আমরা মুখ শুকনো করে মাঠে নোমলাম। পকেটে বোতল ভূতের শিশি। আমি মনে মনে বললাম, ভাই বোতল ভূত। আমাদের বক্ষা কর ভাই।
রয়েল বেঙ্গল ফুটবল ক্লাব বনাম বুলেট ক্লাবের ফাইনাল খেলায় এমন হুলস্থুল হবে কে ভেবেছিল? মাঠ লোকে লোকারণ্য। একটা ব্যান্ড পার্টি পর্যন্ত আছে। কিছুক্ষণ পরপর ব্যান্ড পার্টি বাজাচ্ছে–হলুদ বাট, মেন্দি বাট, বাট ফুলের মেী। এই একটি মাত্র গানই এরা জানে। সব অনুষ্ঠানে এই গান।
ব্যান্ড পার্টি এনেছেন আব্দুল মতিন সাহেব। তাঁর কাণ্ডকারখানা এরকমই। সব সময় চান লোকজনকে চমকে দিতে। যারা ইলেকশন করে তাদের নাকি এরকম করতে হয়। কোথাও লোকজন জড়ো হলে একটা ভাষণ দিতে হয়। আজও নিশ্চয়ই দেবেন।
মাইক এসেছে। রোগা একটা ছেলে কিছুক্ষণ পরপর বলছে–হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং। ওয়ান টু থ্রি ফোর। মাইক্রোফোন টেস্টিং। রোগা ছেলেটি চলে যাবার পর তার চেয়েও রোগা আরেকটি ছেলে এসে মাইকের সামনে দাঁড়াল। খুব কায়দা করে বলল, জরুরি ঘোষণা, জরুরি ঘোষণা। ভাইসব, একটি বিশেষ ঘোষণা। অত্র অঞ্চলের বিশিষ্ট সমাজসেবী, জনগণের নয়নের মণি, এ যুগের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, জনাব আব্দুল মতিন মিয়া এই মাত্র একটি স্বর্ণপদক ঘোষণা করেছেন। আজকের এই ফাইনাল ম্যাচের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়ের জন্যে এই স্বর্ণপদক। খেলার শেষে এই স্বর্ণপদক দেয়া হবে। ভাইসব, জরুরি ঘোষণা.
এই ঘোষণায় বুলেট ক্লাবের সবার মুখে হাসি দেখা গেল। কেনই বা হাসি দেখা যাবে না? শিন্ড, স্বর্ণপদক সব তো ওরাই পাবে। আমরা হাত-পা ভেঙে বাড়ি ফিরব।
আমরা মুখ শুকনো করে মাঠে নোমলাম। ব্যান্ড পার্টি বিপুল উৎসাহে বাজাতে লাগলউলুদ বাট, মেন্দি বাট, বাট ফুলের মউ।
রেফারি হচ্ছেন আমাদের স্কুলের ড্রিল স্যার–অজিত বাবু। খুব রোগী বলে আমরা তাঁর নাম দিয়েছি জীবাণু স্যার।
জীবাণু স্যার আমাদের দেখে অবাক হয়ে বললেন, তোরা মাত্ৰ নজন কেন? বাকি দুজন কই?
আমি বললাম, ওরা খেলবে না স্যার।
কেন?
বুলেট ক্লাবের বগা ভাই ভয় দেখিয়েছে, খেলতে নামলে পা ভেঙে দেবে।
বলিস কী!
