স্যার আমতা আমতা করছেন। জবাব দিচ্ছেন না।
কী, চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও। কেন ভূতের বাচ্চা গিললে?
ভূত বলে যে কিছু নেই এটা ছাত্রদের বোঝাবার জন্যে।
কিছু যদি না থাকে তাহলে তোমার পেটে যে জিনিসটা গজগজ করছে সেটা কী? বলো কী সেটা?
না, মানে অসুখ-বিসুখ কিছু হয়েছে বোধহয়।
অসুখ-বিসুখ কিছু না। ভূতের বাচ্চা হজম হচ্ছে না। দাঁড়াও, দেখি কী করা যায়। নাকোব ফুটো দিয়ে বের করে দিচ্ছি। সময় লাগবে। চট করে হবে না। পঞ্চাশটা বৈঠক দিতে হবে। তিন সেরা গরম পানি খেতে হবে। মুরগির পালক দিয়ে নাকে সুড়সুড়ি দিতে হবে। তখন খুব হাঁচতে থাকবে। সেই হাঁচির সঙ্গে ভূত বেরিয়ে আসবে। অনেক যন্ত্রণা।
আমরা দুজন বাসায় ফিরে চলেছি। বুড়ো ভগদলোক ভূতের বাচ্চাটা বের করে আবার বোতলে ভরে আমাকে দিয়েছেন। অংক স্যারের ঢেকুর তোলা বন্ধ হয়েছে। তবে তিনি খুব গম্ভীর। একবার শুধু বললেন, ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, তাহলে কি স্যার ভূত আছে?
আরে না, ভূত আবার কী? ঐ বুড়ো আমাদের বোকা বানিয়েছে। ব্যাটা মনে হচ্ছে বিরাট ফাজিল।
কিন্তু স্যার আপনার ঢেকুর তো বন্ধ হয়েছে।
স্যার কিছু বললেন না। তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হলো। যেন কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে এক দারুণ ব্যাপার হলো।
নাইন-টেনের ছেলেরা মিলে ঠিক করল, আম-কাঁঠালের ছুটি খানিকটা এগিয়ে দেবার জন্যে হেড স্যারের কাছে দরবার করবে। দরবারটা যাক্তে জোরাল হয়। সে জন্যেই সব ক্লাস থেকে দুজন করে যাবে। যে দুজন যাবে তারা যেন অবশ্যই খুব ভালো ছাত্র হয়। ফার্স্টসেকেন্ড হওয়া ছেলে হলে ভালো। স্যাররা ভালো ছাত্রদের ওপর চট করে রাগেন না।
দীপু হচ্ছে আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সে সব শুনে বলল, আগে-ভাগে ছুটি নিয়ে হবেটা কী আম-কাঁঠালের দুটি না হলেই সবচে ভালো হয়। মন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারি।
কথা শুনে রাগে গা জ্বলে যায়। ইচ্ছা করে ঠাস করে মাথায় একটা চটি বসিয়ে দিই। তার উপায় নেই, এরা ভালো ছাত্র। স্যারের কাছে নালিশ করলে সর্বনাশ।
আমাদের ক্লাস থেকে কেউ দেখি যেতে রাজি নয়। আমি একাই গেলাম। বিরাট একটা দরখাস্তও লেখা হলো। ক্লাস টেনের বগা ভাই (আসল নাম বদরুল ইসলাম। খুব লম্বা বলে আমরা তাকে ডাকি বগা ভাই) হেড স্যারের হাতে দরখাস্ত তুলে দিল। হেড স্যার বললেন, ব্যাপার কী?
বগা ভাই তোতলাতে তোতলাতে বলল, দরখাস্তে সব লে-লে-লে-লেখা আছে স্যার।
বগা ভাইয়ের এই একটা অসুবিধা, ভয় পেলে তোতলাতে শুরু করে। এবং প্রতিটি বাক্য দুবার করে বলে। সে আবার বলল, দরখাস্তে সব লে-লে-লে-লেখা আছে স্যার।
লেখা যে আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ব্যাপারটা কী তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই।
আম-কাঁঠালের ছুটি দুই সপ্তাহ এগিয়ে দিলে ভালো হয় স্যার।
কেন?
আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। ছুটি এগিয়ে দিলে কেন ভালো হয়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করি নি। হেড স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথা বল।
কেউ নড়াচড়া করছে না দেখে সাহসে ভয় করে আমিই মুখ খুললাম। মিনমিন করে বললাম, এইবার তো স্যার গরম খুব বেশি পড়েছে, আম-কাঁঠাল সব আগে আগে পেকে গেছে। এই জন্যে স্যার ছুটিটা যদি এগিয়ে দেন।
আম-কাঁঠাল পাকানো কাকে বলে জানিস?
জি-না স্যার।
এক্ষুণি দেখবি কাকে বলে। কত বড় সাহস। বলে ছুটি এগিয়ে দিতে। যা ক্লাসে যা। ক্লাসে গিয়ে নীলডাউন হয়ে থাক।
ক্লাসে ফিরে এসে নীলডাউন হয়ে আছি। বশির দাঁত বের করে হাসছে। কাউকে শাস্তি দিতে দেখলে তার ভারি আনন্দ হয়। সে আজ আর আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর পর সব কাটা দাঁত বের করে দিচ্ছে।
টিফিন টাইমে দপ্তরি কালিপদ নোটিশ নিয়ে এলো। হেড স্যার নোটিশ পাঠিয়েছেনছাত্রদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে এই বৎসরের গ্ৰীষ্মকালীন বন্ধের সময়সীমা দুই সপ্তাহ কমিয়ে দেয়া হলো। নির্ধারিত সময়ের দুই সপ্তাহ পর থেকে বন্ধ শুরু হবে। এই নিয়ে কোনো রকম দেন-দরবার না করবার জন্য ছাত্রদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
ছুটির পর খুবই মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। কী করা যায় কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন ছুটি এগিয়ে আনবার দরকার নেই; যথাসময় ছুটি আরম্ভ হলেই আমরা খুশি। তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের হেড স্যার খুব কঠিন চিজ।
সন্ধ্যার আগে আগে মুনির এসে উপস্থিত। সেও ছুটি কমে যাওয়ায় মন খারাপ করেছে। এই ছুটিতে তার মামাবাড়ি যাবার কথা। ছুটি কমে গেলে আর যাওয়া হবে না।
মুনির বলল, চল তাঁর কাছে যাই। তিনি যদি কোনো বুদ্ধি দেন।
কার কথা বলছিস?
আমাদের যিনি ভূতেব বাচ্চা দিলেন। ঐ যে রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে।
উনি বুদ্ধি দেবেন কেন?
দিতেও তো পাবেন। আমাদের কথা তো উনি শোনেন। শোনেন না?
চল চাই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে উনি হেড স্যারের মতো রেগে যাবেন। সব বড়রা এক রকম হয়।
তবু বলে দেখি।
বুড়ো ভদ্রলোক দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আমাদের সমস্যা শুনলেন। তারপর বললেন, অন্যায়, খুবই অন্যায়। ছুটি কমাবার কোনো রাইট নেই। বাচ্চা ছেলেগুলোকে সারাদিন স্কুলে আটকে রেখেও শখ মিটছে না, এখন আবার ছুটি কমিয়ে দিচ্ছে। রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে খুব রাগ করতেন।