন খুব কম করে হলেও এক থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করতে হবে। তিনি হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না কারণ মাস তিনেক হলো ডান পায়ের হাঁটু বাঁকাতে পারছেন না। হাঁটু বাঁকাতে মালিশ এবং চিকিৎসা চলছে, কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে, হাঁটু শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার আগে সামান্য বাঁকত, এখন তাও বাকছে না। একটা লোহার মতো শক্ত পা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে তিনি নিশ্চয়ই মর্নিং ওয়াক বা ইভিনিং ওয়াক করতে পারেন না?
তিনি একটা হুইল চেয়ার কিনেছেন। বেশির ভাগ সময় হুইল চেয়ারে বসে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যান। আবার ফিরে আসেন। সময় কাটানোর জন্যে একটা বাইনোকুলার কিনেছেন। বাইনোকুলার চোখে দিয়ে রাস্তার লোক চলাচল দেখেন। বাইনোকুলার চোখে লাগালেই রাস্তার লোকজন চোখের সামনে চলে আসে। তখন তাদের সঙ্গে গম্ভীর গলায় কথাবার্তা বলেন এই যে চশমাওয়ালা, মাথাটা বাঁকা করে আছেন কেন? ঘাড়ে ব্যথা? রাতে বেকায়দায় ঘুমিয়েছিলেন?
ভদ্রলোক বাড়িতে একা থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হয় নি বলে পনেরো বছর আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তিনি নিজে ডিভোর্সের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের সাত বছর বয়সের একটা মেয়ে আছে। ডির্ভোস হলে মেয়েটা যাবে কোথায়? কিন্তু মুত্তালিব সাহেবের স্ত্রী হেলেনা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলেন। উঁকিল এনে ডিভোর্সের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তিনি অন্ন স্পর্শ করবেন না। হেলেনা ডিভোর্সের দু’বছরের মাথায় আবারো বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে তাঁর জীবন সুখেই কাটছে বলে মনে হয়। এই ঘরে ছেলে মেয়ে হয়েছে। দুই ছেলে এক মেয়ে। বিস্ময়কর মনে হলেও সত্যি তিনি প্রায়ই তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।
মুত্তালিব সাহেবের একটাই মেয়ে মীনাক্ষি। হেলেনার দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি মীনাক্ষীকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দেন। মীনাক্ষীর বয়স তখন আট। সে এমনই কান্নাকাটি শুরু করে যে তিনি নিজেই মেয়েকে তার মা’র কাছে রেখে আসেন এবং হুঙ্কার দিয়ে বলেন, তোকে যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখি তাহলে কিন্তু কাচা খেয়ে ফেলব। আর খবরদার আমাকে বাবা ডাকবি না। গোঁফওয়ালা যে ছাগলটার সঙ্গে তার মা’র বিয়ে হয়েছে তাকে বাবা ডাকবি। আমাকে নাম ধরে ডাকবি। মিস্টার মুত্তালিব ডাকবি। ফাজিল মেয়ে।
সেই মীনাক্ষী এখন থাকে স্বামীর সঙ্গে নিউ অর্লিন্সে। টেলিফোনে বাবার খোঁজ খবর প্রায়ই করে। মুত্তালিব সাহেব কখনো টেলিফোন করেন না। কারণ তিনি মেয়ের টেলিফোন নাম্বার বা ঠিকানা জানেন না। কখনো জানার আগ্রহ বোধ করেন নি। ভদ্রলোক যৌবনে নানান ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন। কোনোটিই তেমন জমে নি। জীবনে শেষ বেলায় তাঁর সঞ্চয় অতীশ দীপংকর রোডে দু’তলা একটি বাড়ি। তেরশ সিসির লাল রঙের একটা টয়োটা এবং ব্যাংকে কিছু ফিক্সড ডিপোজিট। এক সময় ভেবেছিলেন ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের টাকায় জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন। এখন তা ভাবছেন না। প্রায়ই তাকে মূল সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে।
মুত্তালিব সাহেব শামা মেয়েটিকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি চান না তাঁর পছন্দের কথাটা শামা জানুক। শামার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি তটস্থ হয়ে থাকেন। তাঁর একটাই চিন্তা অস্বাভাবিক মমতার ব্যাপারটা তিনি কীভাবে গোপন রাখবেন। তার ধারণা এই কাজটা তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবেই করছেন। বাস্তব সে রকম না। শামা ব্যাপারটা খুব ভাল মতো জানে।
বিকেলে শামাকে দোতলায় উঠতে দেখে তিনি ধমকের গলায় বললেন, টেলিফোন করতে এসেছি? তোক একবার বলেছি এটা পাবলিক টেলিফোন না।
শামা বলল, টেলিফোন করতে আসি নি। আপনার পায়ের অবস্থা জানতে এসেছি। পায়ের অবস্থা কী? হাঁটু কি বাঁকা হচ্ছে না আগের মতোই আছে?
মুত্তালিব সাহেব জবাব দিলেন না।
শামা বলল, এরকম রাগী রাগী মুখ করে বসে আছেন কেন?
মুত্তালিব সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মাথা ধরেছে। তুই কথা বলিস নাতো। তোর ক্যানক্যানে গলা শুনে মাথা ধরা আরো বেড়ে যাচ্ছে। তুই যে জন্যে এসেছিস সেটা শেষ করে বিদেয়।
আমি কী জন্যে এসেছি?
টেলিফোন করতে এসেছিল। তৃণা না কতগুলি মেয়ে বান্ধবী ভাল জুটিয়েছি। বেয়াদবের এক শেষ।
আপনার সঙ্গে কী বেয়াদবি করল?
রাত সাড়ে এগারোটার সময় টেলিফোন করে বলে, আপনাদের একতলায় যে থাকে, শামা নাম, তাকে একটু ডেকে দিনতো। কোনো স্লামালাইকুম নেই। কিছু নেই।
আপনি কী করলেন? খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন?
আমি বললাম, রাত সাড়ে এগারোটা বাজে এটা আড়ার সময় না ঘুমাতে যাবার সময়। বিছানায় যাও–ঘুমাবার চেষ্টা কর।
এটা বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন।
খট করে রাখলাম না, যেভাবে রাখতে হয় সেভাবেই রাখলাম। তুই দুনিয়ার মানুষকে আমার টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছিস এটা ঠিক না।
আর দেব না।
যাদেরকে দিয়েছিস তাদের বলে দিবি কখনো যেন এই নাম্বারে তোকে খোঁজ না করে।
আচ্ছা বলে দেব। আপনি দয়া করে রাগে দাঁত কিড়মিড় করবেন না। আপনার ফলস দাঁত খুলে পড়ে যাবে।
শামা হাসছে। মুত্তালিব সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটা খুবই সুন্দর করে আসছে। দেখলেই মায়া লাগে। মুত্তালিব সাহেবের এখন বলতে ইচ্ছে করছে— শামা শোন, তোর বন্ধুদের বলিস টেলিফোন করতে। আমি তাকে ডেকে বে।
শামা বলল, চাচা, ডাক্তার যে আপনাকে বলেছে দেয়াল ধরে হাঁটতে, আপনি কি হাঁটছেন?
না।
আসুন আমার হাত ধরে ধরে হাঁটুন। প্রতিদিন আমি আধঘণ্টা করে আপনাকে হাঁটা প্র্যাকটিস করা।
তার বদলে আমাকে কী করতে হবে?
তার বদলে আপনি আমাকে আধঘণ্টা করে টেলিফোন করতে দেবেন। ঠিক আছে চাচা?
না, ঠিক নেই। আজ বিকেলে তাদের এখানে কে এসেছিল? খাতাউর সাহেব এসেছিলেন। খাতাউরটা কে?
এখনো কেউ না তবে ভবিষ্যতে আমার হাসবেন্ড হয়ে আসরে নামতে পারেন। সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
মুত্তালিব সাহেব হুইল চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। কনে দেখার মতো বড় একটা ব্যাপার ঘটেছে অথচ কেউ তাকে খবর দেয় নি! খবর পাঠালে তিনি কি উপস্থিত হতেন না? হাঁটুতে সমস্যা তাই বলে হাঁটাহাটিতো পুরোপুরি বন্ধ না।
ছেলে কী করে?
বাবার অফিসে চাকরি করে।
দেশ কোথায়?
দেশ হলো বাংলাদেশ।
কোন জেলা, গ্রামের বাড়ি কোথায়?
জানি না। ছেলের নাম কি সত্যি খাতাউর?
জ্বি না। ভাল নাম আতাউর তবে সব মহলে খাতাউর নামে পরিচিত।
শামা আবারো হাসছে। মুত্তালিব সাহেব শামার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে আছেন। হাসি খুশি এই মেয়েটা বিয়ের পর নিশ্চয়ই তার কাছে আসবে না। সহজ ভঙ্গিতে গল্প করবে না।
চাচা!
হুঁ।
আমি কি আজ শেষবারের মতো আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি? আমার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই খবরটা বন্ধুদের দেব।
মুত্তালিব সাহেব শার্টের পকেট থেকে টেলিফোনের চাৰি বের করে দিলেন। তিনি তাঁর টেলিফোন সব সময় তালাবন্ধ করে রাখেন।
শামা সবসময় খুব আয়োজন করে টেলিফোন করে। টেলিফোন সেটের পাশেই ইজি চেয়ার। সে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। টেলিফোন সেটটা রাখে নিজের কোলে। কথা বলার সময় তার চোখ থাকে বন্ধ। চোখ বন্ধ থাকলে যার সঙ্গে কথা বলা হয় তার চেহারা চোখে ভাসে। তখন কথা বলতে ভাল লাগে।
হ্যালো তৃণা?
হুঁ। কী করছিলি? কিছু করছিলাম না। আচার খাচ্ছিলাম।
কীসের আচার?
তেঁতুলের আচার। খাবি?
হুঁ খাব।
শামা হাসছে। তৃণাও হাসছে। শামা তার বিয়ের খবরটা কীভাবে দেবে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। তৃণা বলল, ১৭ তারিখের কথা মনে আছে? মীরার বিয়ে।
হুঁ মনে আছে।
বাসা থেকে পারমিশন করিয়ে রাখবি। আমরা সারা রাত থাকব। খুব হুল্লোড় করব। জিনিয়া বলেছে সে তার বাবার কালেকশন থেকে এক বোতল শ্যাম্পেন নিয়ে আসবে। দরজা বন্ধ করে শ্যাম্পেন খাওয়া হবে।
সারারাত থাকতে দেবে না।
অবশ্যই দেবে। না দেবার কী আছে? তুই তো কচি খুকি না।
আমাদের বাসা অন্যসব বাসার মতো না।
কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না। যেভাবেই হোক পারমিশন আদায় করবি।
আচ্ছা দেখি।
তুই একটু ধরতো শামা, আমার হাতের তেঁতুল শেষ হয়ে গেছে। তেঁতুল নিয়ে আসি। এক মিনিট।
শামা টেলিফোন ধরে বসে রইল, তৃণা ফিরে এল না। তৃণার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলে এ ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। তৃণা কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ বলে, ‘এক মিনিট, ধর। আমি আসছি। আর আসে না। তৃণা কি এটা ইচ্ছা করে করে? যাদের সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না তাদের সঙ্গে এ ধরনের ট্রিকস করে।
আবদুর রহমান সাহেব দশটা বাজতেই ঘুমুতে যান। আজ ঘুমুতে গেলেন সাড়ে এগারোটায়। হিসেবের বাইরের দেড় ঘণ্টা কাটালেন টিভি দেখে। কোনো একটা চ্যানেলে বাংলা ছবি হচ্ছিল। মাঝামাঝি থেকে দেখতে শুরু করেছেন। দেখতে তেমন ভাল লাগছে না, আবার খারাপ লাগছে না। তার ইচ্ছা করছিল স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সঙ্গে নিয়ে ছবি দেখেন। সেটা সম্ভব হলো না। মন্টু বলল, তার পরীক্ষা সে টিভি দেখবে না। এশা বলল, সে বাংলা ছবি দেখে না। শামা বলল, তার মাথা ধরেছে। তিনি একা একাই টিভির সামনে বসে রইলেন। সিনেমার গল্পে মন দেবার চেষ্টা করলেন। বড়লোক নায়ক গাড়ি একসিডেন্ট করে অন্ধ হয়ে গেছে। তার সেবা শুশ্ৰুষা করার জন্যে অসম্ভব রূপবতী এক নার্স বাড়িতে এসেছে। নার্স ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেছে। অথচ ছেলেটির অন্য এক প্রেমিকা আছে। গল্পে নানান ধরনের জটিলতা। এর মধ্যে নায়কের এক বন্ধু আছে, যার প্রধান দায়িত্ব হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করে লোক হাসানো। যেমন সে ফ্রিজের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ ফ্রিজ থেকে পানির বোতল আনতে গেলে সে নিজেই হাত বের করে বোতল তুলে দেয়। আবদুর রহমান নায়কের বন্ধুর অভিনয়ে খুবই মজা পেলেন। যে ক’বার তাকে পর্দায় দেখা গেল সে কবারই তিনি প্রাণ খুলে হাসলেন।
শামা মা’কে বলল, বাবার বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কী রকম বিশ্রী করে হাসছে! মা তুমি বাবার মাথায় পানি ঢেলে বিছানায় শুইয়ে দাও।
সুলতানা হাসলেন। শামা বলল, হাসির কথা না মা। আমার সত্যি ভাল লাগছে না।
সুলতানা বললেন, তোর বিয়ে ঠিক হওয়ায় বেচারা খুবই খুশি হয়েছে। খুশি চাপতে পারছে না বলে এ রকম করছে।
আমারতো মা কোনো রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না। কেরানি টাইপ একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে।
তোর বাবার খুবই পছন্দের ছেলে। মাঝে মাঝে এরকম হয়—কারণ ছাড়াই কোনো একজনকে মনে ধরে যায়।
কারণ ছাড়া কিছু হয় না মা। সব কিছুর পেছনে কারণ থাকে। মাঝে মাঝে কারণটা বোঝা যায়। মাঝে মাঝে বোঝা যায় না।
তোর কি ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে?
না।
তোর বাবাতো এক্কেবারে বিয়ের তারিখ টারিখ করে ফেলল।
করলেও কোনো লাভ হবে না। আচ্ছা মা শোন, ওরা যে এক হাজার এক টাকা দিয়ে গেছে এই টাকাটা আমি খরচ করে ফেলি? | সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শামা বলল, আমার এক বান্ধবীর বিয়ে। তার বিয়েতে উপহার কিনতে হবে।
সুলতানা শামার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের প্রশ্নটা আবার করলেন, ছেলে। কি তোর মোটেও পছন্দ হয় নি?
না হয় নি।
তাহলেতো তোর বাবাকে বলা দরকার। অপছন্দের একজনকে কেন বিয়ে করবি?
বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই। যেহেতু আমার পছন্দের কেউ নেই, আমি শেষটায় খাতাউরের গলা ধরে ঝুলে বসতেও পারি। মা শোন, আমি কি ঐ এক হাজার এক টাকাটা খরচ করতে পারি?
তোর টাকা তুই খরচ করবি এবার জিজ্ঞেস করার কী আছে?
আমার ঐ বান্ধবীর বিয়ে হবে উত্তরায়। আমরা সারারাত থেকে খুব হুল্লোড় করব। বাবার কাছে বলে আমার ভিসা করিয়ে রাখবে।
আমি কিছু বলতে পারব না। তুই নিজে বলবি। তোর বাবা রাজি হবে বলে আমার মনে হয় না। আর শোন তুই তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে তারপর ঘুমুতে যা।
কেন?
তুই বাড়িওয়ালার বাসায় ছিলি, তোর বাবা কয়েকবার তোকে খোঁজ করেছে। মনে হয় কিছু বলবে।
বাবা খেজুরে আলাপ করবে। খেজুরে আলাপ আমার একদম পছন্দ না।
এইভাবে কথা বলছিস কেন— ছিঃ!
খালি হাতে বাবার সামনে যেতে পারব না। পান টান কিছু দাও নিয়ে যাই।
সুলতানা বললেন, এক কাজ কর। তার বাবা যে শাড়িটা এনেছে এটা পরে যা। তোর বাবা খুব খুশি হবে।
শামা হাই তুলতে তুলতে বলল, বাবা এমিতেই খুশি আছে। আরো খুশি করার দরকার নেই। বেলুনে বেশি বাতাস ভরলে বেলুন ব্রাস্ট করে। বাবা এখন। ব্রাস্ট করার পর্যায়ে চলে গেছেন।
শামা খিলখিল করে হাসছে। সুলতানা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের হাসি দেখছেন।
আবদুর রহমান মশারির ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন। বড় মেয়েকে দেখে মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। শামা বলল, বাবা তোমার জন্যে পান এনেছি।
আবদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, পানতো আমি একবেলা খাই। শুধু দুপুরে ভাত খাবার পর। যাই হোক, এনেছিস যখন খেয়ে ফেলি। সমস্যা একটাই আবার দাঁত মাজতে হবে। চলে যাচ্ছিল না-কি? বোস, পান খেতে খেতে গল্প করি।
শামা বসল না। দাঁড়িয়ে রইল। বসলেই বাবা দীর্ঘ কথাবার্তা শুরু করতে পারেন। বাবাকে এই সুযোগ কিছুতেই দেয়া যাবে না। শামার মনে হলো বাবার মেজাজ আজ শুধু যে ভাল তা নী, অস্বাভাবিক ভাল। বান্ধবীর বিয়েতে সারা রাত কাটাবার অনুমতি নিতে হলে আজই নিতে হবে। এ রকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
আবদুর রহমান পান মুখে দিয়ে বললেন, এশার কাছে একটা টেলিফোন। নাম্বার আছে। আতাউরের নাম্বার। যদিও বিয়ের আগে মেলামেশা মোটেও বাঞ্ছনীয় না, তারপরেও বিশেষ কিছু যদি জানতে চাস
শামা বলল, কিছু জানতে চাই না।
আবদুর রহমান বললেন, বিয়ে শাদি পুরোপুরি ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক খোঁজ খবর করে বিয়ে দেবার পর দেখা যায় বিরাট ঝামেলা। স্বামী তেল আর স্ত্রী জল। অঁকাঝাঁকি করলে মিশে আবার কঁকাঝাঁকি বন্ধ করলেই তেল জল আলাদা হয়ে যায়।
শামা বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আবদুর রহমান হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। তার মুখ থেকে পানের রস গড়িয়ে শাদা গেঞ্জিতে পড়ছে। থুতনিতে রস লেগে আছে। তিনি তেল জল বিষয়ক কথাবার্তা বলেই যাচ্ছেন। কী বলছেন নিজেও বোধহয় জানেন না। শামা ভেবে পাচ্ছে না তার বাবা এত খুশি কেন। রহস্যটা কী! সে বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বাবা তােমাকে একটা জরুরি কথা চট করে বলে নেই, পরে ভুলে যাব।
আবদুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী কথা?
আমার এক বান্ধবীর বিয়ে । মীরা নাম। উত্তরায় ওদের বাড়ি। আমরা সব বন্ধুরা দল বেঁধে বিয়েতে যাচ্ছি। মীরা বলে দিয়েছে আমাদের সারা রাত থাকতে হবে।
থাকবি। বন্ধুবান্ধবের বিয়েতে মজা না করলে কার বিয়েতে কবি ? তাের বিয়েতেও ওদের সবাইকে বলবি। গায়ে হলুদের পর থেকে সবাই যেন থাকে। একটা ঘর তোর বন্ধুদের জন্যে ছেড়ে দেব। মেঝেতে টানা বিছানা করে দেব। ঠিক আছে রে মা ?
শামা বলল, ঠিক আছে বাবা। আজকের পত্রিকা পড়েছিল ? হ্যাঁ।
ইদানীং সব পত্রিকায় নতুন একটা ব্যাপার হয়েছে কার্টুন ছাপা হচ্ছে। বেশির ভাগ সময়ই খুব ফালতু টাইপ। মাঝে মাঝে আবার খুবই ভাল ।
আজকেরটা কি ভাল ?
আজকেরটা খুবই ভাল। হাসতে হাসতে অবস্থা কাহিল। ঘটনাটা হলো এক লোকের পা ভাঙা । হাসপাতালে পড়ে আছে। তার বন্ধু গিয়েছে তাকে দেখতে। বন্ধু বলল, কীরে পা কীভাবে ভাঙলি ?
সে বলল, সিগারেট খেতে গিয়ে পা ভাঙলাম। বন্ধু বলল, এটা আবার কেমন কথা? সিগারেট খেতে গিয়ে কেউ পা ভাঙে ? সে বলল, ঘটনাটা হলো সিগারেট খেতে খেতে উলটে পড়ে…
এশা
মিথ্যা দু’রকমের আছে। হঠাৎ মুখে এসে যাওয়া মিথ্যা, আর ভেবে চিন্তে বলা মিথ্যা। হঠাৎ মিথ্যা আপনা আপনি মুখে এসে যায়। কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। ভেবে চিন্তে মিথ্যা বলাটাই কঠিন। এই মিথ্যা সহজে গলায় আসে না। বারবার মুখে আটকে যায়।
শামার মুখে অবশ্যি মিথ্যা তেমন আটকাচ্ছে না। সে গড়গড় করেই বলে যাচ্ছে এবং নিজেও খুব বিস্মিত হচ্ছে। সে কথা বলছে টেলিফোনে। ওপাশে ফোন ধরে আছে আতাউর। মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা মিথ্যা বলতে নেই। শামাকে বলতে হচ্ছে।
শামা বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম এশা। শামা আপু, যার সঙ্গে আপনার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে আমি তার ছোট বোন।
ও আচ্ছা। তুমি কেমন আছ?
ভাল আছি। আপনার টেলিফোন নাম্বার আমি আপাকে দিয়েছিলাম, সে আপনাকে টেলিফোন করবে না। লজ্জা পায়। কাজেই ভাবলাম আমিই করি। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন নাতো?
বিরক্ত হব কেন?
আপনার চেহারা দেখে মনে হয় আপনি অল্পতেই বিরক্ত হন।
আমি অল্পতে কেন বেশিতেও বিরক্ত হই না।
বিরক্ত না হলেই ভাল। কারণ বড় আপুর স্বভাব হলে সবাইকে বিরক্ত করা। আপনাকে সে বিরক্ত করে মারবে। আপনার সঙ্গে সে নানান ধরনের ফাজলামি করবে। আপনার জীবন অতিষ্ট করে তুলবে।
তাই না-কি?
হ্যাঁ তাই। সে আপনাকে কী ডাকছে জানেন? ডাকছে খাতাউর। খাতাউর? হ্যাঁ খাতাউর। আপনাকে ডাকছে ন’আনির জমিদার মি. খাতাউর।
শোন এশা, আমরা জমিদার উমিদার না। আমার চাচার বেশি কথা বলা অভ্যাস। আমার খুবই লজ্জা লাগছে যে তিনি এ ধরনের কথাবার্তা বলেছেন।
এখন জমিদার না হলেও এক সময়তো ছিলেন।
অনেক আগের কথা। আমরা এখন খুবই দরিদ্র মানুষ।
আপনার জমিদারি নিয়ে বড় আপা কিন্তু আপনাকে খুব ক্ষেপাবে। গতকালই আমাকে বলেছে এই এশা, তুই আমাকে আপা ডাকবি না। আমি জমিদারের বউ। আমাকে ডাকবি মহামান্য ন’আনির প্রাক্তন জমিদারনি।
তোমার কথা শুনে আমারতো খুবই লজ্জা লাগছে।
আর আপনি খুব কাশছিলেন তো, এই নিয়েও বড় আপু অনেক মজা করেছে— বলছে খাতাউর সাহেবের যক্ষা আছে। যক্ষা হচ্ছে রাজরোগ। সে রাজা মানুষ, তারতো রাজরোগ থাকবেই। আচ্ছা শুনুন, আপনার কাশি কি কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে।
আপাকে দেখে ঐ দিন আপনার কেমন লেগেছে?
বেশ সুন্দর।
আপনি তো চোখ তুলে আপার দিকে তাকানই নি। আপার ধারণা আপনি পায়ে স্যান্ডেল পরেছিলেন সেই স্যান্ডেলের ফিতার ডিজাইন নিয়ে গবেষণা করে আপনি পুরো সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা শুনুন, নাশতা দেবার সময় আপা যখন সবাইকে বাদ দিয়ে আপনাকে প্রথম প্লেটটা দিল তখন কি একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলেন?
