না, পাগল হবে কেন?
কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছে।
মুনির কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল, কারণ ভদ্রলোক আবার এসে ঢুকেছেন। হোমিওপ্যাথি, ওষুধের শিশিতে হলুদ রঙের ধোঁয়াটে কী একটা জিনিস।
সাবধানে রাখবি। মুখ গালা দিয়ে সিল করে রেখেছি। খবরদার, সিল ভাঙবি না। মাঝে মাঝে চাঁদের আলোতে রাখবি। এরা চাঁদের আলো খায়। ব্ৰহ্মপুত্রের পাড় দিয়ে বোতল হাতে নিয়ে হাঁটবি। এরা টাটকা বাতাস পছন্দ করে।
আমি বললাম, বোতলের ভেতর তো বাতাস যাবে না।
ভদ্রলোক কড়া গলায় বললেন, এই ছেলে তো বেশি কথা বলে। শোন ছোকরা, কথা কম বলবে।
জি আচ্ছা।
এখন বাড়ি চলে যাও। যাবার আগে একটা কবিতা শুনে যাও। টাটকা কবিতা। আজ বিকেলে লিখেছি। দুঘণ্টা মতো হয়েছে। এখনো বাসি হয় নি। ছঘণ্টার আগে কবিতা বাসি হয় না। শুধু গরম কালে তিন ঘণ্টাতেই বাসি হয়।
আমরা চুপচাপ বসে আছি। রবি নানা পকেটে হাত দিয়ে কবিতা লেখা কাগজ বের করলেন। মাথা দুলিয়ে পড়তে শুরু করলেন–
আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু
পার হয় গাড়ি।
দুই ধার উঁচু তার
ঢালু তার পাড়ি।
কবিতাটা আমার বেশ ভালো লাগল। তবে কেন জানি মনে হতে লাগল। আগেও পড়েছি।
কবিতাটা কেমন?
খুবই ভালো।
ব্ৰহ্মপুত্র নিয়ে লেখা। আচ্ছা, যাও এখন, বাড়ি যাও। রাত হয়ে যাচ্ছে।
ভূতের বাচ্চা নিয়ে আমরা চলে এলাম। আমার বারবার মনে হতে লাগল এটা সত্যি নয়। কোথাও মস্ত একটা ফাকি আছে। মুনিরের একটা হাত পকেটে। সেই হাতে সে নিশ্চয়ই বোতল ধরে আছে। একবার সে ক্ষীণ গলায় বলল, কেমন জানি গরম-গরম লাগছে।
ব্ৰহ্মপুত্রের পাশ দিয়ে আসছি। নদীর উপর ক্ষীণ চাঁদের আলো। আমাদের কেন জানি বেশ ভয়ভয় করতে লাগল। মুনির ফিসফিস করে বলল, বোতলটার ভেতর ঐটা নড়াচড়া করছে রে।
ভয় লাগছে।
হুঁ।
আমার কাছে দিয়ে দে। সকালবেলা নিয়ে নিবি। দিনের আলোয় আর ভয় লাগবে না। মুনির সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শিশিটা দিয়ে দিল। প্যান্টের পকেটে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি সত্যি সত্যি একটু যেন গরম গরম লাগছে।
বাসায় এসে ভয়াবহ দুঃসংবাদ শুনলাম। অংক স্যার নাকি সন্ধ্যার পর এসেছিলেন। আমি এখনো ফিরি নি। শুনে খুব রেগে গেছেন। বলে গেছেন আবার আসবেন।
অংক স্যারের এই হচ্ছে একটা বদ অভ্যাস। হঠাৎ হঠাৎ সন্ধ্যার পর ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হন। বাজখাই গলায় বলেন, কী, পড়াশোনা হচ্ছে কেমন? দেখি পাটিগণিতটা আন তো।
আমাদের বাড়িটা বেশ অদ্ভূত
আমাদের বাড়িটা বেশ অদ্ভূত।
