সুলতানা বললেন, মেয়েকে এখন আমি মরে গেলেও চুলার কাছে যেতে দেব না। বিয়ের পাকা কথা হবার পর মেয়েদের চুলার কাছে যেতে দেয়া হয় না।
তাই না-কি?
অনেক নিয়মকানুন আছে। চুল খোলা রেখে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। রাতে বিছানায় একা থাকা নিষেধ।
বল কী! জানতাম নাতো।
সুলতানা চা বানানোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। আবদুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, চা কিন্তু দুই কাপ আনবে। চা খেতে খেতে বুড়োবুড়ি গল্প করি। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এখনতো আমরা বুড়োবুড়িই তাই না? আর এশাকে একটু পাঠাও ওর সঙ্গে কথা আছে।
ওর সঙ্গে কী কথা?
আছে, কথা আছে। সব কথা তোমাকে বলা যাবে না-কি? বাপ-মেয়ের আলাদা কথা থাকবে না! শুধু মা-মেয়ে রাত জেগে গুটুর গুটুর, তা হবে না। হা। হ্যাঁ হা।
স্বামীর আনন্দ দেখে সুলতানার মন কেমন কেমন করতে লাগল। অনেকদিন পর মানুষটাকে তিনি এত আনন্দিত দেখলেন। মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় কোনো বাবা কি এত আনন্দিত হয়। তিনি নিজে আনন্দ পাচ্ছেন না। ছেলেটাকে তার তেমন পছন্দ হয় নি। তার ধারণা শামার মতত রূপবতী মেয়ের জন্য অনেক ভাল পাত্র পাওয়া যেত। একটু শুধু খোঁজ খবর করা। মানুষটা আর কিছুই করল না। অফিসের কোনো একজনকে ধরে এনে বলল, এর সাথে বিয়ে।
এশা বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। আবদুর রহমান হাসিমুখে তার কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর আপার বিয়েতো ঠিক হয়ে গেল। নেক্সট টার্গেট তুই। তৈরি হয়ে যা।
এশা গম্ভীর মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার হালকা রূপ দেখে সে অভ্যস্ত না। তার অস্বস্তি লাগছে।
ছেলেটাকে কেমন দেখলি?
ভাল।
শামা কি কিছু বলেছে ছেলে পছন্দ হয়েছে কি-না।
না কিছু বলে নি।
ও আছে কোথায়?
দোতলায়। বাড়িওয়ালা চাচার বাসা থেকে কাকে যেন টেলিফোন করবে।
আবদুর রহমান টেলিফোনের কথায় নড়েচড়ে বসলেন। খুবই আগ্রহের সঙ্গে গলা সামান্য নামিয়ে বললেন, এক কাজ করতে পাঞ্জাবির পকেটে আমার মানিব্যাগ আছে। মানিব্যাগ খুলে দেখ–হলুদ এক পিস কাগজ আছে। কাগজে টেলিফোন নাম্বার লেখা। কাগজটা শামাকে দিয়ে দিস।
কার টেলিফোন নাম্বার? ঐ ছেলের?
হ্যাঁ আতাউরের। সে তার বড়ববানের সঙ্গে এখন আছে। বড়বোনের টেলিফোন নাম্বার। শামা যদি ছেলের সঙ্গে কিছু বলতে চায় বলুক। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে, এখন টেলিফোনে কথাবার্তা বলা দোষনীয় কিছু না। তবে দেখা সাক্ষাৎ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
আর কিছু বলবে বাবা?
আবদুর রহমান সাহেবের মেয়ের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল। মেয়েদের সঙ্গে দিনের পর দিন তার কোনো কথা হয় না। কথা বলার মতো সুযোগই তৈরি হয় না। আজ একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি সুযোগটা ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। সেটা সম্ভব হলো না। এশা তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বোধ করছে না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচে। যেন সে বাবার সঙ্গে কথা বলছে না, কথা বলছে তার স্কুলের রাগী এসিসটেন্ট হেডমাস্টারের সঙ্গে।
আবদুর রহমান সাহেবের মন সামান্য খারাপ হলো, তবে তিনি মন খারাপ ভাবটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। মেয়েরা বড় হলে বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। জগতের অনেক সাধারণ নিয়মের মধ্যে একটা নিয়ম হলো মেয়েরা বড় হলে মা’র দিকে ঝুঁকে পড়ে, ছেলেরা ঝুঁকে বাবার দিকে। তাঁর ক্ষেত্রে এটাও সত্যি হয় নি। মন্টু তার ধারে কাছে আসে না। মন্টু হয়ত টিভি দেখছে, বাবার পায়ের শব্দ শুনলে ফট করে টিভি বন্ধ করে দেবে। চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকবে। বাবা ঘরে ঢুকলে সে উঠে পাশের ঘরে চলে যাবে। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আবদুর রহমান ঠিক করলেন এখন থেকে সম্পৰ্ক সহজ করার চেষ্টা করবেন। মন্টকে সঙ্গে নিয়ে মাঝে মধ্যে টিভি প্রোগ্রাম দেখবেন। ডিশের লাইন না-কি নিয়েছে অনেক কিছু দেখা যায়। তাই বাপ বেটায় মিলে দেখবেন। তিনি এখনো কিছু দেখেন নি। টিভির সামনে বসলেই তার মাথা ধরে যায়। মনে হয় চোখের কোনো সমস্যা। ডাক্তার দেখাতে হবে। ছানি পড়ার বয়স হয়ে গেছে। চোখে ছানি পড়ে গেছে হয়ত।
সুলতানা চা নিয়ে এলেন না। মন্টু এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে দাঁড়াল। সে চায়ের কাপটা বাবার হাতে দেবে না মেঝেতে নামিয়ে রাখবে সেটা বুঝতে পারছে না। বাবার সামনে কোনো টেবিল নেই।
আবদুর রহমান ছেলের হাত থেকে কাপ নিতে নিতে বললেন, তোর মা কোথায়?
রান্না করছেন।
আবদুর রহমান বিরক্ত বোধ করলেন। ছেলেকে দিয়ে চা পাঠানো ঠিক হয় নি। বাবাকে চা নাশতা দেয়া মেয়েদের কাজ। ছেলেকে দিয়ে এইসব কাজ করালে ছেলেদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব চলে আসে। আজকাল একটা কথা খুব পুনতে পাচ্ছেন ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, ছেলেও যা মেয়েও তা। খুবই হাস্যকর কথা বলে তার মনে হয়। ছেলেমেয়ে যদি একই হয় তাহলে ছেলেগুলি মেয়েদের মতো শাড়ি ব্লাউজ পরে না কেন?
মন্টু চলে যাচ্ছিল, আবদুর রহমান বললেন, এই তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে রে?
মন্টু বাবার দিকে তাকাল না। চলে যেতে যেতে বলল, ভাল।
তার একটাই ভয়, বাবা যদি ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করে বসেন! আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালেন। এবারের চা ভাল হয় নি। তিতা তিতা লাগছে। সিগারেট টেনেও মজা পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে। ভ্যাম্প সিগারেট।