না।
তাহলে আপার হিসেবে ভুল হয়েছে। আপা আপনাকে চমকে দেবার জন্যে এই কাজটা করেছে। সে মানুষকে চমকাতে খুব পছন্দ করে। এখন বুঝতে পারছি আপা আপনাকে চমকাতে পারে নি।
অন্য সময় হলে অবশ্যই চমকাতাম। ঐ দিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিছু বুঝতে পারি নি।
আরেকটা কথা আপনারা যে আপাকে টাকা আর আংটি দিলেন আপনারা যখনই মেয়ে দেখতে যান পকেটে টাকা আংটি নিয়ে যান? আপার ধারণা। আপনারা আগেও অনেক মেয়ে দেখেছেন। প্রতিবারই পকেটে করে টাকা আংটি নিয়ে গেছেন। আপার ধারণাটা কি ঠিক?
হ্যাঁ ঠিক।
আচ্ছা ধরুন, কোনো কারণে বিয়ে হলো না। তখন কি আপনারা টাকা আংটি ফেরত নেবেন?
এমন কথা বলছ কেন?
এমি বলছি। রাগ করবেন না। রাগ করছি না। আমি এত সহজে রাগ করি না।
আপনার সঙ্গে যে আমার এত কথা হয়েছে এটাও আপাকে বলবেন না। সে জানলে খুবই রাগ করবে। আপা চট করে রেগে যায়। আপার স্বভাব আপনার উল্টো। আপনি রাগ করেন না। আপা করে। স্কুলে তার নাম ছিল R K.
R K মানে কী?
R K মানে রাগ কুমারী। আপনি কিন্তু আপাকে কিছু বলবেন না।
আমি কখনো তাকে বলব না।
আচ্ছা শুনুন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আপা যেমন আপনাকে চমকে দিতে চাচ্ছে আপনিও তাকে চমকে দিন। আমি আপনাকে সময় বলে দিচ্ছি। ঠিক দেড়টার সময় আপা কলেজ থেকে বের হয়। কলেজ গেটের সামনে আপনি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনাকে দেখে আপার আক্কেলগুড়ম হয়ে যাবে। আমার ধারণা হাত থেকে বই খাতা ফেলে দেবে।
এই কাজটা আমি করতে পারব না এশা, আমি খুবই লাজুক মানুষ।
তাহলে কী করা যায় বলুন তো?
তোমাকে কিছু করতে হবে না। থ্যাংক য়্যু।
না, আপনাকে করতে হবে। আমি চাই আপনি আপাকে চমকে দিন। আপার একটা শিক্ষা হোক। আপনাকে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়াতে হবে না। একটা কনফেকশনারির দোকান আছে নাম ‘নিরালা’। আপনি দোকানে ঢুকে একটা কোক বা পেপসি খাবেন। আপা সেখানে উপস্থিত হবে।
সে শুধু শুধু সেখানে যাবে কেন?
যাবে কারণ আমি তাকে বলে দেব ঐ দোকান থেকে আমার জন্যে একটা জিনিস আনতে পারবেন?
না, পারব না।
আপনাকে পারতেই হবে। প্লিজ। আগামীকাল দুপুর দেড়টায়। একটা চল্লিশে আপার ক্লাস শেষ হবে। দোকানে আসতে আসতে তার লাগবে দশ মিনিট।
এশা আমি এই কাজটা করতে পারব না।
না পারলে কী আর করা।
আমার অফিস আছে। অফিস কামাই দিয়ে দোকানে বসে কোক খাওয়া!
কোক খাওয়ার জন্যেতো অফিস কামাই দিচ্ছেন না। যে মেয়েটিকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে যাচ্ছেন।
বিয়ের পরতো গল্প করবই।
বিয়ের পর গল্প করা আর বিয়ের আগে গল্প করা কি এক?
এক না?
না এক না। আকাশ পাতাল তফাত।
তুমি বুঝলে কী করে? তুমিতো বিয়ে কর নি।
বিয়ে না করলেও বুঝতে পারছি। এইসব ব্যাপারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে। আপনি যাবেন কিন্তু।
ধর আমি গেলাম। তারপর দেখলাম তোমার আপা আসে নি।
আপা যাবে। আমি ব্যবস্থা করে রাখব। আর না গেলে দেখা হবে না।
তুমি দেখি খুবই ইন্টারেস্টিং মেয়ে।
দুলাভাই আপনি যাবেন তো?
মাই গড এখনি দুলাভাই ডাছ কেন?
একদিনতো ডাকতেই হবে, একটু প্র্যাকটিস করে নেই।
আগেভাগে প্র্যাকটিস করতে হবে না। আমার খুবই লজ্জা লাগছে।
লজ্জা লাগলে ডাকব না। আচ্ছা শুনুন, আপনি কাল যাচ্ছেন তো?
এখনো বলতে পারছি না।
না আপনাকে যেতে হবে। না গেলে আমি খুবই রাগ করব। আমি আপনার একটা মাত্ৰ শালী। আমাকে রাগালে তার ফল শুভ হবে না। টেলিফোন রাখি। অনেকক্ষণ কথা বলে ফেললাম, আপনি বোধহয় আমাকে ফাজিল টাইপ মেয়ে ভাবছেন। দুলাভাই আমি কিন্তু ফাজিল টাইপ না। সরি, আবার দুলাভাই বলে ফেললাম।
শামা টেলিফোন রেখে খানিক্ষণ হাসল। ছোটবোন সেজে টেলিফোন করার এই বুদ্ধিটা হঠাৎ তার মাথায় এসেছে। বুদ্ধিটা যে এমন কাজে লাগবে আগে বুঝতে পারে নি। মানুষটার গলার স্বর সুন্দর। শুনতে ভাল লাগছিল। আরো কিছুক্ষণ কথা বললে হত। আরেক দিন বললেই হবে। প্রথম দিন এত কথা বলা ঠিক না। এশাকে সে ফাজিল মেয়ে ভাববে। এশা মোটেই ফাজিল মেয়ে না।
মুত্তালিব সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন। শামা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মুত্তালিব সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বললি?
শামা হাসল।
মুত্তালিব সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, প্রশ্ন করলে প্রশ্নের জবাব দিবি। হেসে ফেলবি না। এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বললি?
বলা যাবে না।
এ দুনিয়াতে নানান ধরনের ব্যাধি আছে। তার একটা হলো টেলিফোন ব্যাধি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলা ব্যাধি। এটা ভাল না।
আপনার পায়ের অবস্থা কী?
আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম তার জবাব কিন্তু এখনো পাই নি।
আসুন আপনাকে হাঁটাই।
তুই তোর কাজে যা। আমাকে হাঁটাতে হবে না।
আমি টেলিফোনে যতক্ষণ কথা বলেছি ঘড়ি ধরে ঠিক ততক্ষণ আপনাকে হাঁটাব। নগদ বিদায়।
শামা মুত্তালিব সাহেবকে টেনে দাড় করালো। শামা বলল, আমার কাছে হাত রাখুন। আমাকেইতো ধরে আছেন আবার দেয়াল ধরছেন কেন? ভেরি গুড। একী দু’টা পা এক সঙ্গে ফেলছেন কেন? আমি ওয়ান টু বলব। ওয়ান হলো ডান পা, টু হলো বাম পা। ওয়ান-টু। ওয়ান-টু। হাঁটি হাঁটি পা পা।
সুলতানা রান্নাঘরে। আবদুর রহমান সাহেব আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ইলিশ মাছ কিনে এনেছেন। তাঁর হঠাৎ সর্ষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে। কাচা বাজার থেকে রাই সরিষা, কাচা মরিচ কিনেছেন। দুই কেজি আতপ চালও কিনেছেন। সর্ষে ইলিশ না-কি আতপ চালের ভাত দিয়ে খেতে মজা। ইলিশ সর্ষে রান্না হচ্ছে। এশ খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। সুলতানা বললেন, রান্নাঘরে বসে আছিস কেন?
এশা বলল, রান্না শিখছি। মা, আজ আমি রাধব। তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও।
সুলতানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এশার মুখ থেকে অন্ধকার দূর হয়েছে। গত কয়েকদিন চিমসে মেরে ছিল। এখন হাসি খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে। তার যে সমস্যা ছিল সেই সমস্যা নিশ্চয়ই দূর হয়েছে। সুলতানার সামান্য মন খারাপ হলো। তার মেয়েগুলির খুবই চাপা স্বভাব। মনের কথা কেউ মা’র সঙ্গে বলে না।
এশা বলল, লবণের অনুমানটা কীভাবে কর মা? কোনো নিয়ম কি আছে?
সুলতানা বললেন, পুরোটাই আন্দাজ। মাখানোর পর জিবে নিয়ে লবণ দেখে নিতে হয়।
ওয়াক থু, কাচা মাছের রস মুখে দেব? পরে পানি দিয়ে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করবি।
এশা মাছ মাখাচ্ছে। সুলতানা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের কাজ দেখছেন। সময় কত। দ্রুত পার হচ্ছে। এতটুকু মেয়ে ছিল, দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে। একজনের তো বিয়েই ঠিক হয়ে গেল।
মা দেখতে লবণ কি এতটুক দেব?
বেশি হয়ে গেছে। আরো কম। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবি। লবণ কম হলে পরে দেয়া যায়। বেশি হলে কিন্তু কমানো যায় না।
বেশি হলে পানি দিয়ে ঝোল বাড়িয়ে দেব।
সর্ষে বাটায় পানি দিবি কীভাবে?
তাওতো কথা।
সুলতানা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কাচা মরিচের একটা ব্যাপার তোকে শিখিয়ে দেই। কাচা মরিচ আস্ত দিলে মরিচের ঘ্রাণটা তরকারিতে যায়। তরকারি ঝাল হয় না। আর যদি মাঝখান দিয়ে কেটে দিস তাহলে মরিচের ঘ্রাণও যায়
তরকারি ঝালও হয়।
আমরা কী করব মা? ঝাল করব, না মরিচের গন্ধওয়ালা তরকারি করব?
তুই রান্না করছিস, তুই ঠিক কর।
এখাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে ভুরু কুঁচকে আছে। এশা বলল, মা আমার খুব আশ্চর্য লাগছে।
কেন?
সামান্য রান্না, তার মধ্যে ডিসিশান নেয়ার ব্যাপার আছে। আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে কী করব। ঝাল তরকারি করব, না-কি মরিচের ঘ্রাণওয়ালা তরকারি করব। মা, আমি তো খুবই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছি।
সুলতানা তার চিন্তাগ্ৰস্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার খুবই মজা লাগছে।
এশা বলল, মা তুমি যদি এখন বারান্দায় যাও তাহলে খুব মজার একটা দৃশ্য দেখবে।
কী দৃশ্য দেখব?
আপা বাড়িওয়ালা চাচাকে হাঁটা শেখাচ্ছে। ধরে ধরে হাঁটাচ্ছে। আর মুখে মুখে বলছে হাটি হাঁটি পা পা। আপা খুবই মজা পাচ্ছে। বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুত্তালিব সাহেব বেচারা পা নিয়ে ভাল সমস্যায় পড়েছেন। কী অদ্ভুত রোগ— হাঁটু বাঁকে না।
এশা বলল, মা তোমাকে একটা কথা বলব? তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবে। না। যদি প্রমিজ কর রাগ করবে না, তাহলেই কথাটা বলব।
রাগ করার মতো কথা?
হুঁ। আমার কথা শুনে তোমার হয়ত মনে হবে আমার মন ছোট বলে এ ধরনের কথা বলছি।
কথাটা কী? বাড়িওয়ালা চাচার সঙ্গে আপার এত মেশা ঠিক না। মেশামেশি বেশি হচ্ছে।
সুলতানা বিস্মিত হয়ে বললেন, এইসব কী বলছিস! উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। মা ডাকেন।
এশা বলল, মা ডাকলেও ঠিক না। ঠিক না কেন?
আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মা। আমার কাছে মনে হচ্ছে ঠিক না। মুত্তালিব চাচা আপাকে খুব পছন্দ করেন আবার আপাও উনাকে খুব পছন্দ করেন। তুমি কি লক্ষ করেছ দিনের মধ্যে একবার দোতলায় না গেলে আপা থাকতে পারে না?
ও যায় টেলিফোন করতে।
টেলিফোন করতে যাওয়াটা আপার একটা অজুহাত।
তুই বেশি বেশি বোঝার চেষ্টা করছিস এশা। এত বেশি বোঝা কিন্তু ঠিক না। কিছু কিছু মানুষ আছে ভালর মধ্যে মন্দ খুঁজে। তুইও তাদের মতো হয়ে গেলি?
তুমি রেগে যাচ্ছ মা। কথা ছিল তুমি রাগবে না।
আমি রাগি নি। তোর কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। মানুষের সম্পর্ক এত ছোট করে দেখতে নেই।
এশা চুলায় হাড়ি বসাতে বসাতে বলল, মা শোন, একবার মুত্তালিব চাচার। টেলিফোন নষ্ট ছিল। প্রায় এক মাস নষ্ট ছিল। এই একমাসও কিন্তু বড় আপা প্রতিদিন একবার করে দোতলায় গেছে।
তাতে কী হয়েছে?
কিছু হয় নি এম্নি বললাম। তুমি যে বললে আপা টেলিফোন করতে যায় এটা যে ঠিক না তা বোঝানোর জন্যে বললাম। তুমি রেগে যাচ্ছ বলে গুছিয়ে তোমাকে কিছু বলতে পারছি না। মা শোন, আপা যখন শুনবে আজ বাসায় সর্ষে ইলিশ রান্না হচ্ছে সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে মুত্তালিব চাচার জন্যে তরকারি পাঠাতে।
এতে দোষের কী আছে? উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। মেয়ে কি বাবার জন্যে তরকারি নিয়ে যাবে না? এক টুকরা মাছ মানুষটার জন্যে নিয়ে গেলে সেটা দোষের হয়ে যাবে?
এশা বলল, মা সরি। এই প্রসঙ্গটা তোলা ঠিক হয় নি। তোমার মুখ থেকে রাগ রাগ ভাবটা দূর করে সহজভাবে তাকাও। আমার মন আসলেই ছোট। কী আর করা। মা, চা খাবে?
না।
চা খাও। আমি তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। চা বানানোটা আমি ভাল শিখেছি মা। বানাই? প্লীজ।
বললামতো না।
তোমার সঙ্গে আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে মা। কঠিন মুখে না বলবে না। আমিতো স্বীকার করেছি আমার মন ছোট। তারপরেও রাগ করে থাকাটা কি ঠিক?
এশী খালি চুলায় চায়ের কেতলি বসাল। শামা এসে উপস্থিত হলো। খুশি খুশি গলায় বলল, চা হচ্ছে না-কি রে? আমিও চা খাব। আজ কি তুই রান্না করছিস?
হুঁ।
কী রান্না?
সর্ষে ইলিশ।
ইলিশ মাছে ডিম ছিল?
ছিল।
ডিমটা আলাদা করে রাখবি। মুত্তালিব চাচা ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করেন। ডিমটা আমি উনাকে দিয়ে আসব।
আচ্ছা।
সুলতানা এশার দিকে তাকিয়ে আছেন। এশা একবার মা’র দিকে তাকাল না। সে নিজের মনে চা বানাচ্ছে। শামা বলল, মা শোন, চাচাকে একসারসাইজ করিয়ে এসেছি। আমার কী মনে হয় জান মা? আমার মনে হয় একসারসাইজের চেয়েও উনার যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে সেঁক। কাল থেকে একসারসাইজও করাব, সেঁকও দেব।
তুইতো ডাক্তার না। তুই এসবের জানিস কী?
শামা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ছোটখাট ব্যাপার জানার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা।
এশা বলল, আপা তুমি কী আতাউর ভাইকে টেলিফোন করছিলে?
শামা বলল, না। আমার এত গরজ নেই।
বাবা শখ করে টেলিফোন নাম্বার এনেছেন। একবার টেলিফোন কর।
শামা হালকা গলায় বলল, বাবার শখ থাকলে বাবা করুক। আমার শখ নেই।
সুলতানা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে উঠে গেলেন। এশার কথাগুলি শোনার পর থেকে তার ভাল লাগছে না। মনের মধ্যে কী যেন খচখচ করছে। অদৃশ্য কোনো কাটা বিধে আছে।
শোবার ঘর অন্ধকার করে আবদুর রহমান শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের বুড়ো আঙুল এবং নাক এক লাইনে। সুলতানা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে শরীর খারাপ না-কি?
আবদুর রহমান উঠে বসতে বসতে বললেন, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। মুখের ভেতরটা টক টক লাগছে।
জ্বর আসে নি তো?
না।
চা খাবে? নাও চা খাও, রান্নার দেরি হবে।
অসুবিধা নেই, তোক দেরি।
আজ এশা রান্না করছে।
ও রান্না জানে?
জানে না, শিখবে। তোমার বড় মেয়ের রান্নাবান্নায় আগ্রহ নেই। এশার আছে।
দুই মেয়েকেই শিখিয়ে দাও। আজকালকার মেয়েরা সব শিখতে রাজি, শুধু রান্না শিখতে রাজি না। রান্না শেখাটা খুব দরকার।
আমার মেয়েরা আজকালকার মেয়ের মতো না।
আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের খোঁজ নিয়েছি। এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মতো আছে। এতে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না?
সব টাকা এক মেয়ের পেছনে খরচ করে ফেলবে? তোমার তো আরো একটা মেয়ে আছে।
প্রথম বিয়ে একটু ধুমধাম করে দেই। আমি ঠিক করেছি বিয়ের পর মেয়ে। জামাইকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব। পালকির ব্যবস্থা করব। পালকি করে জামাই-বৌ যাবে। গ্রামের মানুষ ভিড় করবে।
পালকি পাবে কোথায়? দেশে কি পালকি আছে?
আমাদের এদিকে আছে। গ্রামের বাড়িটাও এই উপলক্ষে ঠিক করতে হবে। গ্রামের মানুষরা তো আর দলবেঁধে বিয়েতে আসতে পারবে না। একটা গরু জবহ করে ওদের খাইয়ে দেব।
তার কি দরকার আছে?
আছে। দরকার আছে। সুলতানা শোন, এর মধ্যে আতাউরকে বলি একবেলা এসে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাক।
বল।
অফিস থেকে ফেরার সময় ওকে নিয়ে আসব। রাতে খেয়ে দেয়ে যাবে। গল্প-গুজব করবে। আমিতো আর গল্প করতে পারি না। তোমরা করবে।
আচ্ছা।
তোমার কিছু স্পেশাল রান্না যে আছে সেগুলি কর। শাশুড়ির হাতের রান্না খেয়ে বুঝুক রান্না কাকে বলে! কলার থোর বেটে তুমি যে জিনিসটা কর ওটা করবে। আর মাছের টকও রাঁধবে। নেত্রকোনার ছেলেতো শুটকি পছন্দ করবে। বেগুন দিয়ে শুটকি করবে।
আবদুর রহমান চায়ের কাপ নামিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সুলতানা বললেন, কী হয়েছে?
বমি আসছে।
বলতে বলতেই তিনি ঘর ভাসিয়ে বমি করলেন।
মন্টু সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে টিভিতে এক্স ফাইল দেখছে। টিভির এই প্রোগ্রামটি তার খুব পছন্দের। সপ্তাহে একদিন মাত্র দেখায়। আজ না দেখতে পেলে আরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ আছে। মানুষটা অনেকবার বমি করে এখন শুয়ে আছে। তাঁর ঘর অন্ধকার। মা তাঁর মাথার চুলে ইলিবিলি করে দিচ্ছে। আর সে কি-না টিভি দেখছে! কাজটা খুবই অন্যায়। মন্টুর নিজের কাছেই খারাপ লাগছে কিন্তু সে টিভি বন্ধ করতে পারছে না। সে অবশ্য তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে। ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছে। তারপরেও টিভি দেখাটা ঠিক হচ্ছে না। বড় আপা তাকে একবার দেখে গেছে। বড় আপা কিছু বলে নি। বড় আপা যদি বলত–এই টিভি বন্ধ কর সে বন্ধ করে দিত। বাবার ঘরের দরজা বন্ধ। টিভির সাউন্ড সে ঘরে যাচ্ছে না। তাছাড়া সে সাউন্ড কমিয়ে রেখেছে। নিজেই কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বাবার শুনতে পাবার কোনো কারণ নেই।
মন্টু টিভি দেখে স্বস্তি পাচ্ছে না। বারবার চমকে চমকে উঠছে। মনে হচ্ছে। এই বুঝি বাবা বের হয়ে আসবেন! বের হয়ে তিনি কিছুক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলবেন আমি মারা যাচ্ছি আর তুই টিভি দেখছি! টিভিটা এতই জরুরি। দেখতেই হবে? বাবা অবশ্যি মারা যাচ্ছে না। দু’তিনবার বমি করলে কেউ মারা যায় না। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, আজেবাজে খাবার খেয়ে পেট গরম হয়েছে। তিনি ওরস্যালাইন খেতে দিয়েছেন। আর ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন।
খট করে শব্দ হলো। বাবার ঘরের দরজা খুলছে। মন্টু টিভির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টিভি বন্ধ করল। সুলতানা বের হয়ে এলেন। তিনি সহজ গলায় বললেন, পড়তে যা। টিভির সামনে বসে আছিস কেন? বলেই তিনি মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন। মন্টু আবারো টিভি ছাড়ল। এক্স ফাইলে আজকের গল্পটা খুবই জটিল। এক লোকের অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। সে তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সব সময় পারে না। ইচ্ছা শক্তি খাটাতে হলে তার আশেপাশে গাছ লাগে। টবে বসানো গাছ হলেও হয়। ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগানোর পর গাছটা মরে যায়। মন্টু টিভির পর্দার সঙ্গে প্রায় চোখ লাগিয়ে আছে। সাউন্ডটা আরেকটু বাড়াতে পারলে ভাল হত। সেটা ঠিক হবে না।
সুলতানা মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন। শামা বলল, বাবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
সুলতানা বললেন, হ্যাঁ ঘুমুচ্ছে।
তুমি ভাত খেয়ে নাও।
আমি খাব না। ক্ষিধে নেই।
এশা বলল, মা শোন, খেতে যাও। বাবার শরীর খারাপ করেছে বলে বাবা খাচ্ছে না। তাই বলে তুমিও খাবে না এটা কেমন কথা?
বললাম না ক্ষিধে নেই।
খেতে বসলেই ক্ষিধে হবে। আমি এত আগ্রহ করে রান্না করেছি তুমি খাবে না এটা কেমন কথা!
তোর বাবা শখ করে মাছটা এনেছে। সরিষা বাটা রান্না হবে বলে সরিষা কিনে এনেছে। সে খেতে পারল না, আর আমি খাব এটাই বা কেমন কথা!
এশা ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলল, না খেয়ে তুমি কী প্রমাণ করতে চাচ্ছি মা? তুমি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছ যে বাবার সঙ্গে তোমার গভীর প্রণয়?
আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। ক্ষিধে মরে গেছে, খেতে ইচ্ছা করছে না বলে খাব না। ভোরা ঘুমুতে যা।
সুলতানা চলে গেলেন। শামা এশার দিকে তাকিয়ে বলল, মা এই কাজগুলো যে করে, মন থেকে করে, না দায়িত্ব থেকে করে?
এশা বলল, তোমার বিয়ে হোক, তখন তুমি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। শামা বাতি নিভিয়ে বিছানায় গেল। এশা বলল, আমরা আজ এত সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম, ঘুমতো আসবে না।
আয় শুয়ে শুয়ে গল্প করি। এশা তুই কি একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, বাতি নিভিয়ে গল্প করতে এক রকম লাগে আবার বাতি জ্বালিয়ে গল্প করতে অন্য রকম লাগে? একই গল্প শুধুমাত্র বাতি জ্বালানো নিভানোর কারণে দু’রকম হয়ে যায়?
এশা বলল, মুত্তালিব চাচার কি ইলিশ মাছের ভিম পছন্দ হয়েছিল?
শামা বলল, খুব পছন্দ হয়েছে। চেটেপুটে খেয়েছেন। তুই রান্না করেছি শুনে বলল তোকে একটা মেডেল দেবে। রুপার মেডেল। মেডেলে লেখা থাকবে- দ্ৰৌপদী পদক।
দ্ৰৌপদী কি খুব ভাল রাঁধতেন?
