এই তোর ভূতের বাচ্চা?
জি স্যার।
আজ আর কিছু বললাম না। এইসব আজেবাজে জিনিস বিশ্বাস করার জন্যে কাল কঠিন শাস্তি হবে। কাল তুই তোর ভূতের বাচ্চা নিয়ে স্কুলে আসবি। দেখবি পোচ নম্ববি বেতের কেরামতি।
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কাল যা হবার হোক, আজ রাতটায় তো নিস্তার পাওয়া গেল। এই বা কম কী?
ভূতের কথা শুনে বাড়িতে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। সবাই ভূতের বাচ্চা হাতে নিয়ে দেখতে চায়। দেখতে চাইলেই তো হাতে দেয়া যায় না। হয়তো ফাট করে হাত থেকে ফেলে দেবে।
একমাত্রা অরু আপাই ভূতের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাল না। অরু, আপা সায়েন্স পড়ে। যারা সায়েন্সে পড়ে তাদেরকে সব কিছুই অবিশ্বাস করতে হয়। কাজেই সে ঠোঁট উল্টে বলল, ভূত না ছাই। খানিকটা ধোঁয়া বোতলে ভরে দিয়ে দিয়েছে। নীল রঙের ধোঁয়া।
নীল রঙের ধোঁয়া শুনে আমার খটকা লাগল। ব্যাপারটা কী, নীল রঙের ধোঁয়া বলছে কেন? আমি তো একটু আগে দেখলাম হলুদ।
ও মা, কী কাণ্ড! বোতল হাতে নিয়ে একেক জন বলতে লাগল।
বড়চাচাও অবাক হয়ে গেলেন। চোখে চশমা পরে অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, ব্যাপারটা রহস্যজনক। আমি খয়েরি রঙ দেখতে পাচ্ছি। এর মানেটা কী?
বড়চাচার কথায় সবার গা ছমছম করতে লাগল। আমার দাদি কেঁদে উঠলেন। কী অলক্ষুণে কাণ্ড। ভূতের বাচ্চা ধরে নিয়ে এসেছে। এই হুঁমায়ূন, যা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আয়। তোমরা দাঁড়িয়ে দেখছি কী? এই ছেলেকে গরম পানি দিয়ে গোসল করাও। লবণ খাওয়াও।
অনেক রাতে বড়দের একটা মিটিং বসল। আমার বাবা বললেন, ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে একেক জন যে একেক রকম রঙ দেখছে এটা সত্যি।
ছোটচাচা বললেন, ঘোড়ার ডিমটা রাস্তায় নিয়ে ফেলে দিলে ঝামেলা চুকে যায়।
বড়চাচা তাতে রাজি না। তিনি আরো পরীক্ষা করতে চান। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো রাতের বেলা বোতলটা সিন্দুকে তালাচাবি দিয়ে রাখা হবে। আগামীকাল যা করার করা হবে। বিশেষ করে স্কুলের অংক স্যার যখন বলেছেন বোতল স্কুলে নিয়ে যেতে–সেটাই করা তোক।
পরদিন আমি বোতলটা স্কুলে নিয়ে গেলাম। ওমা! সবাই দেখি এই খবর জানে। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা পর্যন্ত হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আমাদের ক্লাস-ক্যাপ্টেন ফিসফিস করে বলল, আমাকে একবার যদি হাতে নিতে দিস তাহলে আব্ব কোনোদিন বোর্ডে নাম লিখব না।
অংক স্যার ক্লাসে ঢুকলেন বেত নিয়ে। তিন নম্বরি এবং পাঁচ নম্বরি বেত। আনন্দে বশির হেসে ফেলল। কাউকে শান্তি দেয়া হবে টের পেলেই বশিরের বড় আনন্দ হয়। সে দাঁত বের করে বলল, আজ যা মজা হবে। হুমায়ূনকে স্যার টাইট দেবে। সে মজা দেখার জন্যে আমার পাশে এসে বসল।
অংক স্যার হুংকার দিলেন, হুঁমায়ূন, এসেছিস?
জি স্যার।
ভূত এনেছিস?
জি স্যার।
বেবী কর, সবাইকে দেখা।
সবাই দেখেছে স্যার।
গুড। এখন এই ক্লাসে কারা কারা বিশ্বাস কবে যে এর ভেতর সত্যি একটা ভূতের বাচ্চা আছে? হাত তোল।
আমার দেখাদেখি আরো দশ-বার জন্য হাত তুলল।
স্যার বললেন, কী কারণে বিশ্বাস হয় যে এর ভেতর সত্যি ভূত আছে?
