মুনির এখনো দাঁড়িয়ে। শাস্তির অপেক্ষা করছে। বেশ ভয়ও পেয়েছে। অল্প অল্প কাঁপছে। অংক স্যার বললেন, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বাস।
মুনির বসল। আড়চোখে কয়েকবার তাকাল আমার দিকে। তারপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, এই কুমায়ূন, ভূত পুষবি?
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কী! ভূত পুষব মানে? ভূত কি কুকুরছানা নাকি?
মুনির ফিসফিস করে বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় একটা ভূতের বাচ্চা আনতে যাব।
ভূতের বাচ্চা আনতে যাবি মানে! ভূতের বাচ্চা পাওয়া যায় নাকি?
একজন আজ আমাকে একটা ভূতের বাস্ত দেবে। সম্ভার সময় যেতে বলেছে। তুই যাবি।
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। মুনিরটা এমন আগ্রহ করে তাকাচ্ছে। আমার মার খাওয়া দেখে হয়তো তার মায়া লেগেছে। এখন আমাকে খুশি করতে চায়।
হুমায়ূন যাবি?
যাব।
খবরদার কাউকে বলবি না।
আচ্ছা বলব না।
কোনো কথা কাউকে না বলে থাকা কষ্টের ব্যাপার। তখন কথাটা পেটের মধ্যে বড় হতে থাকে। পেট গুড়গুড় করে। খুব অস্বস্তি হয়। এই জন্যে কোনো কথা বেশিক্ষণ রাখতে নেই। খুব গোপনীয় কথাগুলি বটগাছকে বলে পেট হালকা করতে হয়। বটগাছ সেই কথা কাউকে বলতে পারে না বলে আর কেউ জানতে পারে না।
স্কুল ছুটির পর আমরা রওনা হলাম। ব্ৰহ্মপুত্রের পাড় ধরে-ধরে অনেক দূর যেতে হলো। কেওটখালির কাছাকাছি এসে নদী পার হলাম। শীতকাল, কাজেই পানি বেশি নেই। খেয়া-নৌকা আছে। দশ পয়সা করে নেয়। মুনির পয়সা দিয়ে দিল। সন্ধ্যা এখনো হয় নি। এর মধ্যে চারদিক অন্ধকার। গাছপালার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এক সময় দোতলা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গাছপালায় ঢাকা জঙ্গুলে জায়গায় শ্যাওলা ঢাকা এক বাড়ি। লোহার গেট। সেই গোটে বাড়ির নাম লেখা—শান্তিনিকেতন। আমি ভয়ে-ভয়ে বললাম, কোথায় নিয়ে এলি? এটা কার বাড়ি?
আমার এক আত্মীয়-বাড়ি। দূর সম্পর্কের নানা হয়।
এই লোকই তোকে ভূতের বাচ্চা দেলে?
হুঁ।
গুল ছেড়েছে।
না, গুল ছাড়ে নি।
কী করে বুঝলি গুল ছাড়ে নি?
চেহারা দেখলে তুইও বুঝবি। সন্ন্যাসীর মতো চেহারা। সন্ন্যাসীরা কি গুল ছাড়ে?
অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাবার পর যিনি দরজা খুললেন, তাঁকে দেখে আমি অবাক। অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক সে-রকম লম্বা দাড়ি। সাদা বাবড়ি চুল। লম্বা একজন মানুষ। পরনে আলখাল্লার মতো লম্বা একটা পোশাক। গলার স্বরও কী গম্ভীর।
দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ভেতরে আয়। সঙ্গে এটি কে?
আমার বন্ধু। এও ভূতের বাচ্চা নেবে।
আমি কি দোকান দিয়ে বসেছি নাকি, যে-ই আসবে একটা করে ভূতেব বাচ্চা দিয়ে দেব? একটা দেব বলেছিলাম, একটা পাবি। ভেতরে এসে বস।
আমরা সিঁড়ি ভেঙে দোতলার একটা ঘরে ঢুকলাম। সেই ঘরে বই ছাড়া আর কিছুই নেই। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু বই আর বই। মাঝখানে একটা ইজিচেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। ইজিচেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিল। টেবিলে একটা অদ্ভুত ধরনের টেবিল ল্যাম্প। উনি বোধহয় এখানে বসেই বই পড়ছিলেন।
তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বাস। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বস। নাকি মেঝেতে বসলে তোদের মান যাবে?