হুঁ।
উনার পাঁচটা স্বামী ছিল না।
হুঁ।
এশা হাসছে। শামা বলল, হাসছিস কেন? এশা বলল, বেচাৰি দ্ৰৌপদীর কথা ভেবে হাসছি। সে কী বিপদেই না ছিল! পাঁচটা স্বামীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখাতো সহজ কথা না। একটা স্বামীকেই ভুলানো যায় না, আর পাঁচ পাঁচটা স্বামী। কোনো স্বামী হয়ত লাজুক, সে স্ত্রীকে একভাবে চাইবে। আবার কোনো স্বামী নির্লজ্জ, সে চাইবে অন্যভাবে।
শামা বলল, এশ চুপ করতো, তোর মুখে এই ধরনের কথা একেবারেই মানাচ্ছে না।
কেন? তোমার কাছে কি মনে হয় আমি এখনো ছোট?
ছোটইতো।
আমি অনেক বড় হয়ে গেছি আপা। যতটা বড় তুমি আমাকে ভাব, আমি তার চেয়েও বড়। তুমি তো এখনো বিয়ে কর নি। আমি কিন্তু বিয়ে করে ফেলেছি।
শামা উঠে বসতে বসতে বলল, তার মানে?
এশা কিছু বলল না, হাসল। অন্ধকারে তাঁর হাসি শোনা গেল। শামা বলল, এই তুই কি ঠাট্টা করছিস?
এ রকম ঠাট্টা করবি না। তুই যেভাবে বললি— আমার মনে হলো সত্যি বুঝি কিছু করে ফেলেছিস।
এশা বলল, আমি যা করি খুব চিন্তা ভাবনা করে করি। ইচ্ছা হলো আর হুট করে ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম আমার বেলায় এ রকম কখনো হবে না। যদি আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করি তাহলে বুঝতে হবে এটা ছাড়া। আমার হাতে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
তুই কি গোপনে বিয়ে করেছিস?
না এখনো করি নি, তবে…
তবে আবার কী?
বিয়ে করব।
ছেলেটা কে?
এশা হাসল। শামা কঠিন গলায় বলল, হাসি বন্ধ করে বলতে ছেলেটা কে?
তুমি চিনবে না। খুবই আজেবাজে টাইপের ছেলে।
আজেবাজে টাইপ ছেলের সঙ্গে তোর পরিচয় হলো কীভাবে?
যেভাবেই হোক, হয়েছে।
ছেলে করে কী?
কিছু করলেতো বলতাম না আজেবাজে টাইপ ছেলে। কিছুই করে না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলে।
তার মানে?
রবীন্দ্র জয়ন্তী করবে তার জন্য চাঁদা তুলবে, নজরুল দিবস করবে তার জন্য চাঁদা তুলবে, পাড়ায় ক্রিকেট খেলার চাঁদা, দুঃস্থজনগণের জন্য চাদা। এপাড়ার মানুষদের মাসের মধ্যে দু’তিনবার তাকে চাঁদা দিতে হয়। যে চাঁদা দেয় সে হাসি মুখে দেয়, সেও হাসি মুখেই চাদা নেয়। চাঁদা তোলা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সে একজন ডিরেক্টর। তার ব্যবহারও অত্যন্ত ভাল। অফিস বসদের ব্যবহার সাধারণত ভাল হয় না। তারা খিটখিটে স্বভাবের হয়। ইনি সে রকম না।
তুই আমার সঙ্গে ইয়ারকি করছিস নাতো?
না।
শামা বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যাচ্ছিল, এশা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যাচ্ছ কোথায়?
শামা বলল, বাবাকে ডেকে তুলি। তোর কথাগুলি তাঁকে বলি।
এশা বলল, বাবার শরীর ভাল না। ঘুমুচ্ছেন। তাছাড়া বাবাকে তোমার কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব। তুমি চুপ করে বিছানায় বস।
সুলতানার শোবার ঘর থেকে কথাবার্তা শশানা যাচ্ছে। দরজা খোলা হলো। স্বামী স্ত্রী দু’জন এক সঙ্গে বেরুচ্ছেন। সাড়াশব্দ পেয়ে এশা এবং শামা ঘর থেকে বের হয়েছে।
এশা বলল, কী হয়েছে।
সুলতানা লজ্জা লজ্জা গলায় বললেন, কাণ্ড দেখ না। তোর বাবা এখন বলছে ভাত খাবে। তার না-কি শরীর ভাল লাগছে। ক্ষুধা হচ্ছে।
এশা বলল, তোমরা খাবার টেবিলে বসো। আমি খাবার গরম করে আনছি। আবদুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে সংকুচিত গলায় বললেন, আমার মনে হয় ফুড পয়জনিং হয়েছিল। বমির সঙ্গে পয়জন সবটা বের হয়ে গেছে। এখন শরীর ফ্রেশ লাগছে।
এশা খাবার গরম করছে। শামা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। শামা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাচ্ছে। তার মুখ থমথম করছে। শামা বলল, ছেলের নাম কী?
এশা হালকা গলায় বলল, নামেতো আপা কিছু যায় আসে না। ওর নাম সলিম হলেও যা, দবির হলেও তা, আবার খলিলুল্লাহ হলেও ঠিক আছে।
আমি মনে হয় ছেলেটাকে চিনতে পারছি। একদিন কলেজে যাবার জন্যে রিকশা পাচ্ছিলাম না, তখন ফর্সামতো লম্বা একটা ছেলে রিকশা ঠিক করে দিয়ে আমাকে বলল, আপা উঠুন।
রিকশাওয়ালা কি তোমার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে?
ভাড়া নেবে না কেন?
এশা হালকা গলায় বলল, রিকশাওয়ালা তোমার কাছ থেকে ভাড়া নিলে বুঝতে হবে মাহফুজ না। মাহফুজ রিকশা ঠিক করে দেবে আর রিকশাওয়ালা ভাড়া নেবে এ রকম হতেই পারে না।
ছেলের নাম মাহফুজ?
হ্যাঁ।
তুই কি সত্যি সত্যি তাকে বিয়ে করেছিস? আমার গা ছুঁয়ে বলতো। প্লিজ।
এশা বিরক্ত গলায় বলল, টেনশনে তোমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। তুমি টেনশন করছ কেন? টেনশন করব আমি। তোমার এখানে টেনশন করার কিছু নেই।
আমি টেনশন করব না?
না। আমরা যখন এক সঙ্গে ছিলাম তখন একজন আরেকজনের সমস্যা দেখেছি। এক সঙ্গে থাকার সময় শেষ হয়েছে। তোমার একটা জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। তুমি তোমারটা দেখবে। আমি দেখব আমারটা।
তোর কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে আমি চিন্তা করব না?
না করবে না। বড় খালা বা ছোট খালা এদের কারোর সঙ্গে কি মা’র যোগ আছে? যোগ নেই। হঠাৎ হঠাৎ বিয়ে জন্মদিন এইসব উৎসবে তাদের দেখা হয়। এই পর্যন্তই। আমাদের অবস্থাও তাই হবে। তুমি তোমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আমি আমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হব। কাজেই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না। করে নিজের জীবনটা কেমন যাবে তা নিয়ে চিন্তা কর।
ইদানীং তুই নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী ভাবছিস।
ভাবাভাবির কিছু নেই আপা, আমি বুদ্ধিমতী।
বুদ্ধিমতী কোনো মেয়ে চাঁদাবাজ ছেলের প্রেমে পড়ে?
হ্যাঁ, পড়ে। ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ এই প্রবচনটা জান না? আমি অতি চালাক বলেই আমার গলায় দড়ি।
পুরো ঘটনাটা কি আমাকে বলবি?
না। ঘটনা বলে বেড়াতে লাগে না।
আবদুর রহমান সাহেব খেতে বসেছেন। এশা খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, মাছের তরকারিটা অপূর্ব হয়েছে রে মা! এশা শীতল গলায় বলল, মাছের তরকারি তুমি এখনো মুখে দাও নি বাবা। আবদুর রহমান ব্রিত গলায় বললেন, মুখে দিতে হবে না। আমি চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। চেহারা দেখেই ষোলআনার বারোআনা বোঝা যায়। এশা বলল, চেহারা দেখে কিছুই বোঝা যায় না।
আতাউর
শামা এক প্যাকেট বাবলগাম, একটা ইরেজার কিনল। পছন্দের ইরেজার বেছে বের করতে তার সময় লাগল। বাজারে নানান ধরনের ইরেজার এসেছে। পেনসিলের দাগ মুছতে পারুক আর না পারুক দেখতে সুন্দর। শামার বুক সামান্য ধকধক করছে। দোকানিকে দাম দেয়ার পর তাকে অভিনয় করতে হবে। অভিনয়টা ভাল হতে হবে।
আতাউরকে দোকানের এক মাথায় দেখা যাচ্ছে। আতাউরকে দেখে চমকে ওঠার ভনি করতে হবে। চমকে উঠে বলতে হবে, আপনি এখানে কী করছেন? কথা বলারও বিপদ আছে, গলার স্বর চিনে ফেলবে না তো? ভুরু কুঁচকে ভাববে। নাভো–টেলিফোনে যে কথা বলছিল তার সঙ্গে এই মেয়েটার গলার স্বরের এত মিল কেন? না, তা ভাববে না। টেলিফোনে মানুষের গলার স্বর অন্যরকম। শোনায়। তাছাড়া দু’বোনের গলার স্বর মিল থাকতেই পারে। শামার বান্ধবী। তৃণা এবং তার মা’র গলার স্বর অবিকল এক রকম। এই নিয়ে কত ঝামেলা। হয়েছে। সাগর ভাই তৃণাদের বাসায় টেলিফোন করেছেন। টেলিফোন ধরেছেন। তৃণার মা। তিনি হালো বলতেই সাগর ভাই বললেন, জানগো তুমি কেমন আছে? তোমার রাগ কি কমেছে? তণার মা শান্ত গলায় বললেন, তুমি কাকে চাচ্ছ? তৃণাকে? ও টয়লেটে আছে। আমি তৃণার মা।
বাবলগাম এবং ইরেজারের দাম দেয়া হয়েছে, এখন শামা চলে যেতে পারে। একটা ব্যাপারে সে মন ঠিক করতে পারছে না। আতাউরকে দেখতে পায় নি এমন ভান করে সেকি বের হয়ে যাবে? না-কি হঠাৎ দেখতে পেয়ে অবাক হবে? দেখতে না পাওয়ার অভিনয়টাই সহজ হবে। মাথা নিচু করে দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়া এর একটা সমস্যা আছে। আতাউর যেমন লাজুক সে হয়ত চোখই তুলবে না। নিজ থেকে এগিয়ে এসে কিছু বলবে না। চিন্তা করার জন্যে আরেকটু সময় দরকার। আরো কিছু কিনলে হয়। দাম কুড়ি টাকার মধ্যে হতে হবে। তার সঙ্গে ত্রিশ টাকা আছে। এই ত্রিশ টাকা থেকে রিকশা ভাড়াও দিতে হবে। শামা একটা নেইল পলিশ রিমুভার কিনল। বোতলের মুখ খুলে নিজের নখে খানিকটা লাগল। এই কাজগুলি করতে গিয়ে সময় পাওয়া যাচ্ছে। মিস্টার খাতাউরকে লক্ষ করতে পারছে। খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি। দু’জন দু’জনকে আড়চোখে লক্ষ করতে করতে এক সময় চোখাচোখি হয়ে যাবে। তখন শামাকে কিছু বলতেই হবে। শামার প্রথম কথাটা কী হবে। আরে আপনি? না-কি সে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেবে? সালামটাতো মনে হয় দেয়া উচিত।
শামা তুমি এখানে?
শামা এতই চমকে গেল যে তার হাত লেগে নেইল পলিশ রিমুভারের বোতল টেবিলে কত হয়ে পড়ে গেল। শামা বোতল তুলতে তুলতে বলল, মালিকুম।
তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
জি। এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে দোকানে ঢুকেছিলাম। হঠাৎ দেখি তুমি!
শামা মনে মনে বলল, খাতাউর সাহেব আপনিতো মিথ্যা খুব ভালই বলছেন। বেছে বেছে শার্টটাও সুন্দর পরেছেন। কেউ নিশ্চয়ই বলেছে এই শার্টে আপনাকে ভাল মানায়। ঐ দিন আপনার চেহারা ভালমতো দেখতে পাই নি। আজ দেখতে পাচ্ছি। চেহারা খারাপ না। থুতনিতে কাটা দাগ কেন? ছোটবেলায় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলেন? কীভাবে ব্যথা পেলেন সেই গল্পটা এক সময় শুনব। কী জন্যে শুন জানতে চান? শুনব কারণ আপনি গল্প কেমন বলতে পারেন সেটা জানার জন্যে। বেশির ভাগ মানুষই গল্প বলতে পারে না। যেমন আমার বাবা। বাবা যেহেতু আপনাকে পছন্দ করেন কাজেই ধরে নিতে পারি আপনিও বাবার মতো গল্প বলতে পারেন না।
শামা দোকান থেকে বের হলো। তার পেছনে পেছনে বের হলো আতাউর। শামা বলল, আ আপনার অফিস নেই?
আতাউর বলল, অফিস আছে। আমি ছুটি নিয়েছি।
ছুটি নিয়েছেন কেন?
শরীরটা ভাল না। ভাবলাম ঘরে শুয়ে থেকে বিশ্রাম করব।
কই আপনিতে ঘরে শুয়ে নেই। দোকানে দোকানে ঘুরছেন।
আতাউর বিব্রত ভঙ্গিতে কাশল। শমা বলল, আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন নাতো। সিগারেট ধরান।
আতাউর বলল, আমি সিগারেট খাই না।
একটু আগে যে বললেন, সিগারেট কেনার জন্যে দোকানে ঢুকেছেন?
আমার জন্যে না। আমার বোনের হ্যাসবেন্ডের জন্যে। দুলাভাই খুব সিগারেট খান। কেউ তাকে সিগারেট উপহার দিলে তিনি খুব খুশি হন। আমি মাঝে মাঝে তাকে সিগারেট দেই।
ও আচ্ছা।
শামা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। রিকশা ঠিক করে বাসার দিকে রওনা হবে? নাকি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ গল্প করবে?
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করা যায় না। গল্প করতে হয় হাঁটতে হাঁটতে। কিংবা কোথাও বসতে হয়। ন’আনির জমিদার মিস্টার আতাউর কি এই সহজ সত্যটা জানে? মনে হয় জানে না।
আতাউর বলল, এশা কেমন আছে?
শামা বলল, ভাল আছে। হঠাৎ এশার কথা জানতে চাইছেন কেন?
এম্নি। কোনো কারণ নেই।
ওকেতো আপনি দেখেনও নি।
দেখেছি। একবার জানালা দিয়ে তাকিয়েছিল। তুমি কি এখন বাসায় চলে যাবে?
জি।
দাঁড়াও রিকশা ঠিক করে দেই।
রিকশা ঠিক করতে হবে না। আমিই রিকশা ঠিক করতে পারব।
আতাউর খুবই অস্বস্তির সঙ্গে বলল, শামা তুমি কি আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবে?
কোথায় চা খাবেন?
কোনো রেস্টুরেন্টে বসে বা ধর…
শামা তাকিয়ে আছে। আতাউর তার কথা শেষ করতে পারল না। অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল। শামা বলল, দুপুরবেলা কি চা খাবার সময়?
না তা না। মানে… আচ্ছা ঠিক আছে, রিকশা করে দেই।
শামা বলল, আপনার যদি খুব চা খেতে ইচ্ছা করে তাহলে আমার সঙ্গে বাসায় চলুন। আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াব।
আতাউর এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন প্রস্তাবটা তার মনে ধরেছে। শামা ভেবেই পাচ্ছে না জমিদার খাতাউর সাহেব বোকা না-কি! যদি সত্যি সত্যি মানুষটা বলে, চল যাই’ তাহলে বুঝতে হবে মানুষটা বোকা। মেয়েদের সবচে’ বড় অভিশাপ হলো— বোকা স্বামীর সঙ্গে সংসার যাপন। বোকা স্বামীরা স্ত্রীকে টেবিল ভাবে। ঘরের এক কোণায় টেবিলটা পড়ে থাকবে। চেয়ারের তাও নড়াচড়ার সুযোগ আছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া হয়। টেবিলের সে সুযোগও নেই।
শামা বলল, আপনার চিন্তা শেষ হয়েছে? কী ঠিক করলেন?
তোমাদের বাসায় কেউ কিছু মনে করবে নাতো?
মনেতো করবেই। কী মনে করে সেটা হলো কথা।
এশা কি বাসায় আছে?
জানি না।
আতাউর অস্বস্তির সঙ্গে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে।
শামা বলল, আপনি দ্রুত মন ঠিক করুন। এতক্ষণ রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না। দেখুন না সবাই তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।
তুমি কি যেতে বলছ?
আমি কিছুই বলছি না। যা বলার আপনিই বলছেন।
চল যাই।
দু’টা রিকশা ঠিক করুন। একটায় আমি যাব, পেছনে পেছনে আপনি যাবেন।
তোমার মা কিছু মনে করবেন নাতো?
শামা জবাব দিল না। তার খুবই বিরক্তি লাগছে।
বাইরের বারান্দার কাঠের চেয়ারে আতাউরকে বসিয়ে শামা ঘরে ঢুকল। আশ্চর্য ব্যাপার বাসা খালি! সুলতানা তার ঘরে দরজা ভেজিয়ে শুয়ে আছেন। এশা নেই, মন্টু নেই। কাজের মেয়েটা বাথরুমে কাপড় ধুচ্ছে। সদর দরজাও খোলা। যে কেউ দরজা খুলে টিভি ভিসিআর নিয়ে চলে যেতে পারত।
সুলতানা মেয়েকে দেখে উঠে বসলেন। শামা বলল, মা শরীর খারাপ?
সুলতানা বললেন, সামান্য গা গরম।
তোমাকে বিছানা থেকে নামতে হবে না। শুয়ে থাক। এশা কোথায়? মন্টু কোথায়?
মন্টু কোচিং সেন্টারে। সন্ধ্যাবেলায় আসবে। এশা কখন আসবে কিছু বলে যায় নি।
দুপুরের খাবার কী?
ডাটা দিয়ে চিংড়ি মাছ।
আর কিছু নেই?
না। ডাটা দিয়ে চিংড়ি মাছতো তোর পছন্দ।
ভাজা ভুজি কিছু কর নি?
না। ডাল আছে। ঘরে কি বেগুন আছে মা?
বেগুন আছে। বেগুন ভাজা খাবি?
হুঁ। তোমাকে বেগুন ভাজতে হবে না। কাজের মেয়েটাকে বলে দাও। আর একটু আলু ভাজিও করতে বল। দুপুরে একজন গেস্ট খাবে।
কে?
শামা জবাব না দিয়ে হাসল। সুলতানা গেস্টের ব্যাপারটায় গুরুত্ব দিলেন না। শামার বান্ধবীদের কেউ কেউ হঠাৎ এসে পড়ে বলে ভাত খাব। তেমনই কেউ হবে। সুলতানা বললেন, আগে খবর দিয়ে রাখলেতত গোশত রান্না করতাম।
শামা বলল, আমার এক হাজার টাকা তুমি আজ আমাকে দেবে। দুপুরে খাবার পর আমি উপহার কিনতে যাব। ভয় নেই একা যাব না, দুপুরে যে গেস্ট আমার সঙ্গে খাচ্ছে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আর বাসায় ফিরব না। বিয়ে বাড়িতে চলে যাব। সারা রাত থেকে পরদিন ফিরব।
আজ রাতেই বিয়ে?
হ্যাঁ। আজ ১৭ তারিখ না? কোনো সমস্যা নেই মা। বাবার কাছ থেকে পারমিশন নেয়া আছে।
উপহার কিনেই বিয়ে বাড়িতে যাবার কোন দরকার নেই। বাসায় ফিরবি, তোর বাবাকে বলে তারপর যাবি। তোর বাবা তোকে পৌছে দিয়ে আসবে।
আমাকে বাসায় ফিরতেই হবে?
অবশ্যই। তোর বাবার সঙ্গে দেখা না করে গেলে সে কী হৈচৈটা করবে বুঝতে পারছি না? বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হবে। তুই তোর বাবাকে চিনিস না?
আমার ধারণা বিকেলে না ফিরলে বাবা খুশিই হবেন। যাই হোক, মা তুমি কাজের মেয়েটাকে ইট্ৰাকসন দিয়ে দাও। দেখি তোমার জ্বরের অবস্থা। জ্বর আছে। তুমি শুয়ে থাক। বিছানা থেকে নামবে না।
আতাউর চুপচাপ বারান্দায় বসে আছে। এ বাড়িতে হঠাৎ এসে সে যতটা অস্বস্তি বোধ করবে বলে ভেবেছিল ততটা অস্বস্তি বোধ করছে না। বরং ভাল লাগছে। এ বাড়ির বারান্দাটা সুন্দর। বাড়ির সামনে অনেক গাছপালা থাকায় রাস্তা থেকে কিছু দেখা যায় না। সে বসে আছে বাইরের বারান্দায় অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে সে বাড়ির ভেতরেই বসে আছে। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, সে সবাইকে দেখছে। শামা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আতাউর সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শামা বলল, আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন কেন?
আতাউর বলল, বুঝতে পারছি না কেন। মনে হয় অভ্যাস বলে।
শামা বলল, এখন বাজে প্রায় দুটা। চা না খেলে হয় না?
হয়। আমার চায়ের তেমন অভ্যাসও নেই। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দাও।
আমাদের বাসায় ফ্রিজ নেই। বাড়িওয়ালা চাচার বাসায় আছে। আমি ঠাণ্ডা পানি এনে দিচ্ছি। আপনি খেয়ে চুপচাপ আধঘণ্টার মতো বসে থাকতে পারবেন?
হ্যাঁ পারব। শোন ঠাণ্ডা পানি লাগবে না। নরম্যাল পানি দিলেই হবে।
আপনি আধঘণ্টা বসে থাকবেন। আধঘণ্টার মধ্যে আমি গোসল সারব। তারপর আপনি আমার সঙ্গে ভাত খাবেন।
না না ভাত খাবার দরকার নেই। | দুপুরবেলা আপনি এসেছেন, আর আমি আপনাকে ভাত না খাইয়ে ছেড়ে দেব? অসম্ভব। আপনি আমার সঙ্গে ভাত খাবেন তারপর আমি আপনাকে নিয়ে বের হব।
কোথায় যাবে।
আমার এক বান্ধবীর আজ বিয়ে। তার জন্যে গিফট কিনব। আপনি সঙ্গে থাকবেন। তারপর আপনি আমাকে ঐ বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেবেন। বান্ধবীর বাড়ি উত্তরায়। পারবেন না?
পারব।
আমার কাণ্ডকারখানা কি আপনার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগছে?
না।
মা এখনো জানে না যে আপনি এসেছেন। মা’কে আমি এখনো কিছু জানাই নি। আপনাকে যখন খাবার জন্যে ভেতরে ডাকব তখনি মা প্রথম দেখবে এবং বিরাট একটা ধাক্কার মতো খাবে। তাঁর মনও খুব খারাপ হবে।
মন খারাপ হবে কেন?
মন খারাপ হবে কারণ আজ দুপুরে খাবার আয়োজন খুব খারাপ। মা আপনাকে দেখে কি চমকানিটাই না চমকাবে! এটা ভেবেই আমার ভাল লাগছে।
তুমি মানুষকে চমকে দিয়ে মজা পাও?
হ্যাঁ খুব মজা পাই। পত্রিকা দেব? বসে বসে পত্রিকা পড়বেন?
কিচ্ছু দিতে হবে না। তুমি গোসল করে আস।
এর মধ্যে যদি এশা চলে আসে তাহলে এশাকে অবশ্যি বলবেন আপনার কথা যেন মা’কে কিছু না বলে। বলতে পারবেন না।
পারব।
বাথরুমে ঢোকার মুখে সুলতানা মেয়েকে ধরলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, তুই কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
শামা সহজ গলায় বলল, আমিতো আগেই বলেছি। আমার গেস্ট। দুপুরে খাবে।
পুরুষ মানুষ তোর গেস্ট মানে?
পুরুষ মানুষ আমার গেস্ট হতে পারে না?
সুলতানা চাপা গলায় বললেন, হাসবি না শামা। রঙ্গ রসিকতাও করব না। এই ছেলে কে?
আমার পরিচিত।
কোন সাহসে তুই তাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলি? তোর মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি নেই? এক্ষুণি চলে যেতে বল।
ভদ্ৰলোক দুপুরে খাবেন বলে বসে আছেন। এখন কী করে তাকে চলে যেতে বলি? তোমার যদি এতই অসহ্য লাগে তুমি চলে যেতে বল।
আমি বলব কেন? তুই দাওয়াত করে এনেছিস তুই বলবি।
আচ্ছা যাও আমিই বলব। গোসল সেরে নেই তারপর বলি।
বলে এসে তারপর বাথরুমে ঢুকবি। তোর সাহস দেখে আমি হতভম্ব। তুই একে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার ফন্দি করেছি। এত ফন্দি ফিকির কার কাছ থেকে শিখেছিস?