সত্যি কথা স্যার। ওদের দলে একজন আছে–নাম ল্যাংচু। ওর কাজই হচ্ছে ল্যাং মারা। ল্যাং মেরে পা ভেঙে ফেলা।
বিচিত্র না, ভাঙতেও পাবে। সাবধানে খেলবি। খবরদার, চার্জ-ফার্জ করতে যাবি না।
জীবাণু স্যার বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। খেলা শুরু হলো। আমি পকেটে হাত দিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, ও ভাই বোতল ভূত, আমাদের বাঁচাও ভাই।
কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল বগা ভাই বিদ্যুৎগতিতে বল নিয়ে আমাদের গোলপোস্টের দিকে যাচ্ছে। বদরুল তাকে আটকাতে গিয়ে উল্টে পড়ে গেল। কারণ ল্যাংচু তাকে পেছন থেকে ল্যাং মেরেছে। গোলপোস্টে আমাদের গোলকিপার নাটু চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। এটাই হচ্ছে তার নিয়ম। বল নিয়ে কেউ গোলপোক্টের দিকে আসতে থাকলে আপনাতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
বগা ভাই গোলপোস্টের প্রায় ছগজের ভেতর চলে এসেছে। নান্টু চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তখন একটা অঘটন ঘটল। মনে হলো কেউ একজন যেন প্ৰচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে বগা ভাইয়ের গালে। বগা ভাই। থমকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। তার পায়ে বল, অথচ সে শর্ট দিচ্ছে না। মাঠে তুমুল হৈচৈ–কিক দাও। কিক দাও। হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন, কিক দাও।
বগা ডাই নিজেকে সামলে নিয়ে প্ৰচণ্ড কিক দিল। আশ্চর্যের উপর আশ্চৰ্য। প্ৰচণ্ড কিকের পরও বলের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। বলটা যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় গড়িয়ে যাচ্ছে। এক সময় নাটুর পায়ের কাছে বলটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই দাঁড়িয়ে থাকা বলের উপর ন্যান্টু বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে এমন ভঙ্গি করতে থাকল, যেন সে বুলেটের মতো গতির বলকে অপূর্ব কায়দায় আটকেছে।
মজা আরো জমল। বুলেট ক্লাবের যে-কোনো প্লেয়ার বল নিয়ে এগিয়ে এলেই অদৃশ্য কে যেন চড় বসিয়ে দেয়।
ল্যাংচু হতভম্ব। কারণ কিছুক্ষণ পরপর সে চড় খাচ্ছে। একবার দেখা গেল সে কোমবে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। হাসি আর থামেই না। মাঠের সবাই হতভম্ব।
ড্রিল স্যার অবাক হয়ে বললেন, এই ছেলে, তুমি এরকম করছ কেন? হাসছ কেন?
ল্যাংচু করুণ মুখে বলল, কী করব স্যার বলুন–কে যেন কাতুকুতু দিচ্ছে।
কাতুকুতু দিচ্ছে মানে! কী বলছ তুমি?
সত্যি দিচ্ছে স্যার। হিহিহি। হো হো হো। হি হি হি। হিক হিক হিক।
হাসতে হাসতে ল্যাংচু গড়িয়ে পড়ল। অদ্ভুত কাণ্ড! ওরা বলে কিক করলে বল নড়ে না। যেন পাথরের বল। বুলেট দলেব ক্যাপ্টেন হচ্ছে মুশতাক। সে একবার বলে কিক কবে উফ করে চেঁচিয়ে উঠল। ড্রিল স্যার বললেন, কী হয়েছে?
স্যার, বল আগুনের মতো গরম। পা পুড়ে গেছে স্যার। পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে।
পাগলের মতো কথা বলিস না তো। বল গরম মানে!
আপনি হাতে নিয়ে দেখুন স্যার। ড্রিল স্যার বল হাতে নিয়ে বললেন, বল যে রকম, সে রকমই তো আছে। কী বলছিস তোরা!
হাফ টাইমের দশ মিনিট আগে আমরা একটা গোল করে ফেললাম। আমরা গোল করলাম বলাটা ঠিক হলো না। বলটা আপনা-আপনি গোলে পড়ল।
ড্রিল স্যার পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে পড়লেন। বাঁশি বাজাবেন। কিনা বুঝতে পাবলেন না।
হাফ টাইমের পর বুলেট ক্লাব আর খেলতে রাজি হলো না। আব্দুল মতিন সাহেব মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। সেবা খেলোয়াড়ের স্বর্ণপদক কাকে দেবেন। বুঝতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত সেই স্বর্ণপদক নান্টুর কপালে জুটল। সে থেমে থাকা বল আটকানোর জন্যে পেয়ে গেল স্বর্ণপদক।