আমরা পা ছড়িযে মেঝেতে বসে পড়লাম। আমার একটু ভয়ভয় করছে।
কিছু খাবি তোরা?
জি-না।
ভূতের বাচ্চা যে নিবি, কোনো পাত্র এনেছিস?
মুনির না-সূচক মাথা নাড়ল।
ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, কিছু নিয়ে আসিস নি, তাহলে নিবি কী কলে? পকেটে কের তো আর নিতে পারব না। তৃত হচ্ছে হাওয়ার তৈরি। আচ্ছা! দেখি ঘরে কিছু আছে
তিনি আমাদের বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। বুঝতে পারছি বাড়িটা অনেক বড়। অনেকগুলি ঘর। কিন্তু এই ঘরটি ছাড়া অন্য কোনো ঘরে বাতি জ্বলছে না। লোকজনেরও কোনো সাড়া নেই। আমি ফিসফিস করে বললাম, এই বাড়িতে আব্ব কেউ থাকে না?
না।
উনার নাম কী?
আগে অন্য নাম ছিল। এখন উনাকে রবিবাবু বলে ডাকতে হয়। রবি-বাবু না ডাকলে রাগ করেন। আমি ডাকি রবি নানা।
উনি করেন কী?
কিছু করেন না। শুধু বই পড়েন। আর কবিতা লেখেন।
কবিতা লেখেন কেন?
নোবেল প্রাইজ দরকার তো, এই জন্যে কবিতা লেখেন। কবিতা না লিখলে নোবেল
প্রাইজ পাওয়া যায় না। তুই আর কথা বলিস না তো। চুপ করে থােক। বেশি কথা বললে উনি রাগ করেন।
আমি চুপ করে গেলাম। ভদ্রলোক ঢুকলেন হাতে ছোট্ট একটা হোমিওপ্যাথি, ওষুধের শিশি নিয়ে। ভূতের বাচ্চা কি উনি এর মধ্যে ভরে দেবেন? কী সর্বনাশ!
বোতল একটা পাওয়া গেছে, গরম পানিতে ধুতে হবে। সময় লাগবে।
আমি কিছু বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, এত ছোট বোতলের মধ্যে থাকবে?
আমার কথায় ভদ্রলোক অত্যন্ত রেগে গেলেন। চোখ বড়বড় করে বললেন, ছোট একটা কলসির মধ্যে যদি বিশাল দৈত্য থাকতে পারে, হোমিওপ্যাথির শিশির মধ্যে ভূতের বাচ্চা থাকতে পারবে না?
আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক ধমকের সুরে বললেন, জবাব দাও–পারবে কী পারবে না?
পারবে।
হুঁ, দ্যাটস গুড। কী নাম তোমার?
হুমায়ূন।
ক্লাস সিক্সে পড়?
জি।
রোল নাম্বারা কত?
বত্ৰিশ।
ক্লাসে ছাত্র কত জন?
বত্ৰিশ।
তার মানে পড়াশোনা কিছুই পার না?
জি না।
স্কুল ভালো লাগে না?
জি না।
রবি ঠাকুরেরও স্কুল ভালো লাগত না। তাই বলে তুমি মনে করো না যে তুমি রবি ঠাকুর।
আমি মনে করি না।
গুড। এখন বলে তো আমার চেহারাটা রবি ঠাকুরের মতো না?
জি।
মুশকিল হচ্ছে কী জানো? টাক পড়ে যাচ্ছে। টাকিওয়ালা রবীন্দ্রনাথ অসহ্য, তাই না?
আমরা কিছু বললাম না। ভদ্রলোক আমাদের রেখে হোমিওপ্যাথির শিশি হতে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। আমি মুনিবকে বললাম তোর এই নানা কি পাগল?