শামা মা’কে সরিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। সুলতানা বাথরুমের দরজার সামনে থেকে নড়লেন না। ক্রমাগত গজরাতে থাকলেন। শামার খুব মজা লাগছে। হঠাৎ তার মনে হলো সে তার দীর্ঘ জীবনে এত আনন্দ পায় নি। এ রকম মনে হবার কারণ কী। এই ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় নেই। প্রেম নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা গুজণ্ডজ করে গল্প করে নি। লম্বা লম্বা চিঠি চালাচালি করে নি। অথচ এখন এই মুহুর্তে তার কথা ভাবতে ভাল লাগছে। শুধু যে ভাল লাগছে। তা না বুকের মধ্যে ব্যথা ব্যথা লাগছে। এটাই কি প্ৰেম? হঠাৎ শামার চোখে পানি এসে গেল। চোখে পানি আসার অর্থইবা কী?
বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ছে। সুলতানা দরজা ধাক্কাচ্ছেন। শামা বলল, কী হলো মা? তুমি দেখি দরজা ভেঙে ফেলার জোগাড় করছ।
সুলতানা ফিসফিস করে বললেন, বারান্দায় আতাউর বসে আছে না?
হ্যাঁ। ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিসানির কোনো কারণ ঘটে নি।
তুই এই নাটকটা কেন কলি? কেন আমাকে বললি না আতাউর এসেছে।
মা প্লিজ ফিসফিস করবে না তো। মনে হচ্ছে তুমি কথা বলছ না। হাঁস কথা বলছে।
ঘরে খাবারের আয়োজন এত খারাপ। তুই এটা কী করলি বলতে মা?
আমি কিছুই করি নি। তোমার কি ধারণা আমি দাওয়াত করে নিয়ে এসেছি? ভদ্রলোক নিজেই এসেছেন। মা শোনো, তুমি কি দয়া করে জমিদার সাহেবকে এক গ্ৰাস পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করবে? আমার কাছে ঠাণ্ডা পানি চেয়েছেন, আমি ভুলে গেছি।
কী সর্বনাশের কথা, তুই ভুললি কী করে! না জানি কী মনে করছে।
কিছুই মনে করছে না মা। তুমি মুত্তালিব চাচার ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি আনাও তারপর ন’আনির জমিদারকে এক গ্লাস পানি পাঠাও। আর শোন মা, বাথরুমের সামনে থেকে সর। আমি লক্ষ করেছি আমি বাথরুমে ঢুকলেই তোমার একশ একটা গল্প করার নেশা চাপে।
চট করে একটু পোলাও করে ফেলব?
পোলাও কী দিয়ে খাবে। বেগুন ভাজা দিয়ে? ঘরে ডিম আছে। ডিমের কোরমা করি?
তোমার যা ইচ্ছা কর। এখন দয়া করে বাথরুমের সামনে থেকে সর। আমার খুবই বিরক্তি লাগছে।
শামা গায়ে পানি ঢালছে। গরমের সময় শরীরে পানি ঢাললেই ভাল লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও অনেক বেশি ভাল লাগছে কেন? শামার হঠাৎ মনে। হলো বাথরুমের বন্ধ দরজার ওপাশে যদি মা দাঁড়িয়ে না থেকে খাতাউর সাহেব দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে চমৎকার হত। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে আতাউর সাহেবের সঙ্গে গল্প করা যেত। কী গল্প করা যায়? কোনো মানে হয় না এমন সব গল্প। ধাধা জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? মাকড়সার একটা ধাধা আছে। কেউ এই ধাধার উত্তর পারে না। এটা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। শামা মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে বলবে, আচ্ছা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন মাকড়সা জাল বানায়। বানায় না?
আতাউর বলবে, হ্যাঁ, জানি।
সেই জালে অন্যান্য পোকা আটকায়, মাকড়সা সেগুলো খায়। এটা জানেন তো?
হা জানি।
আচ্ছা তাহলে বলুন মাকড়সা তো পোকাই। সে কেন নিজের জালে আটকায় না?
মীরা
বাড়ি দেখে শামা হকচকিয়ে গেল। সে অনেকবার শুনেছে মীরাদের বিরাট বাড়ি। সেই বিরাট বাড়ি যে এই হুলুস্থুল তা বুঝতে পারে নি। এমন বাড়ির একটা মেয়ে ইডেন কলেজে পড়বে কেন? সে পড়বে দেশের বাইরে ইংল্যান্ড আমেরিকায়। তা না হলে দার্জিলিং-টার্জিলিং। এমন বাড়ির মেয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়। ভাবাই যায় না।
শামা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির নাম্বার ঠিক আছে নামও ঠিক আছে হ্যাপি কটেজ। সব ঠিক থাকার পরেও তো ভুল হতে পারে। হয়ত এটা মীরাদের বাড়ি না। অন্য কারোর বাড়ি। একই নামের দু’টো বাড়িতে থাকতেই পারে।
আতাউর বলল, এই বাড়ি?
শামা বলল, তাইতো মনে হয়।
তুমি আগে আস নি?
না।
কী বিশাল ব্যাপার।
শামা বলল, আপনি চলে যান।
আতাউর দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। শামা বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলে যান। আতাউর বলল, যেতে ইচ্ছা করছে না। তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকলামতো, অভ্যাস হয়ে গেছে।
মানুষটা চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শামার তীব্র ইচ্ছা হলো মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেয়। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে। মানুষটাকে ছুঁয়ে না দিলে সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। একটা অজুহাত তৈরি করে কি মানুষটাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় না! সে কি বলতে পারে না- এই যে। শুনুন, আপনার কপালে এটা কী লেগে আছে? খুব স্বাভাবিকভাবে এই কথাটা বলে সে কপালে হাত দিতে পারে। কপালে হাত দিয়ে অদৃশ্য ময়লা সরিয়ে ফেলা। মানুষটার নিশ্চয়ই এত বুদ্ধি নেই যে কপালে ময়লার আসল রহস্য ধরে ফেলবে। এই জাতীয় ব্যাপারগুলোতে পুরুষদের বুদ্ধি থাকে কম।
হ্যাপি কটেজের বারান্দায় তৃণা দাঁড়িয়ে আছে। সে শামাকে দেখে হাত নাড়ছে। শামা বাড়ির ভেতর ঢুকল। তৃণা অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে শামার কাছে এসে বলল, মারাত্মক একটা ব্যাপার হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। না? মীরাকে আজ নিচ্ছে না। এই বাড়িতেই বাসর হবে। মারাত্মক না?
শামা বলল, মারাত্মক কেন?
বুঝতে পারছি না কেন মারাত্মক?
না।
তৃণা বিরক্ত গলায় বলল, তোর কি মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই নাকি? এই বাড়িতে বাসর হচ্ছে তার মানে কী? আমরা বাসর ঘর সাজানোর সুযোগ পাচ্ছি। অলরেডি সাজানো শুরু হয়েছে। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে, তার কলাবাগানে ভিডিওর দোকান। তাকে খবর দেয়া হয়েছে। সে বাসর ঘরে গোপন। ভিডিও ক্যামেরা সেট করে রাখবে। একটা সাউন্ড রেকর্ডারও থাকবে। মীরার যাবতীয় অডিও ভিজুয়াল কর্মকাণ্ড রেকর্ডের অবস্থায় থাকবে। এখন বুঝতে পারছিস কেন মারাত্মক?
পারছি।
মীরা কিছু বুঝতে পারছে না?
সে তার বিয়ের টেনশনে বাঁচে না, সে কী বুঝবে তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।
বাসর হচ্ছে কোথায়?
মীরার ঘরে হচ্ছে না। ছাদে এদের প্রকাণ্ড একটা কামরা আছে। সেখানে হচ্ছে।
তুই এ বাড়িতে আগে এসেছিস।
এসেছি। মাত্র একবার এসেছি। এত প্রকাণ্ড বড়লোকের বাড়িতে বারবার আসা যায় না। এত বড় বাড়িতে নিজেকে সব সময় পর পর লাগে। তবে আমরা সবাই এক সঙ্গে আছিতো আমাদের লাগছে না।
সবাই এসে গেছে?
তুই আর টুনি তোরা দু’জন বাদ ছিলি। এখন বাকি শুধু টুনি। মনে হয় সে আসবে না। বাসা থেকে ওকে ছাড়বে না। টুনি খুবই ভুল করল। বাসর ঘরে ভিডিও ফিট করাতেই আমাদের শেষ না। আরো অনেক ফান হবে। আমাদের সোসিওলজির শাহানা ম্যাডামও এসেছেন। উনি প্রথম আলগা আলগা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এখন আমাদের দলে ভিড়ে গেছেন। ভিডিও ক্যামেরা ফিট করার তদারকি তিনিই করছেন।
সে-কী।
বিয়ে বাড়িতে গেলে সব মেয়ের মাথাই খানিকটা হলেও আউলা হয়। উনার সবচে’ বেশি আউলা হয়েছে।
ভিডিও ক্যামেরা বসানোর লোক চলে এসেছে। তার নাম তাহের। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। এতগুলো মেয়ের পাশে সে খুবই অস্বস্তিবোধ করছে। কেউ কিছু বললেই চমকে উঠছে। একবারতো হাত থেকে ক্যামেরাও ফেলে দিল।
শাহানা ম্যাডাম বললেন, তাহের ক্যামেরাটা ফিট করছ কোথায়? খাটের মাথায়? তাহের হা-সূচক মাথা নাড়ল। ম্যাডাম বললেন, ফিল্ড অব ভিশন কি রেখেছ? শুধু খাটটা কভার করলেই হবে। যা ঘটনা সব খাটেই ঘটবে। অডিও রেকর্ডারের কী করেছ?
ভিডিওর সঙ্গেই অডিও আছে।
ক্যামেরাটা গাদাফুল দিয়ে খুব ভালোমতো ঢেকে দাও যেনো বোঝা না যায় ক্যামেরা। সব ঠিকঠাক হলে একটা টেস্টরান করবে।
তাহের আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তৃণা বলল, এখন আমাদের দরকার নকল দাড়ি গোঁফ। ফর এভরিবডিস ইনফরমেশন— মীরাকে আমি অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। সে বাসর ঘরে ঢোকার আগে নকল দাড়ি গোফ পরে ঘোমটা দিয়ে থাকবে। তার স্বামী ঘোমটা খুলে দাড়ি গোফওয়ালা স্ত্রী দেখে যে কাণ্ডটা করবে আমাদের ভিডিওতে তা ধরা থাকবে।
যূথী বলল, মীরা কি জানে তার বাসর ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
তৃণা বলল, আমরা এই ক’জন ছাড়া কেউ জানে না। বাইরের মানুষের মধ্যে শুধু মীরার মা জানেন।
শামা বিস্মিত হয়ে বলল, উনি কিছু বলেন নি?
খালা কিছুই বলেন নি। উনি বরং সবচে’ বেশি মজা পাচ্ছেন। প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবচে’ বেশি ফান’ পায় মেয়ের মা। এক লাখ টাকা বাজি উনি
মেয়ের বাসর ঘরের ভিডিও দেখতে চাইবেন।
শাহানা ম্যাডাম বললেন, মেয়েরা তোমরা খেয়াল রেখো কোনো ছেলে যেন এদিকে না আসে। তিন তলার ছাদ আউট অব বাউন্ড ফর এভরিবডি।
তৃণা বলল, মিঃ হুক্কা কি আসতে পারবেন?
না হুক্কাও আসতে পারবেন না।
শামা বলল, হুক্কা কে?
তৃণা বলল, মীরার দূর সম্পর্কের ভাই। আমরা নাম দিয়েছি হুক্কা। সে তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। তার ধারণা আমরা চশমা লুকিয়ে রেখেছি। বারবার আসছে আমাদের কাছে।
হুক্কা নাম কেন?
ফানি টাইপ ক্যারেক্টর, এই জন্যে হুক্কা নাম দেয়া হয়েছে। একসময় মীরা হুক্কার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু হুঙ্কা সাহেব পাত্তাই দেন নি। আমরা ঠিক করেছি হুক্কা সাহেবকেও একটু টাইট দেব।
শামা এক কোণায় বসে বাসর ঘরের ফুল সাজানো দেখছে। গাদাফুল আর। বেলিফুল এই দু’রকমের ফুল মশারি স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে। বিছানায় থাকছে শুধু গোলাপ। শাহানা ম্যাডাম এখন গোলাপের কাটা বাছছেন। টুনিও চলে এসেছে। জবরজং সাজে সেজেছে। টুনিকে দেখে সবাই হৈহৈ করে উঠল। যূথী বলল, এই তোকেতো একেবারে বিহারিদের মত লাগছে। মনে হচ্ছে তুই মোহাম্মদপুরের পাকিস্তান কলোনিতে থাকিস। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা শাড়ি তুই পরলি কী মনে করে?
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শামা লক্ষ করল তার কিছুই ভাল লাগছে না। নিজেকে আলাদা এবং একলা লাগছে। মনে হচ্ছে এদের কারো সঙ্গেই তার কোনো যোগ নেই। তার যোগ অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে। তার চোখ কেন জানি জ্বালা করছে। মাথাও ভার ভার লাগছে। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিলে হয়ত ভাল লাগবে। তিনতলায় নিশ্চয়ই বাথরুম আছে। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে বাথরুমটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় চলে যেতে।
আতাউরকে টেলিফোন করে বললে কেমন হয়, ফিসফিস করে বলা— এই শোন আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। তুমি একটা বেবীটেক্সি নিয়ে চলে এসতো। আমাকে বাসায় নিয়ে যাও।
মানুষটাকে তুমি করে সে কি কখনো বলতে পারবে? মনে হয় না। বিয়ের পরেও হয়ত আপনি আপনি করেই বলবে।
তৃণা শামার কাছে এগিয়ে এসে বলল, তোর কী হয়েছে?
শামা বলল, কিছু হয় নি।
কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর ওপর দিয়ে ঘন্টায় একশ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেমন জবুথলু হয়ে বসে আছিল। সমস্যা কী?
কোনো সমস্যা নেই।
সমস্যা অবশ্যই আছে। বলতে চাইলে বলতে পারিস। উড় উড়া শুনছি তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে?
হুঁ।
তুই নিজের মুখে আমাদের বলছিস না কেন? কেন আমরা উড়া উড়া শুনব? ছেলে পছন্দ হয় নি। তাইতো? বল হ্যাঁ বা না?
শামা চুপ করে রইল। তৃণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এরেঞ্জড ম্যারেজে এ রকম হবে। বাবা মা ধরে বেঁধে এক বার নিয়ে আসবে। হাঁসি মুখে সেই বান্দরকে বিয়ে করতে হবে। বাকি জীবন সেই বান্দর গলায় ঝুলে থাকবে। তাকে আর গলা থেকে নামানো যাবে না।
এখানে শামা কে?
শামা চমকে তাকাল। এ বাড়ির কোনো বুয়াই হবে। তাকে খুঁজছে।
শামা কে? শামা?
শামা কাপা গলায় বলল, আমি শামা। কী হয়েছে?
দোতলায় যান আফা। আপনের টেলিফোন।
শামা ভেবেই পেল না, কে তাকে এ বাড়িতে টেলিফোন করবে। এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার সে নিজেই জানে না। টেলিফোনে কি কোনো খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে? আজ কি শনিবার? শনিবারটা শামার জন্যে খুব খারাপ। শনিবার মানেই কোনো না কোনো খারাপ সংবাদ আসবেই।
শামা বলল, টেলিফোন কোন ঘরে?
বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, টেলিফোন সব ঘরে আছে। আপনে দোতলায় চলেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শামা দেখল হলুদ ব্লেজার পরা এক ভদ্ৰলোক সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন। বেঁটে খাট মানুষ, মাথাভর্তি চুল। বিরক্তিতে তাঁর চোখ কুঁচকে আছে, তবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মধ্যে ছেলেমানুষি আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন। যেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠাও একটা খেলা। ভদ্রলোকের চেহারাতেও ছেলেমানুষি আছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পৃথিবীতে জন্মায় যাদের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে না। এই ভদ্ৰলোক সেরকম। বাসে এই ভদ্রলোকের পাশে বসলে কোনো মেয়েই অস্বস্তি বোধ করবে না।
ভদ্রলোক শামাকে দেখে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনি কি মীরার বান্ধবীদের একজন?
জি।
আমি আমার চশমা তিনতলার খাবার টেবিলে রেখে বাথরুমে হাত মুখ ধুতে গিয়েছিলাম। হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি চশমাটা নেই। আমার মাইওপিয়া আছে। চশমার পাওয়ার থ্রি ডাইওপটার। আমার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে সিঁড়িতে দু’বার হোঁচট খেয়েছি। আমার ধারণা মীরার বান্ধবীরা মজা করার জন্যে চশমা লুকিয়ে ফেলেছে। এটা ঠিক না। আপনি মীরার বান্ধবীদের একজন। আপনি কি চশমাটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন? আপনি কি জানেন চশমাটা কার কাছে?
জি না।
প্রথম ভুলটা আমিই করেছি। চশমা সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল। এমন তো না যে বাথরুমে চশমা রাখার জায়গা নেই। বেসিনে রাখা যেত। তবে একবার বেসিনে রেখেছিলাম। বেসিন থেকে পড়ে চশমার গ্লাস ফ্রেম থেকে বের হয়ে এসেছিল। সরি, আপনাকে আটকে রেখেছি। কিছু মনে করবেন না।
ভদ্রলোক আগের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলেন। শামার খুবই মজা লাগছে। কোনো বয়স্ক মানুষকে এইভাবে সিড়ি বেয়ে উঠতে সে আগে কখনো দেখে নি। হড়বড় করে অকারণে এত কথা বলতেও শশানে নি। ভদ্রলোক এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন শামাকে তিনি
অনেকদিন থেকে চেনেন।
হ্যালো কে?
শামা, গলা চিনতে পারছি না? আমি মুত্তালিব। তোদর বাড়িওয়ালা চাচা।
এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার আপনি কোথায় পেলেন?
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। Where there is a will, there is a way. তুই কি অবাক হয়েছিল?
হুঁ।
তোর গলাতে আমি চিনতে পারছি না। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিস কেন? একটা জিনিস খেয়াল রাখবি, টেলিফোনে কথা বলার সময় যতটা সম্ভব মিষ্টি গলায় কথা বলবি। কারণটাও ব্যাখ্যা করি। টেলিফোন কনভারসেশনের পুরোটাই অডিও। মুখ দেখা যাচ্ছে না— গলার স্বরটাই ভরসা। কাজেই সেই স্বরটা মিষ্টি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কি আমার কথায় লজিক খুঁজে পাচ্ছিস?
শামা কিছু বলল না। সে স্বস্তিবোধ করছে। কারণ মুত্তালিব চাচার গলা স্বাভাবিক। তিনি হাসি মুখে কথা বলছেন। কোনো খারাপ সংবাদ থাকলে তিনি
এমন হাসিমুখে কথা বলতেন না।
হ্যালো শামা?
হ্যাঁ শুনছি।
এই টেলিফোন নাম্বার কী করে জোগাড় করলাম সেটা বলি।
কী জন্যে টেলিফোন করেছেন সেটা আগে বলুন।
স্টেপ বাই স্টেপ বলি। তুই এতো ছটফট করছিস কেন? মনে হচ্ছে পাবলিক টেলিফোন থেকে টেলিফোন করছিস তোর পেছনে লম্বা লাইন। সবাই তোকে তাড়া দিচ্ছে। শোন শামা, হ্যালো হ্যালো…
শুনছি।
আমি করেছি কী শোন। প্রথমে এশাকে বললাম, তোমার বোনের ডায়েরি ঘেঁটে দেখ তার কোনো বান্ধবীর নাম্বার লেখা আছে কিনা। সে একজনের নাম্বার দিল। তৃণা মেয়েটার নাম। আমি তৃণার বাসায় টেলিফোন করে এই বাড়ির নাম্বার নিলাম। বুঝেছিস?
বুঝলাম। আপনার অনেক বুদ্ধি। এখন বলুন টেলিফোন করেছেন কেন?
টেলিফোন করেছি এটা বলার জন্য যে, বাসায় চলে আয়। আমি তোদের এখানকার ঠিকানা নিয়ে গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছি। এতোক্ষণে গাড়ি পৌছে যাবার কথা।
বাসায় চলে আসব?
হুঁ।
কেন?
তোর বাবার শরীর খারাপ। বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। এখন ভাল। কিছুক্ষণ আগেও বিছানায় শুয়ে ছিল। এখন দেখে এসেছি বিছানায় বসা। লেবুর সরবত খাচ্ছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে শামা, শামা, করছে। এই জন্যেই আমার মনে হয় ভোর চলে আসাটা ভাল হবে।
শামা হতভম্ব গলায় বলল, চাচা আপনি কী বলছেন?
আপসেট হবার কিছু নেই। তার বাবা ভাল আছে। ডাক্তার এসে দেখে। গেছে। বলেছে চিন্তার কিছু নেই। প্রেসার সামান্য বেশি। প্রেসার কমানোর ওষুধ দেয়া হয়েছে। সিডেটিভ দেয়া হয়েছে। আমি যতদূর জানি এখন নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে।
চাচা আমি আসছি।
তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই টেনশনে মরে যাচ্ছি। টেনশন করার মতো কিছু হয় নি। এভরিথিঙ্ক ইজ আভার কন্ট্রোল। তোর মা শুরুতে খুব ভয় পেয়েছিল। এখন সামলে উঠেছে। তুই বরং এক কাজ কর— বাবাকে দেখে তারপর আবার বিয়ে বাড়িতে চলে যা। সাপ মরল লাঠি ভাঙল না। Snake is dead, stick in tact হা হা হা।
এত হাসছেন কেন? হাসির কী হল?
তোর টেনশন দেখে হাসছি। ভুল বললাম। টেনশন দেখতে পারছি না। শুধু ফিল করছি।
আমার টেনশন করাটা কি হাস্যকর?
হ্যাঁ, হাস্যকর। ছোটখাট ব্যাপারে যদি এত টেনশন করিস বড় ব্যাপারগুলি কীভাবে সামাল দিবি?
চাচা আমি রাখি।
এখন টেলিফোন রেখে কী করবি? গাড়িতো এখনো পৌছে নি। ততক্ষণ কথা বল।
চাচা, আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
শামা টেলিফোন রেখে দ্রুত নিচে নেমে গেল। মুত্তালিব চাচার গাড়ি এখনো আসে নি। গাড়ির ড্রাইভার যদি বাসা চিনে আসতে না পারে? আচ্ছা সে কি আতাউরকে টেলিফোন করে আসতে বলতে পারে না? আতাউর তাকে বেবীটেক্সি করে পৌঁছে দেবে। এতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই।
শামা আতাউরের নাম্বার ডায়াল করল। টেলিফোন আতাউরই ধরল। আগের বারের মতো অন্য কেউ ধরল না। শামাকে নানান ভনিতা করে আতাউরকে চাইতে হল না।
শামা হ্যালো বলতেই আতাউর বলল, এশা তোমার খবর কী? দেখলে আমি কেমন গলা চিনি? আমার সঙ্গে একবার মাত্র কথা বলেছ আর আমি গলা মুখস্থ করে রেখে দিয়েছি।
শামা হকচকিয়ে গেল। এশা-প্রসঙ্গটা তার মাথায় একেবারই ছিল না। অথচ থাকা উচিত ছিল। সে বোকা না, সে বুদ্ধিমতী।
এশা, হ্যালো বলেই চুপ করে গেলে কেন? কোথেকে টেলিফোন করছ?
আমাদের বাড়িওলা চাচার বাসা থেকে করছি। আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি। তোমার বুদ্ধি মতো দোকানটায় গিয়েছিলাম। তোমার আপা বুঝতেই পারে নি যে পুরো ব্যাপারটা সাজানো।
আমারতো মনে হচ্ছে আপনি একটু বেহায়া টাইপ। আপার সঙ্গে হুড়হুড় করে বাসায় চলে এলেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলেন। আশ্চর্যতো!
