শামা খাবারের প্লেট আতাউরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনার কি ঠাণ্ডা লেগেছে? এত কাশছেন কেন?
শামা যা ভেবেছিল তাই হলো। আচকান পরা মওলানা হকচকিয়ে গেলেন। তিনি শামার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন। যক্ষারোগীর কাশি কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেমেছে। শামার বাবাও অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে ঘটনা কী ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।
আচকান পরা মওলানা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, মা শোন, পুরুষ মানুষের কাশিকে তুচ্ছ করতে নাই। পুরুষ মানুষ চেনা যায় কাশি দিয়ে। কথায় আছে–
ঘোড়া চিনি কানে
রাজা চিনি দানে
কন্যা চিনি হাসে
পুরুষ চিনি কাশে।
আতাউরকে চিনতেছি তার কাশিতে আর তোমারে চিনতেছি তোমার হাসিতে। হ্যাঁ হা হা।
শামা লক্ষ করল সবাই হাসতে শুরু করেছে। এমনকি তার বাবাও হাসছেন। যিনি কখনো হাসেন না। কারণ হাসিকে তিনি চারিত্রিক দুর্বলতা মনে করেন। সবাই হাসছে, শুধু যক্ষারোগীর মুখে কোনো হাসি নেই। সে মাথা আরো নিচু করে ফেলেছে।
কালো আচকান পর মওলানা পাত্রের মেজো চাচা। সৈয়দ আওলাদ হোসেন। নেত্রকোনা কোর্টে ওকালতি করেন। তিনিই পাত্রের অভিভাবক। বিয়ের কথাবার্তার সময় পাত্রের অভিভাবকরা ক্ৰমাগত কথা বলেন। সৈয়দ সাহেব তার ব্যতিক্ৰম নন। তিনি দাড়ি কমা ছাড়াই কথা বলে গেলেন এবং বিদায়ের আগে আগে অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। কন্যা আমাদের সবারই অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। শুধু কন্যা পছন্দ হয়েছে বললে ভুল বলা হবে- কন্যার পিতাকেও পছন্দ হয়েছে। বেয়ান সাহেবের সাথে দেখা হয় নাই, তার রান্না পছন্দ হয়েছে। সিঙ্গাড়া অনেক জায়গায় খেয়েছি। এরকম স্বাদের সিঙ্গাড়া খাই নাই। বেয়ান সাহেবকে দূর থেকে জানাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে মোবারকবাদ। এখন বিবাহের তারিখ নিয়ে দুটা কথা। আমি সবচে’ খুশি হতাম আজকে রাতেই বিবাহ দিতে পারলে সেটা সম্ভব না। আমাদের নিজেদের কিছু আয়োজন আছে। আমরাতো শহরের লোক না, গ্রামের লোক। বিয়ে শাদি সবাইকে নিয়ে দিতে হয়। কাজেই বিবাহ হবে ইনশাল্লাহ আষাঢ় মাসে। আবদুর রহমান সাহেব আপনার কিছু বলার থাকলে বলেন। আবদুর রহমান সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আপনারা যা ঠিক করবেন তাই হবে। এই মেয়ে এখন আপনাদের মেয়ে।
আওলাদ হোসেন সবগুলি দাঁত বের করে দিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ–এই যে আপনি বললেন আপনাদের মেয়ে, এতে সব কথা বলা হয়ে গেল। মেয়েতো আমাদের অবশ্যই, আপনাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। হ্যাঁ হা হা।
আওলাদ সাহেব আচকানের পকেট থেকে আংটি বের করে শামার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। শুধু আংটি না, আংটির সঙ্গে খামে ভর্তি টাকাও আছে। এক হাজার এক টাকা।
আওলাদ সাহেব বললেন, এই যে এক হাজার এক টাকা দিলাম এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাস না বললে বুঝবেন না। হয়ত ভাববেন টাকা দিচ্ছে। কেন? ছোটলোক না-কি? এখন ইতিহাসটা বলি। আজ আমাদের খুবই গরিবি হালত। সব সময় এরকম ছিল না। আমার পূর্বপুরুষরা ছিল ঈশ্বরগঞ্জের ন’আনি জমিদার। তাদের নিয়ম ছিল কন্যাকে এক হাজার একটা আশরাফি দিয়ে মুখ দেখা। এই নিয়মতো এখন আর সম্ভব না। তারপরেও পুরনো স্মৃতি ধরে রাখা।
শামা বাবার চোখের ইশারায় তার হবু চাচা শ্বশুরকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে মনে হচ্ছে সে একটা নাটকে পাঠ করছে যে নাটকে তার চরিত্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কোনো সংলাপ নেই। পরিচালক তাকে বুঝিয়েও দেন নি স্টেজে উঠে কী করতে হবে। এক হাজার এক টাকা ভর্তি খামটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে খুবই অস্বস্তি লাগছে। এটা যদি কোনো হাসির নাটক হত তাহলে সে খাম খুলে টাকাগুলি বের করে গুণতে শুরু করত এবং একটা নোট বের করে বলত, এই নোটটা ময়লা, বদলে দিন। কিন্তু এটা কোনো হাসির নাটক না। খুবই সিরিয়াস নাটক। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের একজন। ঈশ্বরগঞ্জের ন’আনি জমিদারের উত্তরপুরুষ সৈয়দ ওয়ালিউর রহমান এখন আবেগে আপুত হয়ে কাঁদছেন এবং রুমালে চোখের পানি মুছছেন। নাটকের আরেক চরিত্র শামার বাবা আবদুর রহমান সাহেবের চোখেও পানি। অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রেরাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মন্টুকে দেখা যাচ্ছে। সে ব্যাপার দেখে পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়েছে। তার হাতে একটা পানির গ্লাস। শামার মনে হল যে কোনো মুহূর্তে সে হাত থেকে পানির গ্লাস ফেলে দেবে। বিয়ের পাকা কথার দিন হাত থেকে পড়ে গ্লাস ভাঙা শুভ না অশুভ কে জানে! শামার হঠাৎ করেই আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করল। তার চেহারাটা কি আগের মতোই আছে না বদলাতে শুরু করেছে? ছেলেদের চেহারা সমগ্র জীবনে খুব একটা পাল্টায় না, কিন্তু মেয়েদের চেহারা পাল্টাতে থাকে। কুমারী অবস্থায় থাকে এক রকম চেহারা, বিয়ের কথাবার্তা ঠিকঠাক হবার সময় হয় অন্য এক রকম চেহারা, বিয়ের পর আরেক রকম চেহারা। মা হবার পর চেহারা আবার পাল্টায়। যখন শাশুড়ি হয় তখন আরেক দফা চেহারা বদল।
আবদুর রহমান সাহেব ভেতরের বারান্দায় রাখা দু’টা বেতের চেয়ারের একটায়। বসে আছেন। অন্যটায় বসেছেন সুলতানা। আবদুর রহমান সাহেবের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সিগারেট খান না। আজ বিশেষ দিন উপলক্ষে মন্টুকে দিয়ে তিনটা সিগারেট আনানো হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সিগারেট টেনে তিনি খুবই মজা পাচ্ছেন। সুলতানা বললেন, চা খাবে? আবদুর রহমান তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চা এক কাপ খাওয়া যায়। তোমার চা বানানোর দরকার নেই। বড় মেয়েকে বল চা বানিয়ে আনুক। বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাজ কর্ম শিখবে না?