আমাদের ক্লাস-ক্যাপ্টেন বলল, একেক জন একেক রকম রঙ দেখে স্যার।
তাই নাকি।
জি স্যার। আমি দেখেছি সবুজ রঙ, আর মতিন দেখেছে লাল।
অংক স্যার চোখ কুঁচকে বললেন, আরো গাধার দল, তোরা যে রঙের সার্ট পরেছিস বোতলে সেই রঙ দেখতে পাচ্ছিস। মতিনের গায়ে লাল স্যুয়েটার, এই জন্যে সে দেখছে লাল। আসলে চিচিং ফাঁক। শুভঙ্করের ফাঁকি। কি, বিশ্বাস হয়?
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। ব্যাপারটা আসলেই তাই। আমি হলুদ দেখছি, কারণ আমার সুয়েটারের রঙ হলুদ। অংক স্যার মেঘগর্জন করলেন, যত বেকুবের দল, সহজ জিনিস বোঝে না। এখন মন দিয়ে শোন, এই বোতলে যা আছে তা আমি গিলে ফেলব।
আমরা অবাক হয়ে তাকালাম। স্যার বলে কী! গিলে ফেলবে মানে! স্যার গম্ভীর মুখে বললেন, গিলে ফেলে তোদের বোঝাব যে আসলে কিছু না। হাতেনাতে না দেখালে তোদের জ্ঞান হবে না। গাধার দল। ক্লাস-ক্যাপ্টেন কোথায়?
এই যে স্যার।
যা এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। পানি দিয়ে গিলব।
ক্লাস-ক্যাপ্টেন ছুটে গেল পানি আনতে। বশির বলল, হুমায়ূনকে শাস্তি দেবেন না স্যার? ওর শাস্তি পাওয়া দরকার। সবাইকে বোকা বানিয়েছে।
হবে, শাস্তি হবে। আগে ভূতটা গিলে ফেলি, তারপর শাস্তি।
পানি এসে গেল। অংক স্যার ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিলেন–দেশটা কুসংস্কারে ড়ুবে আছে। একজন হোমিওপ্যাথির শিশিতে ভূতের বাচ্চা ভরে এনেছে। অন্য সবাই তাই বিশ্বাস করছে। ছিঃ ছিঃ।
বলতে বলতে স্যার বোতলের মুখ খুলে নিজের মুখে উপুড় করে ধবলেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে বললেন, গিলে ফেললাম। হলো এখন? ভূতের বাচ্চা হজম।
স্যার একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। আমরা অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন এবং আবার একটি ঢেকুর তুললেন। তারপর আবার একটি।
আমার মনে হলো স্যার কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। খানিকক্ষণ পেটে হাত বোলালেন। বোতলটা শুকে দেখলেন। এবং আবার বেশ বড় রকমের একটা ঢেকুর তুললেন। মনে হলো তিনি কেমন যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছেন।
বশির বলল, স্যার হুমায়ূনের শান্তি দিলেন না?
স্যার সেই কথা যেন শুনতেও পেলেন না। ঝিম ধরে চেয়ারে বসে রইলেন এবং একটু পরপর ঢেকুর তুলতে লাগলেন। সেদিন আর ক্লাসে কোনো অংক করা হলো না।
সূৰ্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে
সূৰ্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বই নিয়ে বসার কথা। এটা হচ্ছে বড়চাচার কঠিন নিয়ম। তবে সব নিয়মেরই ফাক আছে। এই নিয়মের বেলাতেও তা সত্যি। মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা বড়চাচা রাজনীতি নিয়ে আলাপ করবার জন্যে পাশের উকিল সাহেবের বাড়ি যান। সেই বাড়িতে যাওয়া মানে পাক্কা তিন ঘণ্টার ধাক্কা। ফিরতে ফিরতে রাত নটা। ঐসব দিনগুলিতে সূৰ্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে বই নিয়ে বসার দরকার নেই। কিছুক্ষণ খেলাধূলা করা যায়। আমরা ছোটরা বড়চাচা ছাড়া কাউকে ভয় করি না। আমার ধারণা সব বাড়িতে এরকম এক-আধা জন মানুষ থাকে যাদের সবাই ভয় করে, অন্যদের পাত্তাই দেয় না।