কাজটা খুবই বেহায়ার মতো করেছি কিন্তু আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
মাই গন্ড, আপনি যেভাবে কথা বলছেন তাতেতো মনে হচ্ছে আপনি আপার প্রেমে পড়ে গেছেন।
তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হচ্ছে প্রেমে পড়াটা অপরাধমূলক।
অবশ্যই অপরাধমূলক। যে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক তার প্রেমে পড়াটা অপরাধ।
অপরাধ কেন?
বিয়ে ঠিকঠাক হওয়া মেয়ের প্রেমে পড়া মানে লাইসেন্স করে প্রেমে পড়া।
তুমিত খুবই গুছিয়ে কথা বল।
আমি গুছিয়ে কথা বলি টেলিফোনে। সামনাসামনি আমি একেবারেই কথা বলতে পারি না। আচ্ছা শুনুন, আপা কি আপনাকে মাকড়সার ধটা জিজ্ঞেস করেছে?
মাকড়সার কোন ধাঁধা?
আপার একটা মাকড়সার ধাধা আছে। ঐ ধাধাটা সে সবাইকে জিজ্ঞেস করে। আপনাকেও জিজ্ঞেস করবে। আপনার বুদ্ধি টেস্ট করার জন্যে জিজ্ঞেস করবে। ধাঁধার উত্তর দিতে না পারলে আপার মন খারাপ হবে। সে ভেবেই নেবে আপনার বুদ্ধি কম।
আমি পারব না। এমিতেই আমার বুদ্ধি কম। ধাঁধার বুদ্ধি আরো কম।
মাকড়সার ধাঁধাটা আপনি পারবেন। কারণ আমি উত্তরটা শিখিয়ে দিচ্ছি। উত্তরটা হলো মাকড়সা দু’রকমের সুতা দিয়ে জাল বানায়। এক রকমের সুতা থাকে আঠা লাগানো। আরেক রকমেরটায় আঠা থাকে না। যে সুতায় আঠা লাগানো থাকে না মাকড়সা তার ওপর দিয়ে হাটে বলে সে জালে আটকে যায় না।
আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ।
আপনিতো ধাঁধাটা জানেন না, শুধু উত্তরটা জানেন, এইজন্যে কিছু বুঝতে পারছেন না। বুঝতে না পারলেও ক্ষতি নেই। উত্তরটা জেনে রাখুন। আচ্ছা শুনুন আমি রাখি।
শামা টেলিফোন নামিয়ে ঘর থেকে বের হলো। আর তখনি তার সব বান্ধবীরা সিঁড়ি দিয়ে নামল। বান্ধবীদের সঙ্গে মিঃ হুক্কা আছেন। শাহানা ম্যাডামও আছেন। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। মিঃ হুঙ্কা কঠিন গলায় বলল, এক্সকিউজ মি, আপনার বান্ধবীরা বলছে, আপনি আমার চশমা আপনার হ্যান্ড ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছেন। কাজটা ঠিক করেন নি। জোক ভাল–But not at the expense of some one.
শামা বলল, আমি আপনার চশমা লুকিয়ে রাখি নি।
তৃণা বলল, তোর হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখিয়ে দে না হ্যান্ডব্যাগে কিছু নেই। এত কথার দরকার কী?
তৃণ মুখ চেপে হাসছে। শামার বুক ধ্বক করে উঠল। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত তার হ্যান্ডব্যাগে ভদ্রলোকের চশমা আছে। তৃণা এক ফাঁকে লুকিয়ে রেখেছে।
শামা হ্যান্ডব্যাগ খুলে চশমা বের করল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে বলল, I am sorry.
ভদ্রলোক চশমা নিতে নিতে বললেন–কিছু কিছু অপরাধ আছে শুধু সরিতে কাটা যায় না। যাই হোক, আমি আপনার সরি গ্রহণ করছি। আপনাকে একটা ছোট্ট উপদেশ দেবার ইচ্ছা ছিল। দিচ্ছি না, কারণ আমার মনে হয় না আপনার সঙ্গে আমার আবারো দেখা হবে।
রাত ন’টা। এতক্ষণে মন্টু দুটা চ্যাপ্টার পড়ে ফেলতে পারত। এখনো সে বই নিয়ে বসতেই পারে নি। একবার বসেছিল, বই খোলার আগেই টপ করে দেয়াল থেকে একটা টিকটিকি বইয়ের ওপর পড়েছে। টিকটিকি বইয়ের ওপর পড়া খুব অলক্ষণ। সে বই বন্ধ করে উঠে পড়েছে। অলক্ষণের সময় পার করে সে আবার পড়তে বসবে। তাছাড়া মনও বসছে না। বাবার জন্য খুব অস্থির লাগছে। বড় আপা অবশ্যি চলে এসেছে। অস্থির ভাবটা এখন অনেকখানি কমেছে। আপা মেয়ে মানুষ। সে কীই করবে! তারপরেও মন্টুর মনে হয়, আপা ঘরে থাকা মানেই অনেক কিছু। মন্টু একটু পর পরই দরজা ধরে দাঁড়াচ্ছে বাবাকে দেখেই চলে যাচ্ছে। তার ওপর দিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক ঝামেলা যাচ্ছে। তাকেই ডাক্তার ডেকে আনতে হয়েছে। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে স্যুপ আনতে হয়েছে। তাকেই অষুধ আনতে হয়েছে।
আবদুর রহমান সাহেব খুব বিব্রত বোধ করছেন। তাঁর লজ্জাও লাগছে। সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়ার লজ্জা। তিনি পরিবারের প্রধান। তার কর্তব্য সবাইকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা। বড় মেয়েটা শখ করে বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিল। তাকে চলে আসতে হয়েছে। মেয়েটার মনটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ।
শামা বলল, বাবা স্যুপটা খাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
স্যুপ থেকে মুরগি মুরগি গন্ধ আসছে। ভাতের মাড়ের মতো একটা জিনিস। তার ওপর লতাপাতা ভাসছে। দেখেই অভক্তি লাগছে। তারপরও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এক চুমুক স্যুপ মুখে দিলেন।
শামা বলল, স্যুপটা খেতে ভাল লাগছে না?
তিনি বললেন, খারাপ না।
তাহলে খাও। চামচ হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
তিনি পর পর কয়েক চামচ স্যুপ মুখে দিলেন। শামা বলল, শরীরটা কি এখন আগের চেয়ে ভাল লাগছে?
হুঁ।
একটু ভাল না অনেকখানি ভাল?
অনেকখানি ভাল।
স্যুপ খেয়ে শুয়ে পড়।
আবদুর রহমান সাহেব আরো এক চামচ স্যুপ মুখে দিলেন। ভক করে মুরগির গন্ধ মাকে লাগল। শরীর কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। বমি হয়ে যেতে পারে। তিনি বমি আটকাবার চেষ্টা করলেন। তাঁর শরীরের কলকজা ভাল না। একবার বমি শুরু হলে বাড়িতে আবারো হৈচৈ শুরু হবে। মন্টুর পড়া হবে না। পরীক্ষার আগের রাতের রিভিশনটা এক মাসের পড়ার সমান। কাল তার পরীক্ষা। মনেই ছিল না। স্যুপ খাওয়াটা বন্ধ করতে হবে। মেয়ে এমন আগ্রহ নিয়ে যেতে বলছে তিনি নাও করতে পারছেন না। মন্টু দরজা ধরে আবারো এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি চোখের ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকলেন। মন্টু এগিয়ে এলো।
রিভিশন শেষ হয়েছে?
না।
আমার শরীর ভাল আছে। আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করবি না। হাত মুখ। ধুয়ে বই খাতা নিয়ে বসে যা। রাত দু’টা পর্যন্ত পড়বি। দু’টার পর ঠাণ্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বি। পরীক্ষার আগের রাতে রিভিশন যেমন দরকার, ঘুমও ঠিক তেমনই দরকার। দু’টার ইম্পৰ্টেন্সই সমান সমান। ফিফটি ফিফটি। বুঝতে পারলি?
মন্টু মাথা কাত করল। শামা বলল, তোমার উপদেশ দেবার কোনো দরকার। নেই বাবা, তুমি স্যুপটা শেষ কর। ঠাণ্ড হলে আর খেতে ভাল লাগবে না।
আবদুর রহমান সাহেব নিচু গলায় বললেন, আমি আর খাব না। বমি আসছে। বাতি নিভিয়ে দিয়ে তুই চলে যা। আমি শুয়ে থাকব।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই? দরকার নেই। তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? হু।
ঘুম পেলে মাথায় হাত না বুলালেই ভাল। ঘুমের সময় মাথায় হাত বুলালে ঘুম কেটে যায়।
শামা বাবার ঘরের বাতি নিভিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।
সুলতানা রান্নাঘরে রুটি বানাচ্ছেন। শামা মা’র পাশে বসতে বসতে বলল, রুটি বানাচ্ছ কেন?
তোর বাবাকে দেব। বাবা শুয়ে পড়েছে, কিছু খাবে না।
আজ সারাদিন কিছু খায় নি। অফিসে শুধু একটা কলিজার সিঙ্গাড়া খেয়েছিল। টিফিন বক্স খুলেও দেখে নি।
এই বয়সে বাবার কলিজার সিঙ্গাড়া খাওয়া একেবারেই ঠিক না। পচা বাসি কলিজা দিয়ে সিঙ্গাড়া বানায়।…
সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস?
শামা নাসূচক মাথা নাড়ল। তাহলে হাত মুখ ধুয়ে আয়, রুটি খা। না-কি ভাত খাবি? রুটি খাব। গরম গরম রুটি দেখে লোভ লাগছে। সুলতানা বললেন, তোর বান্ধবীর বিয়ের উৎসব কেমন জমেছে?
খুব জমেছে। নানান ধরনের মজা হচ্ছে।
কী হচ্ছে বল, শুনি।
বলতে ইচ্ছা করছে না। বড় মানুষদের বড় মজা।
ওরা কি খুবই বড়লোক?
বড়লোক মানে হুলস্থূল বড়লোক! মীরাদের বাড়ির প্রতিটা ঘরে এসি আছে। আমার ধারণী কাজের মেয়েদের ঘরেও আছে।
বলিস কী?
কথার কথা বলছি। কাজের মেয়ের ঘরেতো আর এসি থাকে না। বড়লোকেরা যা করে নিজের জন্যে করে। অন্যের জন্যে করে না।
মীরার বাবা কী করেন?
ইন্ডাস্ট্রি আছে। মাছের ব্যবসা আছে। আরো কী কী যেন আছে।
শামা একটা রুটি নিয়ে খেতে শুরু করলো।
সুলতানা বললেন, শুধু শুধু রুটি খাচ্ছিস কেন? তরকারি দিয়ে খা। ডিম একটা ভেজে দেব, ডিম দিয়ে খাবি?
উঁহু।
সবুজ শাড়িতে তোকে যে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এই কথা কেউ বলে নি?
না বলে নি।
সুলতানা বললেন, কুমারী মেয়েদের সেজগুজে বিয়ে বাড়িতে যাওয়াটা ভাল। অনেকের চোখে পড়ে। সম্বন্ধ আসে।
সুলতানা মাথা নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, তোর বয়সে আমি যতবার কোনো বিয়ে বাড়িতে গিয়েছি ততবার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। এর মধ্যে একটা এসেছিল প্লেনের পাইলট।
পাইলটের সঙ্গে বিয়ে হলো না কেন? বিয়ে হলেতো প্লেনে করে তুমি দেশবিদেশ ঘুরতে পারতে।
বিয়ে কপালের ব্যাপার। কপালের লেখা ছিল তোর বাবার সাথে বিয়ে হবে। তাই হয়েছে।
আমার কপালে লেখা খাতাউরের সঙ্গে বিয়ে হবে, কাজেই যত সেজেগুজেই বিয়ে বাড়িতে যাই না কেন আমার কপালে খাতাউর তাই না মা? খাতাউর সাহেব যে দুপুরে বাসায় খেতে এসেছিল এটা কি বাবাকে বলেছ?
না।
বল নি কেন?
আছে একটা সমস্যা।
কী সমস্যা?
পরে শুনবি।
পরে শুনব কেন? এখন বল।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবার ইচ্ছা না ছেলেটার সঙ্গে তোর বিয়ে হোক। তার যে শরীরটা খারাপ করেছে এইসব ভেবেই করেছে।
তার মানে?
তোর বাবা আজ দুপুরে ছেলেটার সম্পর্কে খুব একটা খারাপ খবর পেয়েছে। তখনি তার শরীরটা খারাপ করেছে। এত আশা করে ছিল। হঠাৎ একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। অফিসেই বমি টমি করেছে।
খারাপ খবরটা কী?
আমাকে কিছু বলে নি। তোর বাবাকেতো তুই চিনিস একবার যদি সে ঠিক করে কিছু বলবে না, পেটে বোমা মারলেও বলবে না।
খারাপ খবর যেটা বাবা শুনেছেন সেটাতো ভুলও হতে পারে। বিয়ের সময় প্রায়ই মিথ্যা খবর রটানো হয়।
তোর বাবা বলেছে খবর মিথ্যা না।
শামা তাকিয়ে আছে। সুলতানা মেয়ের দৃষ্টির সামনে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এশার ঘরে একবার যেতে হবে। মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। স্বামীকে দেখতে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকানো হয় নি।
প্রথমে তিনি স্বামীর ঘরে উঁকি দিলেন। মানুষটা ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরাম করেই ঘুমুচ্ছে। আরামের ঘুমের সময় মানুষ হাত পা গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে যায়। বেআরামের ঘুমের সময় মানুষ সরল রেখার মতো সোজা হয়ে থাকে।
সুলতানা ছেলের ঘরে গেলেন। বেচারার পড়ার আজ অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তিনি ঠিক করলেন মন্টু যতক্ষণ পড়বে তিনি পাশে বসে থাকবেন। তার এই ছেলেটা বোকা টাইপ হয়েছে। ছোটবেলায় এত বোকা ছিল না, যতই দিন যাচ্ছে বুদ্ধি মনে হয় ততই কমছে। পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করে। এই ছেলের পড়াশোনা হবে বলে মনে হয় না। পরীক্ষা দিয়ে ফেল করবে। আবার দেবে, কোনো বছর দেবে, কোনো বছর দেবে না। এই করতে করতে বয়স হয়ে চেহারায় লোক লোক ভাব আসবে তখন কোনো দোকান টোকা দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। মন্টুর মতো ছেলেরা খুব ভাল দোকানদার হয়।
টেবিলে খোলা বই। মন্টু বইয়ে মাথা রেখে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। ঘাড়ের ওপর মশা, রক্ত খেয়ে ফুলে আছে। মন্টুর কোনো বিকার নেই। সুলতানা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলেকে ঘুম থেকে তুললেই সে পড়তে শুরু করবে। ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে যেখানে পড়া শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করবে, কিছুক্ষণ ঘুমাক। তিনি এশার ঘরের দিকে রওনা হলেন। খুব সম্ভব এশাও ঘুমুচ্ছে। মাইগ্রেনের ব্যথা প্রবল হলে এশা কয়েকটা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলে। ব্যথা কমে যায় কিন্তু ঘুম থেকে যায়।
এশার ঘরের দরজা ভেজানো। সুলতানা দরজার পাশে দাঁড়াতেই এশা বলল, ভেতরে এসে মা।
সুলতানা ঘরে ঢুকলেন। এই গরমে এশা চাদর গায়ে শুয়ে আছে। তার চোখ লাল। সুলতানা বললেন, মাথাব্যথার অবস্থা কী?
এশা বলল, অবস্থা ভাল। কমেছে?
না।
তাহলে ভাল বলছিস কেন?
আমার মাথাব্যথা প্রসঙ্গটা এখন একটু বাদ থাকুক। মা আসল ঘটনা আমাকে বল। আপার বিয়ে বাতিল হয়ে গেছে?
হুঁ।
হুঁ-ফু না, পরিষ্কার করে বল— বাবা কি বিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন।
হুঁ।
ছেলেকে বলেছেন?
সরাসরি ছেলেকে বলে নি। তার চাচাকে আর বড় বোনকে খবর দেয়া হয়েছে।
ছেলের অপরাধটা?
আমি জানি না। তোর বাবা কিছু বলে নি।
কাজটা ঠিক করলে না মা। হুট করে বিয়ে ঠিক করা, আবার হুট করে বাতিল। বিয়ে তো Play and dust না।
প্লে এন্ড ডাস্ট কী?
প্লে হচ্ছে খেলা আর ডাস্ট হচ্ছে ধুলা। প্লে এন্ড ডাস্ট হলো- খেলাধুলা। মা এখন আমার ঘর থেকে যাও। তোমার পাথরের মতো মুখ দেখে আমার মাথা ধরা ছেড়ে যাচ্ছে।
তৃণা
শামা,
তুই কি আমার ওপর খুব বেশি রেগে আছিস, তিন দিন হয়ে গেল এখনো টেলিফোন করলি না। আমি তোর নিষেধ সত্ত্বেও তাদের বাড়িওয়ালার টেলিফোনে টেলিফোন করেছিলাম। দু’বার করেছি। প্রথমবার তিনি বলেন, রং নাম্বার। দ্বিতীয়বারে বললেন, শামারা এই বাড়ি ছেড়ে চলে। গেছে। মালিবাগের দিকে বাসা নিয়েছে। রেল ক্রসিং-এর। কাছে। বয়স্ক একজন মানুষ মিথ্যা কথা বললে কেমন লাগে বলতো। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। এই দ্ৰলোককে। আমি একটা শিক্ষা দেব। শামা আমাদের পিকনিকে তুই এই ভদ্ৰলোককে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আয় না। তারপর দেখ আমি কী করি।
শামা শোন, ঐ দিনের ঘটনায় আমি খুব দুঃখিত। সামান্য ফান করলাম। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর সঙ্গে ফান করতে পারবে না? দ্রলোকের চশমা তোর ব্যাগে পাওয়া গেল। তাতে ক্ষতি কিছু হয় নি। বরং লাভ হয়েছে। কী লাভ হয়েছে সেটা বলি। মন দিয়ে শোন। ভদ্রলোকতো মোটামুটি অন্ধের মতাই হাঁটাহাঁটি করছিলেন, চশমা ফেরত পেয়ে প্রথম তোক দেখলেন। তুই সবুজ শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছিলি, তোকে দেখাচ্ছিল ইন্দ্রাণীর মতো (ইন্দ্রাণী জিনিসটা কী আমি জানি না। প্রায়ই গল্পের বইয়ে পড়ি ইন্দ্রাণীর মতো সুন্দর। কাজেই ধরে নিচ্ছি ইন্দ্রাণী খুবই রূপবতী কেউ)। দ্রলোক তোকে দেখে ধাক্কার মতো খেলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা
তুই রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলি, তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলি। তখন আমি হুক্কা বাবাজিকে আসল ঘটনা বললাম। বললাম যে তুই চশমার ব্যাপারটা কিছুই জানিস না। আমি তোর ব্যাগে চশমা লুকিয়ে রেখেছিলাম। ঘটনা শুনে হুক্কা বাবাজি (বাবাজির আসল নাম আশফাকুর রহমান) খুবই মন খারাপ করলেন। তিনি ঠিক করেছেন তোদর বাসায় গিয়ে তোর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন।
আমার ধারণা ইতিমধ্যে তিনি এই কাজটা সেরে ফেলেছেন এবং তার সঙ্গে হুক্কা বাবাজির কথাবার্তা হয়েছে। আমার এই ধারণার পেছনে কারণ আছে। হুক্কা বাবাজির মা আজ সকালেই আমাকে টেলিফোন করে তোর সম্পর্কে খোজ খবর করছিলেন। জানতে চাচ্ছিলেন তুই মেয়ে কেমন, তোর কারো সঙ্গে এফেয়ার আছে কি-না।
কাজেই বুঝতেই পারছিস ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। এখন শুধু গড়াতেই থাকবে। হুক্কা বাজিকে যদি বড়শিতে গেঁথে তুলতে পারিস তাহলে বিরাট কাজ হবে। ওদের গুলশানের তিনতলা বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল আছে। আমি দেখি নি। মীরার কাছে শুনেছি। পয়সাওয়ালা স্বামী হলোসোেনার চামচ। কথায় আছে না সোনার চামচ বাকাও ভাল। হুক্কা বাবাজি বাঁকা না, সোজা। ভদ্রলোকের ফাইবার অপটিক্সের ওপর পিএইচ.ডি. ডিগ্রি আছে। মেরীল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তার বাবা খুবই অসুস্থ, নিজে ব্যবসাপাতি দেখতে পারছেন না বলে ছেলে এসেছে বাবাকে সাহায্য করতে।
শামা শোন, ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি তোর কিছু হয়ে যায় (সম্ভাবনা ৯০ পারসেন্ট), তাহলে তুই কিন্তু প্রতি মাসে একবার তোদের গুলশানের বাড়ির ছাদে পুল সাইড পার্টি দিবি। আমরা সবাই সুইমিং পুলে লাফালাফি ঝাপঝাঁপি করব আর পার্টি করব।
মীরার বিয়ের ঘটনা বলে চিঠি শেষ করি। এত ঝামেলা করে ভিডিওর ব্যবস্থা করা হলো, সেই ভিডিও শেষ পর্যন্ত হয়। নি। বর এসেছে রাত তিনটায়। বিয়ে শেষ হতে হতে বেজেছে পাচটা। দিনের বেলাতে কি বাসর হয়? ভদ্রলোেক তিনতলা পর্যন্ত উঠলেনই না। আমরা খুবই মন খারাপ করেছি। সবচে’ বেশি মন খারাপ করেছেন শাহানা ম্যাডাম। শেষে ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম মন খারাপ করবেন না। আমরাতো অনেকেই আছি বিয়ের বাকি। আমাদের যে কোনো একজনের বাসর রাত ভিডিওর ব্যবস্থা হবে।
কে জানে হয়ত তোরটাই হবে। কাজেই সাবধান!
ভাল থাকিস এবং আমার ওপর থেকে রাগটা দূর করার চেষ্টা করি। তোর নাম রাগ-কুমারী বলেই সারাক্ষণ রেগে থাকতে হবে না-কি? রাগ মিঃ হুক্কার জন্যে জমা করে রাখ।
ইতি—
তোর দুষ্টু বন্ধু তৃণা
সুলতানা
শামা জেগে আছে। একটু আগে ঘড়ি দেখেছে তিনটা দশ। চোখ জ্বালা করছে। যদিও চোখ জ্বালা করার কোনো কারণ নেই। সে চোখ বন্ধ করে আছে। রোদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করার প্রশ্ন আসত। ঘর অন্ধকার। যখন ঘুমুতে গিয়েছিল তখন গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছিল। এখন শীত শীত লাগছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। রাত যতই বাড়ছে ফ্যানের গতি মনে হয় ততই বাড়ছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে কী? আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি না হলে এতটা ঠাণ্ডা লাগার কথা না।
শামা আবারো ঘড়ি দেখল। রেডিয়ামের ডায়াল দেয়া ঘড়ি। অন্ধকারে বিড়ালের চোখের মতো জ্বলে। এখন বাজছে তিনটা বার। মাত্র দু’মিনিট পার হয়েছে, শামার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। অনিদ্রা রোগ মানুষকে এতটা কষ্ট দেয় তা তার জানা ছিল না। তার ছিল বালিশ ঘুম। বালিশে মাথা লাগানো মাত্র ঘুম। আজ এ-কী যন্ত্রণা হলো? আগে চোখ জ্বালা করছিল, এখন মুখ জ্বালা করছে। এই জ্বলুনি কি শেষ পর্যন্ত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে? বিছানায় শুয়ে না থেকে ভেতরের বারান্দায় চলে গেলে কেমন হয়! ভেতরের বারান্দায় কাঠের চেয়ারটা আছে। চেয়ারের পায়াটা আবার ভেঙেছে। আবদুর রহমান সাহেব আবার ঠিক করেছেন। এই নিয়ে তিনবার হললা। চেয়ারে বসে সকাল হওয়া দেখা। অনেক দিন সকাল হওয়া দেখা হয় না। আজ দেখবো না তা করা যাবে। না। ফজরের আজান হতেই মা-বাবা দু’জনই উঠে পড়বেন। তাঁরা অজু করতে এসে দেখবেন তাদের বড় মেয়ে একা একা বারান্দায় বসে আছে। মনের কষ্টে মেয়ে সারা রাত ঘুমুতে পারে নি। তাঁরা দু’জনই খুবই দুঃখিত হবেন। সেটা হতে দেয়া যায় না। শামা মনের কষ্টে ঘুমুতে পারছে না, এটা ঠিক না। তার মনে কষ্ট নেই। তবে তার খারাপ লাগছে।
খারাপ লাগলেই সেই খারাপ লাগাটা অন্যকে দেখাতে হবে কেন? আজ তার জন্যে খারাপ একটা রাত যাচ্ছে। রাতটা কোনো মতে পার করতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। একজন লোকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। যেকোনো কারণে বিয়েটা ভেঙে গেছে। এটা এমন কোনো বড় ঘটনা না। এই লোকের সঙ্গে বিয়ে হলে তার এক ধরনের ছেলেমেয়ে হত। অন্য আরেক জনের সঙ্গে বিয়ে হলে অন্য ধরনের ছেলেমেয়ে হবে। ব্যাস এইতো! এর বেশি আর কী?