এই বাড়িতে দুদল মানুষ থাকে। ছোট আর বড়। ম্যাট্রিক ক্লাসের নিচে যারা তারা সবাই ছোট। আর ম্যাট্রিক ক্লাসের উপরে হলেই বড়। যত যন্ত্রণা ছোটদের। সন্ধ্যা হতে না হতেই তাদের পড়তে বসতে হবে। পড়তে হবে চেঁচিয়ে, যাতে সবাই শুনতে পায়। পড়ার সময় বড়রা কেউ না কেউ থাকবেই। এদের একটামাত্র কাজ–একটু পরপর ধমক দেয়া।
এ বাড়ির ছোটদের মধ্যে আছি। আমি এবং আমার দুই ছোট ভাই। এরা বেশি ছোট। একজন টুতে পড়ে। অন্যজন স্বরে আ স্বরে আ করে আর বইযেব পাতা ছেড়ে। বড়দের দলে আছে বাবা, মা, আমার বড়চাচা এবং বড়চাচার মেয়ে অরু আপা। অরু আপা কিছুদিন আগেও ছোটদের দলে ছিল। ম্যাট্রিক পাস করায় এখন বড়দের দলে চলে গেছে। ফার্স্ট ডিভিশন আর চারটা লেটার পাওয়ায় খুব দেমাগি হয়েছে।
আজ পড়া দেখিয়ে দিচ্ছে অরু আপা। রোজ সন্ধ্যায় সে খানিকক্ষণ আমাদের পড়া দেখিয়ে দেয়। অরু আপা এমিতে খুব ভালো মেয়ে–হাসিখুশি, কিন্তু পড়া দেখাতে গেলেই সে কেমন জানি হয়ে যায়। মুখ কঠিন, গলার স্বর। থমথমে আর এমনভাবে তাকায়, যেন এক্ষুণি এসে আমাকে কামড় দেবে। আজ পড়ছি জলবায়ু। অরু আপা বলল, মৌসুমী বায়ু কাকে বলে? আমি অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললাম, ঠাণ্ডা এবং মোলায়েম বায়ুকে মৌসুমী বায়ু বলে। এই বায়ু গায়ে লাগলে খুব আরাম। তবে বেশি লাগলে সর্দি হবার সম্ভাবনা। যাদের টনসিলের দোষ আছে তাদের মৌসুমী বায়ু গায়ে লাগান উচিত নয়।
অরু, আপা হাত উচিয়ে বলল একটা চড় দেব।
আমাকে চড় দিলে তুমিও খামচি খাবে।
ফাজিল।
তুমিও মহিলা ফাজিল।
অরু আপা রাগে কিড়মড় করতে করতে সত্যি একটা চড় বসিয়ে দিল। আমিও খামচি দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, ঠিক তখনই বাবা এসে বললেন, এই হুমায়ূন তুই বাইরে আয়। তোর স্যার এসেছে–অংক স্যার।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। অরু, আপাকে খামচি দেয়া গেল না। তার উপর আবার অংক স্যার এসে বসে আছেন। পড়া ধরবেন। কিনা কে জানে।
সন্ধ্যাবেলা কোথায় ছিলি?
অংক স্যার মেঘগর্জন করলেন। আমি চুপ করে রইলাম। কোনো কথা না বলাই এখন নিরাপদ।
সত্যি কথা বল। মিথ্যা বললে তোকে পুঁতে ফেলব। বেয়াদবের ঝাড়। সন্ধ্যাবেলা ঘুরে বেড়ানো! বল, কোথায় ছিলি?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ভূতের বাচ্চা আনতে গিয়েছিলাম স্যার।
কী বললি?
একজনের কাছ থেকে একটা ভূতের বাচ্চা আনতে গিয়েছিলাম।
এনেছিস?
জি।
কোথায়?
আমার পকেটে স্যার।
অংক স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর নাক ধুলে-ফুলে উঠতে লাগল। ভীষণ রেগে গেলে স্যারের এরকম হয়। আমি খুব ঘামতে লাগলাম। না জানি কী হয়।
ভূতের বাচ্চা আনতে গিয়েছিলি?
জি স্যার।
কোথায় সেই ভূতের বাচ্চা? পকেটে স্যার।
প্যান্টের পকেটে।
বের কবি।
আমি বের করলাম। ছোট্ট হোমিওপ্যাথির শিশি, গালা দিয়ে মুখ বন্ধ কিবা। ভেতরে ধোঁয়াটে একটা কিছু।