এটা বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন।
খট করে রাখলাম না, যেভাবে রাখতে হয় সেভাবেই রাখলাম। তুই দুনিয়ার মানুষকে আমার টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছিস এটা ঠিক না।
আর দেব না।
যাদেরকে দিয়েছিস তাদের বলে দিবি কখনো যেন এই নাম্বারে তোকে খোঁজ না করে।
আচ্ছা বলে দেব। আপনি দয়া করে রাগে দাঁত কিড়মিড় করবেন না। আপনার ফলস দাঁত খুলে পড়ে যাবে।
শামা হাসছে। মুত্তালিব সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটা খুবই সুন্দর করে আসছে। দেখলেই মায়া লাগে। মুত্তালিব সাহেবের এখন বলতে ইচ্ছে করছে— শামা শোন, তোর বন্ধুদের বলিস টেলিফোন করতে। আমি তাকে ডেকে বে।
শামা বলল, চাচা, ডাক্তার যে আপনাকে বলেছে দেয়াল ধরে হাঁটতে, আপনি কি হাঁটছেন?
না।
আসুন আমার হাত ধরে ধরে হাঁটুন। প্রতিদিন আমি আধঘণ্টা করে আপনাকে হাঁটা প্র্যাকটিস করা।
তার বদলে আমাকে কী করতে হবে?
তার বদলে আপনি আমাকে আধঘণ্টা করে টেলিফোন করতে দেবেন। ঠিক আছে চাচা?
না, ঠিক নেই। আজ বিকেলে তাদের এখানে কে এসেছিল? খাতাউর সাহেব এসেছিলেন। খাতাউরটা কে?
এখনো কেউ না তবে ভবিষ্যতে আমার হাসবেন্ড হয়ে আসরে নামতে পারেন। সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
মুত্তালিব সাহেব হুইল চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। কনে দেখার মতো বড় একটা ব্যাপার ঘটেছে অথচ কেউ তাকে খবর দেয় নি! খবর পাঠালে তিনি কি উপস্থিত হতেন না? হাঁটুতে সমস্যা তাই বলে হাঁটাহাটিতো পুরোপুরি বন্ধ না।
ছেলে কী করে?
বাবার অফিসে চাকরি করে।
দেশ কোথায়?
দেশ হলো বাংলাদেশ।
কোন জেলা, গ্রামের বাড়ি কোথায়?
জানি না। ছেলের নাম কি সত্যি খাতাউর?
জ্বি না। ভাল নাম আতাউর তবে সব মহলে খাতাউর নামে পরিচিত।
শামা আবারো হাসছে। মুত্তালিব সাহেব শামার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে আছেন। হাসি খুশি এই মেয়েটা বিয়ের পর নিশ্চয়ই তার কাছে আসবে না। সহজ ভঙ্গিতে গল্প করবে না।
চাচা!
হুঁ।
আমি কি আজ শেষবারের মতো আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি? আমার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই খবরটা বন্ধুদের দেব।
মুত্তালিব সাহেব শার্টের পকেট থেকে টেলিফোনের চাৰি বের করে দিলেন। তিনি তাঁর টেলিফোন সব সময় তালাবন্ধ করে রাখেন।
শামা সবসময় খুব আয়োজন করে টেলিফোন করে। টেলিফোন সেটের পাশেই ইজি চেয়ার। সে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। টেলিফোন সেটটা রাখে নিজের কোলে। কথা বলার সময় তার চোখ থাকে বন্ধ। চোখ বন্ধ থাকলে যার সঙ্গে কথা বলা হয় তার চেহারা চোখে ভাসে। তখন কথা বলতে ভাল লাগে।
হ্যালো তৃণা?
হুঁ। কী করছিলি? কিছু করছিলাম না। আচার খাচ্ছিলাম।
কীসের আচার?
তেঁতুলের আচার। খাবি?
হুঁ খাব।
শামা হাসছে। তৃণাও হাসছে। শামা তার বিয়ের খবরটা কীভাবে দেবে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। তৃণা বলল, ১৭ তারিখের কথা মনে আছে? মীরার বিয়ে।
হুঁ মনে আছে।
বাসা থেকে পারমিশন করিয়ে রাখবি। আমরা সারা রাত থাকব। খুব হুল্লোড় করব। জিনিয়া বলেছে সে তার বাবার কালেকশন থেকে এক বোতল শ্যাম্পেন নিয়ে আসবে। দরজা বন্ধ করে শ্যাম্পেন খাওয়া হবে।
সারারাত থাকতে দেবে না।
অবশ্যই দেবে। না দেবার কী আছে? তুই তো কচি খুকি না।
আমাদের বাসা অন্যসব বাসার মতো না।
কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না। যেভাবেই হোক পারমিশন আদায় করবি।
আচ্ছা দেখি।
তুই একটু ধরতো শামা, আমার হাতের তেঁতুল শেষ হয়ে গেছে। তেঁতুল নিয়ে আসি। এক মিনিট।
শামা টেলিফোন ধরে বসে রইল, তৃণা ফিরে এল না। তৃণার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলে এ ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। তৃণা কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ বলে, ‘এক মিনিট, ধর। আমি আসছি। আর আসে না। তৃণা কি এটা ইচ্ছা করে করে? যাদের সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না তাদের সঙ্গে এ ধরনের ট্রিকস করে।
আবদুর রহমান সাহেব দশটা বাজতেই ঘুমুতে যান। আজ ঘুমুতে গেলেন সাড়ে এগারোটায়। হিসেবের বাইরের দেড় ঘণ্টা কাটালেন টিভি দেখে। কোনো একটা চ্যানেলে বাংলা ছবি হচ্ছিল। মাঝামাঝি থেকে দেখতে শুরু করেছেন। দেখতে তেমন ভাল লাগছে না, আবার খারাপ লাগছে না। তার ইচ্ছা করছিল স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সঙ্গে নিয়ে ছবি দেখেন। সেটা সম্ভব হলো না। মন্টু বলল, তার পরীক্ষা সে টিভি দেখবে না। এশা বলল, সে বাংলা ছবি দেখে না। শামা বলল, তার মাথা ধরেছে। তিনি একা একাই টিভির সামনে বসে রইলেন। সিনেমার গল্পে মন দেবার চেষ্টা করলেন। বড়লোক নায়ক গাড়ি একসিডেন্ট করে অন্ধ হয়ে গেছে। তার সেবা শুশ্ৰুষা করার জন্যে অসম্ভব রূপবতী এক নার্স বাড়িতে এসেছে। নার্স ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেছে। অথচ ছেলেটির অন্য এক প্রেমিকা আছে। গল্পে নানান ধরনের জটিলতা। এর মধ্যে নায়কের এক বন্ধু আছে, যার প্রধান দায়িত্ব হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করে লোক হাসানো। যেমন সে ফ্রিজের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ ফ্রিজ থেকে পানির বোতল আনতে গেলে সে নিজেই হাত বের করে বোতল তুলে দেয়। আবদুর রহমান নায়কের বন্ধুর অভিনয়ে খুবই মজা পেলেন। যে ক’বার তাকে পর্দায় দেখা গেল সে কবারই তিনি প্রাণ খুলে হাসলেন।
শামা মা’কে বলল, বাবার বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কী রকম বিশ্রী করে হাসছে! মা তুমি বাবার মাথায় পানি ঢেলে বিছানায় শুইয়ে দাও।
সুলতানা হাসলেন। শামা বলল, হাসির কথা না মা। আমার সত্যি ভাল লাগছে না।