তিনটা কুড়ি বাজে। এই শেষবার ঘড়ি দেখা। শামা ঠিক করে ফেলল সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আতাউর নামের মানুষটার ব্যাপারে সে কিছু ভাববে না। আংটিটা ফেরত পাঠাতে হবে। ভাগ্যিস সে আংটি আঙুলে আর পরে নি। আতাউরের সঙ্গে শেষবার কি শামা কথা বলবে? হ্যাঁ বলবে, শামা হিসেবে বলবে না। এশা হয়ে বলবে। এই একটা ভাল সুবিধা হয়েছে। এশা সেজে সে অনেক কিছু বলতে পারছে। যাকে বলা হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
শামা ভেবেছিল বাসর রাতে পুরো ঘটনাটা আতাউরকে হাসতে হাসতে বলবে এবং মানুষটার হতভম্ব মুখ দেখবে। মানুষটা নিশ্চয়ই খুব লজ্জা পাবে। বিড়বিড় করে বলবে, তুমি এমন মেয়ে! আশ্চর্য! তখন শামা হঠাৎ শুরু করবে একটা ভূতের গল্প। সে খুব ভাল ভূতের গল্প বলতে পারে। তার নানিজানদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে বার তের বছর বয়েসী একটা মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল। মেয়েটা কে? কোথেকে এখানে এসেছে, কেউ কিছু জানে না। ফুটফুটে চেহারা, মাথাভর্তি চুল। ঠোটের কোণায় হাসির রেখা। পুলিশ এল তদন্ত হলো। কিছুই বের হলো না। মেয়েটার কবর হলো গ্রামের মসজিদের পেছনের কবরস্থানে। তারপর শুরু হলো যন্ত্ৰণা। গভীর রাতে মেয়েটার কান্না শোনা যায়। লোকজনদের ফিসফিস করে বলে এই তোমরা আমাকে কবর দিলে কেন? আমি হিন্দু। আমার নাম লীলাবতী। গ্রামের লোকজন অস্থির হয়ে পড়ল। শেষে সবাই মিলে সালিস করে ঠিক করল কবর খুঁড়ে মেয়েটার ডেডবডি বের করে শশানে নিয়ে পোড়ানো হবে। কবর খোড়া হলো, দেখা গেল কবরে কিছুই নেই। কাফনের কাপড়টা শুধু পড়ে আছে।
ভূতের গল্প শেষ করে শামা ভয় কাটানোর জন্যে একটা মজার গল্প বলবে। যে গল্প বলবে সেটাও ঠিক করা। গল্পটা সবচে’ সুন্দর বলতে পারে তৃণা। তবে সে নিজেও খারাপ বলে না। এক পথচারী অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই শুনুন, এই রাস্তাটা কি হাসপাতালের দিকে গিয়েছে? উত্তরে সেই লোক বলল, রাস্তার কি অসুখ হয়েছে যে রাস্তা হাসপাতালের দিকে যাবে?
গল্পগুজব শেষ হবার পর মানুষটাকে পুরোপুরি চমকে দেবার জন্যে সে বলবে, আচ্ছা শুনুন, অনেক গল্প করা হয়েছে। এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। গতকাল রাতেও ঘুমুই নি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঘুমাব। ঘুমের মধ্যে আপনি কিন্তু আমার গায়ে হাত দেবেন না। ঘুমের সময় কেউ আমার গায়ে হাত দিলে আমার খুব খারাপ লাগে। এই বলেই সে পাশ ফিরে শুয়ে গভীর ঘুমের ভান করবে। লোকটা কী করবে? বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ পাশে বসে থাকবে?
আজান হচ্ছে। সুলতানা উঠেছেন। রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। চুলায় চায়ের কেতলি বসিয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে ডেকে তুলবেন। দু’জনে ফজরের নামাজ পড়ে এক সঙ্গে চা খাবেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘণ্টা খানিক ঘুমিয়ে আবার উঠবেন। এই ওঠা ফাইনাল ওঠা। আগেরটা সেমিফাইনাল। এই রুটিনের কোনো ব্যতিক্রম শামা তার জীবনে দেখে নি। শামা এবং তার বাবা রুটিনের মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। মানুষ অতি দ্রুত রুটিনে আটকা পড়ে যায়। ভালবাসাবাসিও কি এক সময় রুটিনের মধ্যে চলে আসে? রুটিন করে একজন আরেক জনকে ভালবাসে।
শামা বিছানায় উঠে বসল। সে ঠিক করল এক কাপ চা নিয়ে ছাদে চলে যাবে। ছাদে হাঁটতে হাটতে চা খাবে। চা খেতে খেতে গুছিয়ে নেবে এশা। সেজে আজ কী কী কথা আতাউর নামের মানুষটাকে বলবে। কথা বলবে কিনা সেটাও ভাবার ব্যাপার আছে। এখন আর কথা বলে কী হবে! তবু সে হয়ত বলবে। কারণ তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কথা বলতে হবে ন’টার আগে। নটার সময় মানুষটা নিশ্চয়ই অফিসে চলে যাবে। শামা কলেজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে। মানুষটা পারবে না। তাকে বেঁচে থাকতে হলে অফিস করতে হবে। বেতন তুলতে হবে। সে নিশ্চয়ই রুটিনে ঢুকে পড়া মানুষ।
এখন বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছে। বাবার অসুখটা তাহলে সেরে গেছে। তিনি রোজদিনের মতো নামাজ পড়বেন। কোরান তেলাওয়াত করবেন। তারপর ছোট্ট ঘুম ঘুমাতে যাবেন। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে অফিসের দিকে রওনা হবেন। তাঁর জীবন আগের মতোই চলবে। শামার জীবনও হয়ত আগের মতোই চলবে। এক সময় আতাউর নামের লোকটার কথা মনেও থাকবে না। অনেক অনেক দিন পর তার নিজের মেয়ে বড় হবে। সে তার বান্ধবীর বিয়ে দেখে বাসায় ফিরে মা’র সঙ্গে গল্প করতে বসবে তখন হয়ত শামা হঠাৎ করে বলবে, জানিস আমার একজনের সঙ্গে বিয়ে প্রায় ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। লোকটার নাম আতাউর। আমি ঠাট্টা করে বলতাম খাউর।
তার মেয়ে বলবে, ছিঃ মানুষের নাম নিয়ে ঠাট্টা করা ঠিক না। নামটাতে সে রাখে নি। বাবা মা রেখেছে।
শামা বলবে, তা ঠিক। তখন আমার বয়স কম ছিল। ঠাট্টা তামাশা করতে খুব ভাল লাগত।
উনার সঙ্গে বিয়ে হলো না কেন?
আমার বাবা কোনো খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে ঠিক করেছিলেন তো। শেষে তিনি জানতে পারলেন, কিছু সমস্যা আছে।
কী সমস্যা? জানি না কী সমস্যা, বাবা বলেন নি।
শামা আবারো বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার নিজের মেয়েটার কথা ভাবতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তার একটা মেয়ে আছে। এবং মেয়েটা এখন গুটিমুটি মেরে তার পাশে শুয়ে আছে। মেয়েটার গায়ের গন্ধ পর্যন্ত তার নাকে লাগছে। গাদাফুলের পাতা কচলালে যে গন্ধ আসে সেই গন্ধ। আচ্ছা মেয়েটার সুন্দর একটা নাম থাকা দরকার না? তার যেমন দুই অক্ষরে নাম সে রকম দু’অক্ষরের নাম। দু’অক্ষরের নাম হলে নামটা অনেকক্ষণ মুখে রাখা যাবে। টেনে লম্বা করা যাবে। তার নামটা যেমন শামা, আ-টা অনেকক্ষণ মুখে রাখা যায়। ইচ্ছামত টেনে লম্বা করা যায়। আচ্ছা মেয়েটার নাম আশা হলে কেমন হয়? আতাউরের আ আর শামার শা। কী অদ্ভুত কাণ্ড! আতাউর এখন এল কীভাবে? শামা দু’হাত দিয়ে কল্পনার মেয়েটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মেয়েটা উহ’ বলে চিৎকারও করল, কারণ তার চুল মা’র বালিশের নিচে আটকে গেছে। এইসব চিন্তার কোনো মানে হয় না থাক, নিজের মেয়েকে নিয়ে চিন্তাটা আপাতত থাকুক। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যাক। মজার কোনো বিষয়। আনন্দের কোনো বিষয়।
শামার ঘুম পাচ্ছে। এখন আর ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না। এখন ঘুমিয়ে পড়লে দশটার আগে আর ঘুম ভাঙবে না। আতাউরকে টেলিফোন করা যাবে না। টেলিফোন করতেই হবে। এশা সেজে টেলিফোন। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলা। এই মজার টেকনিকটা শামা তার মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে যাবে।
শামার ঘরের দরজায় কে যেন হাত রাখল। দরজার কড়ায় সামান্য শব্দ হলো। তারপরই সুলতানার গলা শোনা গেল। তিনি কোমল স্বরে বললেন, শামা চা খাবি?
শামা বলল, হ্যাঁ। আয় তোর বাবার সঙ্গে চা খা। তোর বাবা তোকে ডাকছে। শামা দরজা খুলে বের হলো। মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যে জেগেআছি তুমি জানতে?
সুলতানা বললেন, হ্যাঁ।
কীভাবে জানতে? আমার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি কোনো সাড়া শব্দও করি নি।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোরা তিন ভাইবোনের যে-কোনো একজন জেগে থাকলে বুঝতে পারি। আমার নিজেরো তখন ঘুম হয় না। তাদের মধ্যে সবচে’ বেশি রাত জাগে এশা। বাবা আমার সঙ্গে চা খেতে চাচ্ছেন কেন?
মনে হয় কিছু বলবে। বিয়ে যে ভেঙে গেল কেন ভাঙল। এইসব হয়ত তোকে বলবে।
আমি বাবার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি শুনে নাও। তারপর যদি ইচ্ছা করে আমি তোমার কাছ থেকে শুনব। ইচ্ছা না করলে শুনব না।
সুলতানা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা ডাকলে কখনো না করতে। নেই। তোকে ডেকেছে তারপর যদি না যায় তাহলে মনে কষ্ট পাবে। মা’র মনে কষ্ট দিলে কিছু হয় না, কিন্তু বাবার মনে কষ্ট দিলে তার ফল খুব খারাপ হয়। আবদুর রহমান সাহেব শামাকে দেখে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর হাতে চায়ের কাপ। কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন। চুমুক না দিয়ে কাপ নামিয়ে নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। শামা বলল, তুমি কিছু বলবে?
আবদুর রহমান সাহেব নরম গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আগে বোস তারপর বলি। শামা বসল। আবদুর রহমান সাহেব নিজেই মেয়ের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বললেন, আমি হলাম বোকা মানুষ। আমি নিজে বোকা তার মাও বোক। দুই বোকা মিলে বিরাট ভুল করে ফেলেছি। এই ভুলের মা বাপ নেই। খোঁজ খবর না নিয়ে তার বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। ছেলেও আসা যাওয়া শুরু করল। কী অবস্থা!
শামা বলল, আসা যাওয়া শুরু করে নি বাবা। একদিনই এসেছিল।
সেই একদিন আসাটাও তো ঠিক না। তোর মা যত্ন করে আবার ভাত খাইয়েছে। তুই আবার তাকে নিয়ে নিউ মার্কেটে বান্ধবীর জন্যে উপহার কিনতে গেলি। তোর মা’র কাছে শুনেছি এক রিকশায় গিয়েছিস। কী ঘিন্নাকর অবস্থা! তোর অবশ্যি দোষ নেই। দোষটা আমার। আমি গ্রীন সিগন্যাল দেয়ার কারণেইতো বাসায় এসে ভাত খাওয়া শুরু করল। চিন্তা করলেই আমার কেমন যেন লাগে।
একটা মানুষ একবেলা ভাত খেয়েছে এটা এমন কোনো ব্যাপার না বাবা। কতজনইতো আমাদের বাসায় খেয়েছে। তাতে কী হয়েছে?
আবদুর রহমান সাহেব মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। হতাশ গলায় বললেন, অনেক কিছুই হয়েছে। এতো নরম্যাল ছেলে না। পাগল।
সুলতানা হতভম্ব গলায় বললেন, পাগল মানে?
মাথার অসুখ। প্রায়ই হয়। তখন কাউকে চিনতে পারে না। দরজা তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। এমন অবস্থায় এরা অসুখ গোপন করে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল। মানুষের ধারণা আছে না- বিয়ে দিলে পাগল ভাল হয়। তাই ভেবেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে। পাগল ভাল হয়ে যাবে। আমার মেয়ে হবে পাগল ভাল করার ট্যাবলেট। এই ছেলের আগেও একবার বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। পানচিনি হয়েছে। মেয়েপক্ষ খবর পেয়ে পরে বিয়ে ভেঙে দেয়। গতকাল আমি ছেলের বড় বোনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি ঘটনা স্বীকার করেছেন। ছেলে যেমন বজ্জাত, আত্মীয়স্বজনরাও বজ্জাত। ধরে এদের চাবকান উচিত। জুতা পেটা করা উচিত। এরা শিয়াল কুকুরেরও অধম।
শামা বলল, এইসব কেন বলছ?
বলব না?
না বলবে না। বিয়ে ভেঙে গেছে ফুরিয়ে গেছে। গালাগালি করবে কেন?
আমি এমন কী গালাগালি করলাম। তুই এত রাগ করছিস কেন?
জানি না কেন রাগ করছি। আমার ভাল লাগছে না। বাবা আমি উঠলাম।
আবদুর রহমান সাহেব চাপা গলায় বললেন, ছেলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারে। উল্টাপাল্টা বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে। একেবারেই পাত্তা দিবি না। কী সর্বনাশ! আমার মেয়েটাকে আরেকটু হলে একটা পাগলের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম!
শামা বাবার সামনে থেকে উঠে চলে এল।
হ্যালো আমি এশা।
বুঝতে পারছি। তুমি কেমন আছ?
আমি ভাল আছি। আপনার গলাটা এমন লাগছে কেন? মনে হচ্ছে আপনি না, অন্য কেউ কথা বলছে।
আমার মন ভাল নেই। মন ভাল না থাকলে আমার গলার স্বর বদলে যায়।
মন ভাল নেই কেন? বিয়ে ভেঙে গেছে বলে?
আতাউর জবাব দিল না। শামা কিছুক্ষণ জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল। জবাবের জন্যে অপেক্ষা করে ভালই হললা। পরের প্রশ্নটা কী করা যায় ভাবার সময় পাওয়া যাচ্ছে। কঠিন কঠিন কিছু প্রশ্ন করা উচিত। কঠিন প্রশ্নগুলি মাথায় আসছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে, শামার গলা ভার ভার হয়ে আসছে।
এশা।
জি।
তোমরা সবাই আমাকে খুব খারাপ ভাবছ তাই না?
আমি ভাবছি না, তবে অন্যরা ভাবছে।
তুমি ভাবছ না কেন?
কারণ আমি আপনাকে খুব ভাল কখনো মনে করি নি। বাবা মনে। করেছেন, এই জন্যেই বাবা মনে কষ্ট পাচ্ছেন। আর আপা খুব কষ্ট পেয়েছে। সে অবশ্যি কষ্টের কথাটা কাউকে বলে নি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি।
ও আচ্ছা।
আমি বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু আমি কি আপনাকে একটা উপদেশ দেব?
দাও।
আপনার বিয়ে করা উচিত হবে না। আপনিহত মোটামুটি ধরনের অসুস্থ না। বেশ অসুস্থ। আমার কথা কি ভুল?
না ভুল না। আমি যখন অসুস্থ হই, বেশ ভালই অসুস্থ হই। আমাকে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। অসুখটা সেরে গেলে পুরনো অনেক কিছু ভুলে যাই।
এই অসুখ সারবে ডাক্তাররা কি এমন কথা বলেছেন।
না বলেন নি। বরং উল্টোটা বলেছেন। বলেছেন— বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অসুখটা বাড়বে।
অসুখের ব্যাপারটা গোপন করাটা কি আপনার ঠিক হয়েছে?
না, ঠিক হয় নি। খুব অন্যায় হয়েছে।
অন্যায়টা করলেন কেন?
তোমার আপাকে দেখে মনে হলে আমার অসুখটা সেরে গেছে। আর কোনোদিন হবে না। যে অসুখ হবে না আগ বাড়িয়ে সে অসুখের কথা বলতে ইচ্ছা করল না।
আপার আগে আপনার আরো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল। তাদেরকেও আপনার অসুখের কথা জানান নি। ঐ মেয়েটিকে দেখেও কি মনে হয়েছিল আপনার অসুখ সেরে গেছে?
আতাউর চুপ করে রইল। এশা বলল, আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। আপনি কিছু বলতে চাইলে বলুন, আমি টেলিফোন রেখে দেব।
আমি তোমার আপার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তুমি কি ব্যবস্থা করে দেবে? তাকে দু’একটা কথা বলতে চাই।
কী কথা? এটা তোমার আপাকে বলব। তোমাকে না।
আপার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন না। কারণ আপা আপনার সঙ্গে কখনো কথা বলবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আপার অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। ছেলের নাম আশফাকুর রহমান। ছেলে মেরীলেন্ড ইউনিভার্সিটির টিচার। মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাবে। এই অবস্থায় কি আপার উচিত আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা?
উচিত না।
আমি আজ রাখি? আপনি ভাল হয়ে যান এর বেশি আর কী বলব।
সেটা সম্ভব না। আমি খুবই অসুস্থ। শোন এশা, তোমার সঙ্গে সরাসরি আমার কখনো কথা হয় নি শুধু টেলিফোনে কথা হয়েছে। শুধুমাত্র তোমার কথা শুনে আমি তোমাকে যে কী পরিমাণ পছন্দ করেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। তোমাকে আমার মনে হয়েছে খুবই কাছের একজন।
এখনো কি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, এখনো মনে হচ্ছে।
বড় আপার বিয়েতে আপনাকে দাওয়াত দিলে আপনি কি আসবেন?
হ্যাঁ আসব।
আপনার লজ্জা করবে না।
করবে। তারপরেও আসব। তোমার আপার কাছে শুনেছি তুমি একটা ছেলেকে খুব পছন্দ কর। তোমরা খুব শিগগিরই না-কি বিয়ে করবে। তোমার বিয়েতেও আমি আসব। দাওয়াত না করলেও আসব।
শামা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। সে অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নিজের ওপরই তার রাগ লাগছে। এর কোনো মানে হয়? কেন তার চোখ দিয়ে পানি পড়বে?
মুত্তালিব সাহেব
মুত্তালিব সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাঁটতে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি কয়েকবার বলেছেন, শামা ছেড়ে দে। আর সম্ভব না। শামা বলেছে, আধঘণ্টা আপনাকে হাঁটানোর কথা। আমি আধঘণ্টা হাঁটাব। মুত্তালিব সাহেব হতাশ গলায় বললেন, হাঁটু যে রকম ছিল সে রকমই আছে। হেঁটে লাভ কী?
লাভ ক্ষতি দেখবেন আপনি। আমার আপনাকে হাঁটানোর কথা, আমি হাঁটাব।
তোর হাঁটানোর কথা কেন? তোকেতো কেউ বলে দেয় নি।
এই কাজটা আমি ইচ্ছা করে নিয়েছি। আপনাকে আধঘণ্টা হাঁটালে আমি আধঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলতে পারব। আমার লাভ আমি দেখছি।
কাজটা তাহলে নিঃস্বার্থ না?
না।
আজকালতে তোকে টেলিফোন করতে দেখি না।
এখন দেখেন না পরে দেখবেন। আমি কাগজে কলমে হিসাব রাখছি মোট কত ঘণ্টা টেলিফোন পাওনা।
কত ঘণ্টা?
আজকের আধঘণ্টা ধরলে হবে বারো ঘণ্টা।
তোর ধৈর্য আছে। আধঘণ্টা পার হতে বাকি কত?
এখনো দশ মিনিট।
শামা আজ ছেড়ে দে। মনে হচ্ছে পাটা হাঁটু থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে।
খুলে পড়ে গেলেতো ভালই। হাঁটু বাঁকানোর যন্ত্রণা থেকে বাঁচবেন।
তোর মনে মায়া দয়া বলে কিছু নেই। তুই আমার কষ্টটা বুঝতেই পারছি
না।
চাচা এইসব বলে লাভ নেই। ডাক্তার আপনাকে বলেছেন প্ৰতিদিন আধঘণ্টা হাঁটতেই হবে। আপনার যত কষ্টই হোক এই কাজটা আমি আপনাকে দিয়ে করব। আপনি হাঁটতে হাঁটতে ইন্টারেস্টিং কোনো কথাবার্তা বলুন। দেখবেন ব্যথা টের পাবেন না।
মুত্তালিব সাহেব দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার জীবনে ইন্টারেস্টিং কিছু কখনো ঘটে নি। আল্লাহপাক কী করেন জানিস? মানুষ বানিয়ে তার পিঠে একটা করে সীল দিয়ে দেন। কারো সীলে লেখা থাকে Interesting Life. তার জীবনটা ইন্টারেস্টিং হয়। আবার কারো সীলে লেখা থাকে Happy Life, তার জীবন হয় আনন্দময়।
আপনার সীলে কী লেখা?
কিছুই লেখা নেই। শুধু একটা ক্রস চিহ্ন দেয়া। এই ক্রস চিহ্নের মানে হলো— এই লোকের সব বাতিল।
শামা হেসে ফেলল। মুত্তালিব সাহেবও হাসলেন। শামা বলল, মানুষ হিসেবে আপনি খুব বোরিং। বোরিং মানুষ সামান্য মজার কিছু বললেই মনে হয় অনেক মজার কিছু বলা হয়েছে। আর আমি যেহেতু খুবই ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ, আমার খুব মজার কথাও লোকজনদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়।
তুই এক কাজ করে বোরিং পারসন হবার চেষ্টা কর।
চেষ্টা করছি। লোকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছি। আগে। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে মজা করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতাম— এখন শুকনো ধরনের উত্তর দেই। কাঠখোট্টা জবাব।
আধঘণ্টা শেষ হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে।
যা টেলিফোন করে আয়। আধঘণ্টা না, আজ টেলিফোন করবি এক ঘণ্টা। তারপর তোর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলব। পরীক্ষা করে দেখি তুই কী পরিমাণ বোরিং পারসন হয়েছিল।
টেলিফোন করব না চাচা।
তাহলে আয় আমরা কথা শুরু করি।
আজ কথা বলব না চাচা। বাসায় আজ খুব ঝামেলা। বাসায় চলে যাব।
তোর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা ছিল। তোর বিয়ে ভেঙে গেছে শুনেছি। কেন ভাঙল কিছুই জানি না। আবার শুনছি অন্য এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। কী ঘটছে একটু বল শুনি।
শামা সহজ গলায় বলল, সামারী এন্ড সাবসটেন্স বলে চলে যাই। আতাউর রহমান নামে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল খোঁজ নিয়ে জানা গেল মানুষটা অসুস্থ। সারা বছর অসুস্থ থাকেন না। মাঝে মাঝে থাকেন। খুব বেশি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তাঁকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। বুঝতে পারছেন। অসুখটা কী?
পারছি।
আমার অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে বলে যেটা শুনেছেন, সেটা ঠিক না। বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে না। তবে তৃণা নামে আমার এক বান্ধবী আছে, এর হবি হচ্ছে বান্ধবীদের বিয়ে দিয়ে দেয়া। আমাদের তিন বান্ধবীর বিয়ের কলকাঠি সে নেড়েছে। আমার ব্যাপারেও নাড়তে শুরু করেছে। বিয়ের ব্যবস্থা করার তার কৌশলগুলি খুব সুন্দর। মুগ্ধ হবার মতো কৌশল। একেক জনের জন্যে একেক কৌশল। আমার জন্যে একটা কৌশল বের করেছে, এবং অনেকদূর এগিয়ে গেছে। অন্য এক সময় আপনাকে বলব। আজ বলতে ইচ্ছা করছে না। চাচা আপনি কি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
না।
চাচা যাই?
মুত্তালিব সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর মন খুবই খারাপ হয়েছে। এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছে। কী করবেন, কীভাবে করবেন কিছুই মাথায় আসছে না। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন পিঠে ক্রস চিহ্ন নিয়ে, এ ধরনের মানুষেরা ইচ্ছা থাকলেও কারো জন্যে কিছু করতে পারে না। যে নিজের জন্যে কিছু করতে পারে না সে অন্যের জন্যে কী করবে?
শামা বাসায় ঢুকে দেখে বাসার পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। অথচ সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে দোতলায় মুত্তালিব সাহেবের কাছে চলে গিয়েছিল তখন পরিস্থিতি ছিল ভয়ঙ্কর। আবদুর রহমান সাহেব যে ব্যাপার কখনো করেন না, তাই করছিলেন। রেগে থালা বাসন ভাঙছিলেন, টেবিলের ওপর রাখা দু’টা কাপ এবং একটা পানির জগ ছুঁড়ে মারলেন সুলতানার দিকে। সুলতানা ক্ষীণ স্বরে বললেন, এরকম করছ কেন? একটু শান্ত হয়ে বারান্দায় বস। আবদুর রহমান সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, কেন শান্ত হব? আমাকে একটা কারণ দেখাও যার জন্যে শান্ত হব?
সুলতানা এশার কাছে গিয়ে বললেন, মা যা তোর বাবাকে একটু শান্ত কর। এশা শাড়ি ইস্ত্রী করছিল। সে শাড়ি ইস্ত্রী এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ না করে বলল, কোনো দরকার নেই। বাবা আপনা আপনি শান্ত হবে।
এ রকম করলেতো স্ট্রোক হয়ে যাবে।
হয়ে গেলেও কিছু করার নেই।
সুলতানা কাঁদে কাদো মুখে বড় মেয়ের কাছে গেলেন। প্রায় মিনতির গলায় বললেন, শামা তোর বাবাকে একটু সামলা। সারা ঘরে ভাঙা কাচের টুকরা। তোর বাবা খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগের মাথায় কোনো দিকে না তাকিয়ে হাঁটবে। কাচের টুকরায় পা কাটবে।
শামা বলল, বাবার সামনে গেলেই আমি এখন ধমক খাব। আমার ধমক খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি এখন ঘরেই থাকব না।
তুই যাবি কোথায়?
বাড়িওয়ালা চাচার বাসায়। উনাকে হাঁটাব।
তোর বাবার এই অবস্থা আর তুই যাচ্ছিস আরেকজনকে হাঁটাতে?
শমা মা’র সামনে থেকে সরে দোতলায় চলে এল। চল্লিশ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখে সব শান্ত। পশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্চুপ।
আবদুর রহমান সাহেবের রাগের প্রধান কারণ মন্টু। আজ দুপুরে সে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনে পরীক্ষা সকালে হয়ে গেছে। কাজেই তার আর পরীক্ষা দেয়া হয় নি। আবদুর রহমান সাহেব সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে এই ঘটনা শুনলেন। শান্তভাবেই চা খেলেন। তারপর ছেলের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে গেলেন। চাপা গলায় বললেন, মানুষের সামনে লজ্জা না দিলে তোর হুশ হবে না। রাস্তায় নিয়ে তাকে আমি নেংটা করে ছেড়ে দেব।
তিনি এটা করলেন না, তবে যা করলেন তাও ভয়াবহ। ছেলেকে কানে ধরে একশ বার ওঠবোস করালেন। তাদের চারদিকে লোক জমে গেল। রিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ঘণ্টা দিতে লাগল।
আবদুর রহমান সাহেব পুত্রের শাস্তি পর্ব শেষ করার পর বললেন, খবরদার তুই বাড়িতে ঢুকবি না। তোকে ত্যাজ্য বাড়ি এবং ত্যাজ্য পুত্র করলাম। এখন যা, চরে খা।
মন্টু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল, তিনি বাড়িতে ঢুকে থালা বাসন ভাঙা শুরু করলেন।
অল্প সময়ের ভেতরই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। ভাঙা কাচের টুকরা সরানো হয়েছে। ভেতরের বারান্দার কাঠের চেয়ারে সুলতানা স্বাভাবিক। ভঙ্গিতেই বসে আছেন। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই বিরাট ঝড় গিয়েছে। শামা বলল, বাবা কোথায় মা?
সুলতানা বললেন, শুয়ে আছে।
রাগ কমেছে?
হুঁ।
মন্টু ফিরেছে?
না।
এশা কী করছে?
রান্না করছে।
তোমার শরীর ঠিক আছে মা?
হ্যাঁ।
শামা রান্নাঘরে চলে গেল। এশা বোনকে দেখে হাসল। যেন এ বাড়িতে কিছুই হয় নি। শামা বলল, কী রান্না করছিস।
মাংস। বাবা আজ বাংলাদেশের সবচে’ প্রবীণ গরুর মাংস নিয়ে এসেছেন। এক ঘণ্টার ওপর জ্বাল হয়ে গেছে। যতই জ্বাল হচ্ছে মাংস ততই শক্ত হচ্ছে।
গন্ধতো খুব সুন্দর বের হয়েছে।
গন্ধে গন্ধেই খেতে হবে।
শামা বোনের পাশে বসতে বসতে বলল, তুইতো ভাল রান্না শিখে যাচ্ছি। ঐ দিন মাছের ঝোল রান্না করলি, আমি বুঝতেই পারি নি তোর রান্না। আমি ভেবেছি মা বেঁধেছে।
রান্না শেখার কাজটা আমি মন দিয়ে শিখছি আপা। কারণ শুনতে চাও? কারণ হচ্ছে বিয়ের পর আমাদের সংসারে খুব গরিবি হালত চলবে। কাজের। বুয়া রাখতে পারব না। রান্নাবান্না আমাকেই করতে হবে। আমি এমন রান্না কখনো রাধব না যে মাহফুজ মুখে দিয়ে বলতে কী বেঁধেছ?
তুই এত কিছু চিন্তা করিস?
এশা হাসতে হাসতে বলল, আমি তোমার মতো না আপা। আমি খুবই চিন্তাশীল তরুণী।
তোর বিয়েটা কবে হচ্ছে?
তোমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করব না। তুমি যদি বিয়ে করতে দশ বছর দেরি কর, আমিও ঠিক দশ বছরই দেরি করব।
কারণ কী?
বললাম না, আমি খুব চিন্তাশীল তরুণী। চিন্তাশীল তরুণী বলেই তোমার বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করব।
কেন অপেক্ষা করবি? আমার সঙ্গে তোর কী? সেদিন না বললি আমি আলাদা, তুই আলাদা?
এই সংসারে যতদিন আছি ততদিন আলাদা না। সংসার থেকে বের হলে আলাদা। আপা শোন, আমি কখনো হুট করে কিছু করি না। যাই করি খুব ভেবে চিন্তে করি। আমার সব কিছুর পেছনে একটা পরিকল্পনা থাকে।
শামা আগ্রহ নিয়ে বলল, তোর বিয়ের পরিকল্পনাটা শুনি। থাক এখন না, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় শুনব।
এশা হাঁড়িতে পানি দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, রাতে ঘুমাতে যাবার সময় কিছু শুনতে পারবে না আপা। তখন বাসায় খুব হৈচৈ হতে থাকবে। কান্নাকাটি হতে থাকবে। এর মধ্যে গল্প শুনবে কি?
হৈচৈ কান্নাকাটি হবে কেন?
কারণ মন্টু রাতে বাসায় ফিরবে না। বাবা ছেলের জন্যে অস্থির হয়ে পড়বেন। তাঁর ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে। রাত বারটা একটার সময় কাঁদতে কাঁদতে নিজেই ছেলের সন্ধানে বের হবেন। বের হলেও লাভ হবে না। আগামী এক সপ্তাহ তিনি ছেলে খুঁজে পাবেন না।
শামা বলল, তুই তাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিস।
হ্যাঁ। আমি তাকে মুত্তালিব চাচার ঘরে রেখে এসেছি। তাঁকে বলে এসেছি মন্টুকে যেন এক সপ্তাহ লুকিয়ে রাখেন। আমি চাই বাবার একটা ভাল শিক্ষা হোক। ছেলের ওপর তিনি যত রাগই করেন, অচেনা অজানা একদল মানুষের সামনে তিনি তাকে লজ্জা দিতে পারেন না।
মা জানে যে, মন্টুকে তুই লুকিয়ে রেখেছিস? জানেন।
আমিতো এই মাত্রই মুত্তালিব চাচার কাছ থেকে এলাম। তুই কখন মন্টুকে নিয়ে গেলি?
আমি খুব দ্রুত কাজ করি আপা।
তাইতো দেখছি। এখন শুনি তোর বিয়ের পরিকল্পনা। তুই কথা শুরু করার আগে আমি তোক একটা কথা বলে নেই। মাথায় আঁচল দিয়ে তুই রান্না করছি। তোকে বউ বউ লাগছে। মনে হচ্ছে তুই একটা বিরাট বড় বাড়ির বড় বউ। এবং বাড়িটার সমস্ত ক্ষমতা তোর হাতের মুঠোয়।
আমাকে সুন্দর লাগছে কি-না সেটা বল?
তোকে পরীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি শাড়ির ফাঁক দিয়ে তোর পাখা বের হয়ে আসবে।
এশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার সবচে’ বড় গুণ কী জান আপা? তোমার সবচে’ বড় গুণ হললা তুমি চট করে মানুষকে খুশি করে ফেলতে পার। আমি পারি না। তুমি খুব সুন্দর করে মিথ্যা কথা বল। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। যে মিথ্যা কথা বলতে পারে না তাকে মানুষ ভয় পায়। ভালবাসে না, পছন্দ করে না।
জ্ঞানের কথা বন্ধ করে তোর বিয়ের পরিকল্পনাটা বল, আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।
এশা বোনের দিকে ফিরল। সে বসেছিল পিঁড়িতে। পিঁড়ি আরেকটু টেনে নিল শামার দিকে। গলা সামান্য নামিয়ে বলল, আপা শোন, আমি খুব খারাপ ধরনের, খুবই বাজে টাইপ একটা ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। কারণ তাকে আমার খুবই পছন্দ।
কেন পছন্দ?
কেন পছন্দ সেটা আরেকদিন বলব। এখন পরিকল্পনাটা শোেন। আমি ঠিক করেছি তাকে বিয়ে করব কাজি অফিসে। তার বিরুদ্ধে পুলিশের বেশ কয়েকটা মামলা আছে। সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি ব্যবস্থা করে রাখব যেন কাজি অফিসে বিয়ের পর পর পুলিশ তার খোঁজ পায়। কাজি অফিস থেকেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। যেন পরের দুই বা তিন বছর সে জেল থেকে বের হতে না পারে।
বলিস কী?
এটা ছাড়া আমার কোনো পথ নেই আপা। বিয়ের পর পর সে যদি জেলে চলে যায়, যদি অনেকদিন সে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না পারে, তাহলে সে যে কষ্টটা পাবে তার কোনো তুলনা নেই। এই কষ্টটাই তাকে বদলে ফেলবে। বাকি জীবন সে চেষ্টা করবে যেন এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে থাকতে না হয়।
তোর কষ্ট হবে না?
আমি ভবিষ্যতের আনন্দটা দেখতে পাচ্ছিতো। আমার কষ্ট হবে না। তোমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি কেন বিয়ে করতে পারছি না তা বুঝতে পারছোতো? যে পরিবারের একটা মেয়ে এমন একজনকে বিয়ে করে, যাকে বিয়ের দিনই পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়, সেই পরিবারের মেয়েরা কেমন? সেই পরিবারের অন্য মেয়েদের বিয়ে হবার কথা না। বুঝতে পারছো?
পারছি। কিছু বলবে?
এত হিসাব নিকাশ করে কি সংসার চলে? সংসারতো কোনো অংক না।
কে বলল অংক না? অংকতো অবশ্যই। জটিল অংক, তবে খুব জটিল না। আপা, মাংসের লবণটা চেখে দেখতে লবণ ঠিক হয়েছে কি-না। লবণ চাখতে আমার কেন জানি সব সময় ঘেন্না লাগে।
রাত দশটার পর থেকে আবদুর রহমান সাহেব খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। একবার বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান, একবার যান রাস্তায়, আবার ঘরে ফিরে আসেন। সুলতানা বললেন, খেয়ে নাও। রাত হয়ে গেছে।
আবদুর রহমান সাহেব বললেন, ক্ষিধে নেই।
সুলতানা বললেন, ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এসে পড়বে। যাবে। কোথায়।
আবদুর রহমান সাহেব চাপা গলায় বললেন, গাধা ছেলে। কোথায় না কোথায় গিয়েছে। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে কি-না কে জানে!
রাস্তা হারাবে না, চলে আসবে।
কী করে বললে চলে আসবে? সব কিছু জেনে বসে আছ? দেখি শার্ট প্যান্ট দাও।
শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে? ছেলে খুঁজে বের করতে হবে না? এত বড় শহরে তুমি কোথায় খুঁজবে?
আবদুর রহমান সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, আমাকে কী করতে বল? খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব? আমার ছেলে ঘরে ফিরছে না আর আমি বিছানায় শুয়ে থাকব? তুমি আমার সামনে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার সামনে থেকে যাও।
সুলতানা শামাদের ঘরে গেলেন। গলা নিচু করে বললেন, তোর বাবা কাঁদছে। মন্টুকে নিয়ে আয়।
এশা বলল, অসম্ভব। এক সপ্তাহ মন্টুকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
তোর বাবা কাঁদছে।
কাঁদুক। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি রুমাল দিয়ে বাবার চোখ মুছিয়ে দাও। এক সপ্তাহ আমি মন্টুকে লুকিয়ে রাখব।
সুলতানা শান্ত গলায় বললেন, মা এটা তোর সংসার না। এটা আমার সংসার। তোর সংসার তুই তোর মতো করে চালাবি। আমার সংসার আমি দেখব আমার মতো। মানুষটা হাউমাউ করে কাঁদছে। তোরা যত ইচ্ছা তাদের স্বামীকে কাদাস। আমি আমার স্বামীকে কাঁদতে দেব না।
শামা বলল, মা তুমি বাবার কাছে যাও। আমি মন্টুকে নিয়ে আসছি।
মন্টু বেশ সহজভাবেই কার্পেটে বসে টিভিতে এক্স ফাইল দেখছিল। আজকের পর্বটা দারুণ। টেনশনে মন্টুর শরীর কাপছে। পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
শামা যখন বলল, মন্টু যা বাসায় যা। মন্টু বলল, আপা পনেরো মিনিট পরে যাই।
এক্স ফাইল হচ্ছে? হু। আচ্ছা ঠিক আছে, পনেরো মিনিট পরেই যা।
মুত্তালিব সাহেব নিজের ঘরের খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। শামা ঘরে ঢুকে বলল, চাচা আপনি কি রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছেন?
মুত্তালিব সাহেব বললেন, না।
আজ একটু দেরি করে খেতে বসবেন। এখা মাংস রান্না করছে। আমি এক বাটি মাংস দিয়ে যাব।
মাংস দিতে হবে না। রাতে আমি কিছু খাই না। এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব।
মুখ বাঁকা করে বসে আছেন কেন? হাঁটু ব্যথা করছে?
হুঁ।
পায়ে গরম তেল মালিশ করে দেই।
কিছু মালিশ করতে হবে না।
এরকম করে কথা বলছেন কেন? কী হয়েছে।
কিছুই হয় নি। তোকে দেখে কেন জানি বিরক্ত লাগছে। তুই সামনে থেকে যা। যাবার সময় বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যা।
একটা টেলিফোন করি চাচা?
যা ইচ্ছা কর।
শামা বাতি নিভিয়ে চলে গেল। তৃণার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবে। তারপর মন্টুকে নিয়ে বাসায় যাবে।
মুত্তালিব সাহেব অন্ধকারে হাসলেন। তাঁর মনটা আজ এই মুহূর্তে খুব ভাল। তিনি উঁকিল ডাকিয়ে উইল করেছেন। উইলে শামা নামের মেয়েটিকে তাঁর ইহজীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে গিয়েছেন। কাজটা করতে যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছে। নিজের কন্যা জীবিত থাকতে অন্য কাউকে বিষয় সম্পত্তি দেয়া যায় না। আইনের জটিলতা আছে। উঁকিল সাহেবকে আইনের জটিলতা থেকে পথ বের করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পথ বের করা গেছে। মুত্তালিব সাহেব ঠিক করেছেন। যেহেতু আজই কাগজপত্র ফাইনাল হয়েছে আজ থেকেই তিনি শামার সঙ্গে। যতদূর সম্ভব খারাপ ব্যবহার করবেন। যেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দানপত্রের খবর পেয়ে শামা ফঁপিয়ে খুঁপিয়ে তাঁর জন্যে কাঁদে।
তিনি পিঠে ক্রস দেয়া একজন মানুষ। তাঁর মৃত্যুর পর কেউ কাঁদবে না এই বিষয়টি তাঁকে খুব কষ্ট দিত। আজ তিনি জানেন কেউ কাঁদবে না এটা ঠিক না। একটা মেয়ে কাঁদবে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। মুত্তালিব সাহেবের চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল।
তৃণা খলবল করে বলল, শামা তুই আমাকে চাইনিজ খাওয়াবি কি-না বল।
চাইনিজ খাওয়াবার মতো কিছু ঘটেছে?
হ্যাঁ ঘটেছে। কবে চাইনিজ খাওয়াবি?
কথায় কথায় চাইনিজ খাওয়াবার মতো অবস্থা কি আমার আছে?
টাকা ধার কর। চাচার কাছে থেকে ধার নে। শোন তোর জন্যে কী করেছি। আমার ট্রিকস একশ ভাগ কাজ করেছে। মিঃ হুক্কা এন্ড হিজ ফ্যামিলিকে পুরোপুরি কজা করে ফেলেছি। ঐ দিন যদি তোর ব্যাগে মিঃ হুক্কার চশমা না রাখতাম তাহলে এটা পারতাম না। হুক্কা ফ্যামিলি গোপনে তোদর সব খবরাখবর নিয়েছে। হুক্কার মাতা একদিন কলেজে গিয়ে তোকে দেখেও এসেছে। তোর কি মনে পড়েছে হাবাগোবা টাইপের এক মহিলা একদিন কলেজে এলেন? আমি তাকে দেখে ‘আরে চাচিআম্মা আপনি’ বলে খুব আহ্লাদি করলাম। উনি হচ্ছেন হুক্কা-মাতা। এখন ওরা আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তোদর বাড়িতে ফরম্যাল প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। বুঝলি কিছু?
বুঝলাম।
হুকার পিতা খুবই অসুস্থ। এখন মরেন তখন মরেন অবস্থা। কাজেই ব্যবস্থা এমন থাকবে যে প্রস্তাব দেবার পর প্রস্তাব গ্রাহ্য হলে সঙ্গে সঙ্গে কাজি আনতে লোক যাবে। বিয়ে হয়ে যাবে। মিস্টার হুক্কা তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বারডেমের। হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী পিতার শয্যার পাশে উপস্থিত হবেন। ঘটনা কেমন ঘটিয়েছি বল দেখি?
ভাল।
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কে যাচ্ছেন জানিস? বাংলাদেশের দু’জন অতি বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁদের পরিচয় আগে দিলাম না। এই অংশটা সারপ্রাইজ হিসেবে থাকুক। শামা তুই খুশিতো?
বুঝতে পারছি না।
যখন নিজেদের সুইমিংপুলে মনের সুখে সাঁতার কাটবি তখন বুঝবি। শামা আমি এখন রাখি। কাল তোদর বাসায় এসে সব বলব। চাচা চাচির সঙ্গেও কথা বলব।
আচ্ছা।
আসল কথাইতো বলতে ভুলে গেছি রে। এতক্ষণ শুধু নকল কথা বললাম। আসল কথা হলো— আগামীকাল দুপুরে তুই আমার সঙ্গে চাইনিজ খাবি।
ঐ ভদ্রলোক থাকবেন?
হ্যাঁ থাকবেন। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তাকে একটু বাজিয়ে নিবি না? সামান্য লাউ কেনার সময়ও তো মানুষ লাউ-এ চিমটি দিয়ে দেখে, টোকা দিয়ে দেখে। তুই টোকা দিবি না?
আচ্ছা।
এরকম শুকনো গলায় কথা বলছিস কেন? তোর উচিত আনন্দে লাফানো। আমি তোর জন্যে কী করলাম এটা তুই এখন বুঝতে পারবি না— দশ বছর পর বুঝবি। মনে থাকে যেন আগামীকাল দুপুর। তোর কোনো শাদা শাড়ি আছে? শাদা শিফন?
না।
আচ্ছা শাদা শাড়ি আমি নিয়ে আসব। মেয়েদের সবচে’ মানায় ধবধবে শাদা শাড়িতে। আমাদের দেশের মেয়েরা শাদা শাড়ি পরে না কারণ শাদা বিধবাদের রঙ। তুই পরবি ধবধবে শাদা রঙ, গলায় থাকবে মুক্তার মালা। ঠোটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক দিবি। শাদার ভেতর থেকে লাল রঙ লাফ দিয়ে বের হবে। তোর কি মুক্তার মালা আছে?
না।
অসুবিধা নেই আমি জোগাড় করব।
শামা টেলিফোন নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আতাউরের নাম্বারে ডায়াল ঘুরাল। একজন মহিলা ধরলেন। নরম গলায় বললেন, তুমি কে?
শামা বলল, আমার নাম এশা। আমি আতাউর ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
ও অসুস্থ। ওকেতে দেয়া যাবে না।
কী হয়েছে?
ও অসুস্থ।
এই বলেই মহিলা টেলিফোন রেখে দিলেন। শামা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে মনে হচ্ছে বাড়িটা কাঁপছে। সে এক্ষুণি পড়ে যাবে।
আশফাকুর রহমান নীল ব্লেজার পরেছেন। এই গরমে কেউ ব্লেজার পরে না, তিনি পরেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে ব্লেজার ছাড়া অন্য কিছু পরলে তাঁকে মানাতো না। শামার কাছে মনে হলো বিয়ে বাড়িতে জ্বলোককে একরকম দেখাচ্ছিল, আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে তাঁর মধ্যে ছেলেমানুষি ভাব ছিল। আজ নেই।
আশফাকুর রহমান তৃণার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি না বললে তোমরা ছ’জন বান্ধবী এক সঙ্গে থাকবে?
তৃণা বলল, ছ’জন না, সাতজন। মীরার বিয়েতে আমাদের একজন যেতে পারে নি। সেও আজ থাকবে। তবে তারা সবাই আসবে এক ঘণ্টা পর। শুরুতে থাকব আমরা তিনজন।
ও আচ্ছা।
আপনি শামার কাছে ক্ষমা চাইবেন বলেছিলেন। চেয়েছিলেন?
না। উনার সঙ্গে পরে আর দেখা হয় নি।
এইতো দেখা হলো, ক্ষমাটা চেয়ে নিন। ক্ষমা প্রার্থনা দৃশ্য দিয়ে আজকের টোকাটুকি খেলা শুরু হোক।
টোকাটুকি খেলা মানে?
টোকাটুকি খেলা আপনি বুঝবেন না। আমরা বান্ধবীরা অনেক সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করি। কই ক্ষমা প্রার্থনা শুরু করুন।
শামাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। মঞ্চে বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করলেন। ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে তৃণা মজা করছিল,
দ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মজা করছেন না।
বিয়ে বাড়ির ঐ রাতের ঘটনার জন্যে আমি খুবই লজ্জিত। আপনাকে অপ্ৰস্তুত করার জন্যে আপনার বান্ধবীরা যে এই কাণ্ডটা করবে তা আমার মাথাতেও আসে নি। আমি যে কী পরিমাণ লজ্জা পেয়েছি তা শুধু আমি জানি।
শামা বলল, লজ্জা পাওয়ার মতো এমন কিছু আপনি করেন নি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন না, বসুন।
ভদ্রলোক বসলেন। তুণা বলল, শামা এখন তোকে খুব জরুরি একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শোন— আশফাকুর রহমান সাহেবের বাবা খুব অসুস্থ। বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হচ্ছে। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলের একটা গতি হয়েছে এটা দেখে যেতে চান। কাজেই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে উনার জন্যে চমত্তার একটা মেয়ে খুঁজে বের করা। তোর জানা মতে কেউ আছে?
শামা তাকিয়ে আছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ভদ্রলোেক শামার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বান্ধবীর কথায় সামান্য ভুল আছে। ভুলটা আমি ঠিক করে দেই। আমার বাবা প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টে আছেন। এই অবস্থায় একজন মানুষ নিজের কষ্ট ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারে না। কাজেই তিনি তাঁর পুত্রবধূর মুখ দেখে মরতে চাচ্ছেন এটা খুবই ভুল কথা। তবে আমার আত্মীয়স্বজনরা এ ধরনের কথা বলছেন এটা ঠিক। আমার ধারণা ঢাকা শহরের সব রূপবতী মেয়েদের প্রাথমিক ইন্টারভ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়ে গেছে।
তুণা বলল, একজন শুধু বাকি আছে। শামা বাকি আছে। শামার ইন্টারভ্য আপনি নিয়ে নিন। তবে আপনার ইন্টারভ্যুর আগে শামা আপনার বুদ্ধি পরীক্ষা করবে। বুদ্ধি পরীক্ষায় আপনি যদি ফেল করেন তাহলে তার ইন্টারভ্য নিয়ে কোননা লাভ নেই। শামা আপনার দিকে ফিরেও তাকাবে না।
ভদ্রলোক আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বুদ্ধি পরীক্ষাটা কী রকম?
তৃণা বলল, মাকড়সা নিয়ে একটা ধাধা। বেশ কঠিন পরীক্ষা। প্রায় নব্লুই পারসেন্ট লোক এই পরীক্ষায় ফেল করে। কাজেই সাবধান!
শামা বলল, তৃণা আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। ধাধা জিজ্ঞেস করে কি আর মানুষের বুদ্ধি পরীক্ষা করা যায়?
ভদ্রলোক বললেন, তবু শুনি। আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।
তৃণা বলল, শামা লজ্জা পাচ্ছে। সে বলবে না। তার হয়ে আমি প্রশ্নটা করছি। মনে রাখবেন এর উত্তর না দিতে পারলে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শামা আপনাকে বাতিল করে দেবে। মুখে অবশ্যি কিছু বলবে না। কাজেই সাবধান।
ভদ্রলোক তীব্র দৃষ্টিতে তৃণার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে তিনি চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছেন। উত্তেজনায় তাঁর ফর্সা মুখে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।
শামার কাছে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে ভদ্রলোকের ভেতর যে ছেলেমানুষি দেখা গিয়েছিল, সেই ছেলেমানুষিটা আবার ফিরে এসেছে। তৃণা মাকড়সার ব্যাপারটা বলছে। ভদ্রলোক চোখের পাতা না ফেলে শুনছেন। মনে হচ্ছে সত্যি
সত্যি তিনি ভয়ঙ্কর কোনো পরীক্ষা দিতে বসেছেন।
শামার হঠাৎ করেই মনে হলো এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে হলেও তার মেয়ের নাম রাখা যাবে আশা। আশফাকুর রহমানের আ, শামার শা। আশা।
চিঠি
বারান্দার কাঠের চেয়ারের হাতলে একটা কাক বসে আছে।
সুলতানার বুক ধ্বক করে উঠল। এটা কি কোনো অলক্ষণ? কা কী করে। কাক ডাকাটা অলক্ষণ। কিন্তু একটা কাক ঝিম ধরে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ারে বসে থাকলে তার মানে কী হয়? কাক চুপ করে বসে থাকার পাখি না। সে খাবারের খোঁজে ছটফট করবে। ঘাড় বাঁকিয়ে গৃহস্থকে দেখবে। এই কাজটা সে করছে না। ঝিম ধরে বসে আছে। সুলতানা রান্নাঘরে ঢুকলেন। এশাকে কাক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি জানেন, এশা লক্ষণ-অলক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানে না। আধুনিককালের মেয়েদের লক্ষণ বিচারের সময় নেই। তবু মনের শান্তির জন্যে জিজ্ঞেস করা।
সুলতানা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, এশা একটা কাক তোর বাবার চেয়ারের হাতলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।
এশা পায়েস ব্রাধছিল। পায়েস রান্নার প্রধান কৌশল ক্ৰমাগত হাঁড়ির দুধ নাড়াচাড়া করা। একটু থামলেই দুধ ধরে যাবে। পায়েসে দুধ পোড়া গন্ধ এসে যাবে। সে চামচ নাড়তে নাড়তেই বলল, কাক বসে আছে তো কী হয়েছে?
কোনো অলক্ষণ না তো? এশা হেসে ফেলল। সুলতানা বললেন, কাকটাকে দেখে ভাল লাগছে না।
কাক দেখে ভাল লাগার কোনো কারণ নেই মা। কাকতো ময়ূর না যে দেখে ভাল লাগবে। আজ সকাল থেকে তুমি লক্ষণ বিচার শুরু করেছ। দয়া করে মনটা শান্ত কর। পায়েসের মিষ্টি একটু চেখে দেখ।
সুলতানা মিষ্টি চাখলেন। মিষ্টি বেশি হয়েছে না কম হয়েছে কিছুই বললেন না। তিনি খুবই অস্থির বোধ করছেন। তাঁর অস্থির বোধ করার সঙ্গত কারণ আছে। শামার আজ রাতেই বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তৃণার উদ্যোগে আনা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে সম্পর্কিত সব কথাবার্তা শেষ হয়েছে। পাত্রের নানিকে চিটাগাং থেকে আনা হয়েছে। তিনি সন্ধ্যার পর লোকজন নিয়ে শামাকে দেখতে আসবেন। তিনি যদি বলেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেবিয়ে পড়ানো হবে।
আবদুর রহমান সাহেবকে কাজি এনে রাখার কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিকট আত্মীয়স্বজনকেও খবর দিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। আবদুর রহমান সাহেব বলেছেন, আমি সব খবর দিয়ে রাখলাম। কাজি নিয়ে আসলাম আর ছেলের নানি বললেন, মেয়ে পছন্দ হয় নি তখন?
এতে পাত্রের মামা (ব্যারিস্টার। ইমরুল হক। হাইকোর্টে প্রাকটিশ করেন।) খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, ছেলের নানি এ ধরনের কথা বলবেন না। আমরা সব ঠিকঠাক করে তবেই উনাকে আনিয়েছি। উনি আমাদের সবার। মুরুঝি। এই জন্যেই উনাকে সামনে রাখা, আপনি কি আমাদের কথায় ভরসা। পাচ্ছেন না?
আবদুর রহমান সাহেব ব্ৰিত গলায় বললেন, কেন ভরসা পাব না? অবশ্যই ভরসা পাচ্ছি। ভরসা না পাবারতো কিছু নেই।
সমস্যা থাকলে বলুন কাজি আমরা নিয়ে আসব। আপনাদের কিছু করতে হবে না।
না না কোনো সমস্যা নেই।
আমরা তাড়াহুড়া করছি কারণ ছেলের বাবা অসুস্থ। বারডেমে আছেন। যে-কোনো মুহূর্তে এক্সপায়ার করতে পারেন। উনি যেন ছেলের বউ দেখে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা। বুঝতে পারছেন?
জি পারছি।
আপনাকে দেখে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। আপনি কি চিন্তিত?
জি না, চিন্তিত না। শুধু শুধু চিন্তিত হব কেন?
আবদুর রহমান সাহেব মুখে বললেন শুধু শুধু চিন্তিত হব কেন? আসলে তিনি খুবই চিন্তিত বোধ করছেন। এত বড় ঘরে তার মতো সাধারণ মানুষের সম্পর্ক করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছেন না। তার চেয়েও অনেক বেশি চিন্তিত সুলতানা। সুলতানার চিন্তার প্রধান কারণ আজ সন্ধ্যার আগে যদি ছেলের বাবা মারা যায় তাহলে তো আজ বিয়ে হবে না। এবং অবশ্যই পাত্র পক্ষ পিছিয়ে পড়বে। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ বলবে, মেয়ে অলক্ষণা। বিয়ের কথা হলো অমি ছেলের বাবা গেল মরে। শ্বশুর-খাকি কন্যা!
সুলতানা আজ সকাল থেকে যে শুধু লক্ষণ বিচার করছেন, এই কারণেই করছেন। শুধু কাকের ব্যাপারটা ছাড়া লক্ষণ বিচারের ফলাফল শুভ। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘে মেঘে কালো। আকাশের ভাব দেখে মনে হয় যে-কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। বিয়ের দিন বৃষ্টি শুভ।
বিয়ের দিন এশাকে দিয়ে পায়েস রান্না বসিয়েছেন। এর মধ্যেও সুলতানার একটা গোপন পরীক্ষা আছে। বিয়ের দিন কনের বাড়িতে রান্না করা পায়েস যদি ধরে যায়, কিংবা পুড়ে যায়, কিংবা পাতিল উল্টে পায়েস মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে বিরাট অলক্ষণ। এশার রান্না করা পায়েস খুব ভাল হয়েছে। এটা একটা ভরসার কথা। সুলতানা এক বাটি পায়েস এনে শামার ঘরে ঢুকলেন। শামা খুব মনোযোগ দিয়ে পায়ের নখ কাটছিল। সে নেইল কাটার থেকে চোখ না তুলেই বলল, পায়েস খাব না মা, দেখেই ঘেন্না লাগছে।
পায়েস দেখে ঘেন্না লাগার কী আছে?
ঈদের দিন ছাড়া অন্য যে-কোনো দিন পায়েস দেখলে আমার ঘেন্না লাগে।
একটু চেখে দেখ।
চেখেও দেখব না। আজ আমার বিয়ের দিন। অন্তত আজকের দিনে আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে কিছু করাবে না।
তোর বান্ধবীরাতো এখনো কেউ এল না?
সবাই আসবে। এখন তো মাত্র সকাল দশটা বাজে। এত টেনশন করছ কেন মা? শান্ত হয়ে একটু আমার পাশে বসতো।
সুলতানা বসলেন। শামা নখ কাটা বন্ধ রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা তুমি আমাকে একটা পরামর্শ দাওভতা।
কী পরামর্শ?
খাতাউর সাহেব বিষয়ক একটা পরামর্শ।
সুলতানা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ওর কথা আসছে কেন?
শামা বলল, ওর কথা আসছে কারণ ওরা আমাকে এক হাজার এক টাকা এবং একটা আংটি দিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে আজই এইসব ওদের ফেরত দেয়া উচিত। আমি বাড়িওয়ালা চাচাকে বলে রেখেছি উনি তার গাড়িটা আমাকে তিন ঘণ্টার জন্যে দিয়েছেন। আমি মন্টুকে নিয়ে বের হব। দু’একটা টুকটাক শপিং করব। তারপর খাতাউর সাহেবের বোনের বাসায় গিয়ে তার বোনের হাতে জিনিসগুলি দিয়ে আসব। তোমার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোনো কারণ নেই। খাতাউর সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হবে না কারণ উনি খুবই অসুস্থ। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে তাঁকে বেশ কিছুদিন হলো তালাবন্ধ করে রাখা হচ্ছে।
তুই এত খবর কোথায় পেলি?
মাঝে মাঝে আমি ঐ বাসায় টেলিফোন করি।
কেন?
মানুষটার অসুখটা কমল কিনা এটা জানার জন্যে টেলিফোন করি। এই মানুষটাতে আমার স্বামীও হয়ে যেতে পারত। পারত না? এখন আমাকে অনুমতি দাও, আমি আংটি ফেরত দিয়ে আসি।
সুলতানা চিন্তিত গলায় বললেন, তোকে যেতে হবে কেন? আংটি ফেরত দিতে হলে তোর বাবা গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবে।
শামা শান্ত স্বরে বলল, আংটিতো তারা বাবাকে দেয় নি। আমাকে দিয়েছে। কাজেই আংটি আমাকেই ফেরত দিতে হবে।
সুলতানা বললেন, তুই আমার পরামর্শ চেয়েছিলি। আমার পরামর্শ হলো তুই যাবি না।
শামা বিছানা থেকে নামল। বুক শেলফ থেকে একটা বই বের করল। বইয়ের মাঝখানে রাখা একটা চিঠি বের করে মা’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি চিঠিটা পড়। তারপর আমাকে বল আমার যাওয়া উচিত হবে, কি হবে না।
কার চিঠি?
খাতাউর সাহেবের চিঠি।
সে আবার কবে চিঠি লিখল?
তিনি অসুস্থ হবার আগে চিঠিটা লিখেছেন।
সুলতানা নিচু গলায় বললেন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। সে চিঠি লিখবে কেন? তুই কি এই চিঠির জবাব দিয়েছিস নাকি?
শামা বলল, এত কথা বলছ কেন মা। চিঠিটা তুমি আগে পড়তো। সুলতানা চিঠি পড়ছেন। চিঠি পড়তে গিয়ে তার হাত কাঁপছে।
শামা,
তোমার কাছে এই চিঠি লিখতে খুব অস্বস্তি লাগছে, খানিকটা লজ্জাও লাগছে। একবার ভাবলাম এই চিঠি লেখাটাতো তেমন জরুরি না। না লিখলেও চলে। কিন্তু পরে মনে হললা চিঠিটা না লিখলে নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকব। অন্তত এইটুকু আমার ব্যাখ্যা করা উচিত কেন আমি অসুখের ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখলাম। আমার ব্যাখ্যাটা যে তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা আমার মনে হচ্ছে না। আমার নিজের কাছেই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না। তাহলে ব্যাখ্যাটা দিচ্ছি কেন? মানুষের স্বভাব হচ্ছে খুব বড় ধরনের ভুল করলেও কেন ভুল করল তার একটা ব্যাখ্যা সে দাঁড় করায়। যতটা না অন্যের জন্যে তারচে’ বেশি নিজের জন্যে। মূল কথা না বলে অন্য গীত গাইছি— তোমা তোমার নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত লাগছে। একটু ধৈর্য ধর, এক্ষুণি আমার সব কথা বলা হয়ে যাবে। আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলব। গল্পটা শেষ হওয়া মানে আমার সব কথা শেষ হওয়া।
আমার তখন সাত বছর বয়স। ক্লাস টুতে পড়ি। জন্ম থেকেই অসুখ বিসুখ আমার লেগেই আছে। দু’দিন পর পর জ্বরে পড়ি। ঠাণ্ডা লাগলেই সর্দি-কাশি। বাবা আমার অসুখ নিয়ে খুবই বিরক্ত। একদিন আমার মা’কে বললেন। শুধুমাত্র তোমার পুত্রের চিকিৎসার জন্যে বাড়িতে একজন ডাক্তারকে জায়গির রাখা দরকার। ডাক্তার ঘরেই থাকবে, খাবে আর বার মাস আমার ছেলের চিকিৎসা করবে। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওর চিকিৎসা আমি করব। প্রতিদিন আমার সঙ্গে সে এক মাইল হাঁটবে। ফজরের নামাজের পর একে তুমি কানে ধরে বিছানা থেকে তুলবে। আমি রোজ একে নিয়ে সান্ধিকোনা পুলের কাছের বটগাছ পর্যন্ত যাব। আবার ফিরে আসব। এই চিকিৎসার নাম হাঁটা চিকিৎসা। এই চিকিৎসা এক মাস করলে তোমার ছেলের আর কোনো চিকিৎসা লাগবে না। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন, টাইফুন কোনো অবস্থাতেই এই হাঁটা চিকিৎসা বন্ধ হবে না।
বাবা কথা যা বলেন কাজও তাই করেন। জমিদারি ভাবভঙ্গি আমাদের পরিবারে কারোর মধ্যেই ছিল না। শুধু বাবার মধ্যেই ছিল। আরম্ভ হলে আমার হাঁটাহাটি।
শুরুতে ব্যাপারটা যত ভয়ঙ্কর হবে বলে আমার মনে হচ্ছিল দেখা গেল ব্যাপার তেমন ভয়ঙ্কর না। বাবার মতো গম্ভীর ভারিক্কী ধরনের মানুষও সারা পথই আমার সঙ্গে গল্প করেন। যে বাবার ভয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকে দেখা গেল সকালবেলায় বাবা সেই বাবা না। সকালবেলায় বাবা খুবই মজার একজন মানুষ। এক এক দিন তিনি একেক রকম মজা করতে করতে হাঁটেন। আমি মহাউৎসাহে তার আঙুল ধরে থাকি। আমার বড়ই ভাল লাগে।
একদিন ভোরে আকাশ খুব মেঘলা করেছে। বৃষ্টি নামি নামি করছে। বাবা আমাকে নিয়ে বের হবেন। মা বললেন, দিন খারাপ। ঝড় বৃষ্টি হবে। আজ বের না হলে হয় না?
বাবা ধমক দিয়ে বললেন, কী বলেছিলাম ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন কোনো অবস্থাতেই হাঁটা বন্ধ হবে না? | মা বললেন, ছাতা নিয়ে যান।
বাবা বললেন, ছাতা কীসের? বৃষ্টি হলে ভিজতে ভিজতে যাব। এতে শরীর পোক্ত হবে। সামান্য ঠাণ্ডা বাতাস লাগলেই, সর্দি জ্বর এইসব হবে না।
আমি বাবার হাত ধরে রওনা হলাম। সান্ধিকোনা পুলের বটগাছের কাছে যাওয়ার আগেই তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। বাবা বললেন, বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগছেরে ব্যাটা?
আমি বললাম, ভাল।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, এক কাজ কর, শার্ট প্যান্ট খুলে নাংগু বাবা হয়ে যা। আশেপাশে দেখার কেউ নেই। সারা শরীরে বৃষ্টির পানি লাগলে জীবনে কোনো দিন ঘামাচি হবে না।
আমি বললাম, লজ্জা লাগে।
বাবা বললেন, দূর ব্যাটা! কে দেখবে? দেখবে শুধু আল্লাহপাক। আল্লাহপাকের কাছে কীসের লজ্জা?
আমি শার্ট খুলে ফেলেছি। প্যান্ট খুলতে যাব হঠাৎ দেখি বাবা যেন কেমন করছেন। যে হাতে তিনি আমাকে ধরে ছিলেন, সেই হাত কাঁপছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, বাবারে মহাবিপদ। আজ আমার মহাবিপদ!
আমি দেখলাম বটগাছের পেছন থেকে পাঁচ দু’জন মানুষ বের হয়ে এল। খুবই সাধারণ গ্রামের চাষাভুষা মানুষ। তারা আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে শুরু করল।
পরের ঘটনাগুলি ঘটল অতি দ্রুত। আমি দেখলাম এরা বাবাকে কাদার ভেতর ফেলে দিয়েছে। একজন গরু জবাই করার মস্ত বড় ছুরি বের করেছে। বাবা গোঙাতে গোঙাতে বলছেন, তোমরা আমার একটা কথা রাখ। এই দৃশ্য যেন আমার ছেলেটা না দেখে। তাকে সরায়ে নিয়ে যাও। আমাকে দয়া করার দরকার নেই, আমার ছেলেকে দয়া কর।
এই দয়া তারা করল না। বাবার কাছ থেকে চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি দেখলাম। লোকগুলি যেমন দ্রুত এসেছিল সে রকম দ্রুতই চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমার জবাই করা বাবার পাশে। কী বৃষ্টি! বাবার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। আর সেই পানি দেখতে দেখতে টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বাবার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলাম না। আমি তাকিয়েই রইলাম।
সেই থেকে আমার অসুখের শুরু।
দুই তিন বছর পর পর বর্ষার সময় অসুখটা হয়। যখন খুব বৃষ্টি হতে থাকে। তখন বৃষ্টির দিকে তাকালে হঠাৎ মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয় আমি একটা ভোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। আমার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলি অদ্ভুত উপায়ে লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে।
আমাকে সুস্থ করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। বড় বড় ডাক্তাররা আমাকে দেখেছেন। আমাকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে দেখেছেন। কোনো লাভ হয় নি। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন কখনো বৃষ্টি না দেখি। আকাশে মেঘ করলেই আমি যেন ঘরে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। সে চেষ্টাই এখন করি।
এই হলে আমার গল্প। খুবই ভয়ঙ্কর গল্প, আমি চেষ্টা করেছি সহজভাবে বলতে। তা কি আর সম্ভব? এমন ভয়ঙ্কর গল্প কি আর সহজ করা সম্ভব?
শামা এখন বলি আমি আমার অসুখের কথাটা কেন। গোপন করলাম। কেন জানি এক সময় আমার মনে হলো প্রবল বৃষ্টির সময় কেউ যদি গভীর মমতায় আমার হাত ধরে থাকে এবং আমার কানে কানে বলে কোনো ভয় নেই। আমি তোমার পাশে আছি। আমি তোমার হাত ধরে আছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়ব না। তাহলে হয়ত। আমার অসুখটা হবে না। এক সময় বৃষ্টিটা আমার কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে। কে জানে একদিন হয়ত সেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেও পারব।
আমার এ ধরনের চিন্তার পেছনে কোনো যুক্তি ছিল না, ছিল বিশ্বাস। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো চেপে ধরে আমিও তাই করতে চেয়েছি।
আমি খুবই ভুল করেছি। আমিতো আর তোমাদের মতো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ না। ভুলতত আমি করবই।
শেষবার এশার সঙ্গে যখন কথা হয়েছে সে আমাকে বলেছে অন্য এক জায়গায় তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে। তোমার খুব ভাল বিয়ে হোক এটা আমি মনেপ্রাণেই কামনা করছি। তোমার সঙ্গে আমার অতি সামান্য পরিচয় যেন কোনো অবস্থায়ই তোমার মনে কোনো ছাপ না ফেলে এই প্রার্থনা করছি।
আরেকটা কথা— মাঝে মধ্যে এশা টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। এই নিয়ে তুমি তার ওপর রাগ করো না।
এই চিঠিটা এশাকে দেখিও। শেষবার টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বুঝেছি সে আমার গোপন করার ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পেয়েছে।
এই চিঠিটা পড়লে তার কষ্ট সামান্য কমতেও পারে।
ইতি আতাউর
সুলতানা চিঠি ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন।
শামা বলল, মা তুমি কিছু বলবে?
সুলতানা চুপ করে রইলেন। শামা শান্ত গলায় বলল, মা তুমি বল আমি কি উনার সঙ্গে দেখা করে বলব চিঠিটা পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। আপনার ওপর আমি খুব রাগ করেছিলাম ঠিকই। এখন আর আমার কোনো রাগ নেই। বল মা, এটাও কি আমি বলব না?
সুলতানা জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।
শামা মুত্তালিব সাহেবের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। মুত্তালিব সাহেব নিজেও গাড়িতে আছেন। তিনি শামাকে নিয়ে পেছনের সীটে বসেছেন।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। এমন বৃষ্টি যে গাড়িতে বসে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মুত্তালিব সাহেব বললেন, এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আমরা কোথায় যাচ্ছি?
শামা বলল, জানি না চাচা।
মুত্তালিব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই কোথায় যাবি তা না জেনেই বের হয়েছিস?
শামা বলল, আমরা কী করব, না করব তা কি আমরা সব সময় জানি?
মুত্তালিব সাহেব জবাব দিলেন না। তিনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, শামা কাঁদছে। টপটপ করে শামার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
শামা বলল, চাচা আমি গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দেই?
মুত্তালিব সাহেব বললেন, ভিজে যাবি তো।
চাচা আজ আমার ভিজতে ইচ্ছা করছে।
মুত্তালিব সাহেব নরম গলায় বললেন, তোর যা করতে ইচ্ছে করে তুই কর। আমি আছি তোর সঙ্গে। মা-রে তুই কাঁদছিস কেন?
শামা জবাব দিল না। সে জানালার কাচ নামিয়ে মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে। সে কী করবে? সে কি গাড়িতে করে খানিকক্ষণ ঘুরে বাসায় ফিরে যাবে? যে। মানুষটা মাকড়সা ধাঁধার জবাব ঠিকঠাক দিতে পেরেছিল তার সঙ্গে জীবন শুরু। করবে?
না-কি আতাউর নামের মানুষটার কাছে উপস্থিত হয়ে বলবে, হ্যালো মিস্টার। আসুনতো আমার সঙ্গে বৃষ্টি দেখবেন। আজ আমরা বৃষ্টি বিলাস করব। কোনো ভয় নেই। আমি সারাক্ষণ আপনার হাত ধরে রাখব। এক মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়ব না। কী করবে শামা?
শামা কাঁদছে। শাড়ির আঁচলে সে চোখ মুছছে। কোনো বড় সিদ্ধান্ত সে নিয়ে নিয়েছে। মস্ত বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে আগে মেয়েদের চোখে সব সময় পানি আসে।