বাবা কথা যা বলেন কাজও তাই করেন। জমিদারি ভাবভঙ্গি আমাদের পরিবারে কারোর মধ্যেই ছিল না। শুধু বাবার মধ্যেই ছিল। আরম্ভ হলে আমার হাঁটাহাটি।
শুরুতে ব্যাপারটা যত ভয়ঙ্কর হবে বলে আমার মনে হচ্ছিল দেখা গেল ব্যাপার তেমন ভয়ঙ্কর না। বাবার মতো গম্ভীর ভারিক্কী ধরনের মানুষও সারা পথই আমার সঙ্গে গল্প করেন। যে বাবার ভয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকে দেখা গেল সকালবেলায় বাবা সেই বাবা না। সকালবেলায় বাবা খুবই মজার একজন মানুষ। এক এক দিন তিনি একেক রকম মজা করতে করতে হাঁটেন। আমি মহাউৎসাহে তার আঙুল ধরে থাকি। আমার বড়ই ভাল লাগে।
একদিন ভোরে আকাশ খুব মেঘলা করেছে। বৃষ্টি নামি নামি করছে। বাবা আমাকে নিয়ে বের হবেন। মা বললেন, দিন খারাপ। ঝড় বৃষ্টি হবে। আজ বের না হলে হয় না?
বাবা ধমক দিয়ে বললেন, কী বলেছিলাম ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন কোনো অবস্থাতেই হাঁটা বন্ধ হবে না? | মা বললেন, ছাতা নিয়ে যান।
বাবা বললেন, ছাতা কীসের? বৃষ্টি হলে ভিজতে ভিজতে যাব। এতে শরীর পোক্ত হবে। সামান্য ঠাণ্ডা বাতাস লাগলেই, সর্দি জ্বর এইসব হবে না।
আমি বাবার হাত ধরে রওনা হলাম। সান্ধিকোনা পুলের বটগাছের কাছে যাওয়ার আগেই তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। বাবা বললেন, বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগছেরে ব্যাটা?
আমি বললাম, ভাল।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, এক কাজ কর, শার্ট প্যান্ট খুলে নাংগু বাবা হয়ে যা। আশেপাশে দেখার কেউ নেই। সারা শরীরে বৃষ্টির পানি লাগলে জীবনে কোনো দিন ঘামাচি হবে না।
আমি বললাম, লজ্জা লাগে।
বাবা বললেন, দূর ব্যাটা! কে দেখবে? দেখবে শুধু আল্লাহপাক। আল্লাহপাকের কাছে কীসের লজ্জা?
আমি শার্ট খুলে ফেলেছি। প্যান্ট খুলতে যাব হঠাৎ দেখি বাবা যেন কেমন করছেন। যে হাতে তিনি আমাকে ধরে ছিলেন, সেই হাত কাঁপছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, বাবারে মহাবিপদ। আজ আমার মহাবিপদ!
আমি দেখলাম বটগাছের পেছন থেকে পাঁচ দু’জন মানুষ বের হয়ে এল। খুবই সাধারণ গ্রামের চাষাভুষা মানুষ। তারা আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে শুরু করল।
পরের ঘটনাগুলি ঘটল অতি দ্রুত। আমি দেখলাম এরা বাবাকে কাদার ভেতর ফেলে দিয়েছে। একজন গরু জবাই করার মস্ত বড় ছুরি বের করেছে। বাবা গোঙাতে গোঙাতে বলছেন, তোমরা আমার একটা কথা রাখ। এই দৃশ্য যেন আমার ছেলেটা না দেখে। তাকে সরায়ে নিয়ে যাও। আমাকে দয়া করার দরকার নেই, আমার ছেলেকে দয়া কর।
এই দয়া তারা করল না। বাবার কাছ থেকে চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি দেখলাম। লোকগুলি যেমন দ্রুত এসেছিল সে রকম দ্রুতই চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমার জবাই করা বাবার পাশে। কী বৃষ্টি! বাবার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। আর সেই পানি দেখতে দেখতে টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বাবার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলাম না। আমি তাকিয়েই রইলাম।
সেই থেকে আমার অসুখের শুরু।
দুই তিন বছর পর পর বর্ষার সময় অসুখটা হয়। যখন খুব বৃষ্টি হতে থাকে। তখন বৃষ্টির দিকে তাকালে হঠাৎ মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয় আমি একটা ভোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। আমার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলি অদ্ভুত উপায়ে লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে।
আমাকে সুস্থ করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। বড় বড় ডাক্তাররা আমাকে দেখেছেন। আমাকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে দেখেছেন। কোনো লাভ হয় নি। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন কখনো বৃষ্টি না দেখি। আকাশে মেঘ করলেই আমি যেন ঘরে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। সে চেষ্টাই এখন করি।
এই হলে আমার গল্প। খুবই ভয়ঙ্কর গল্প, আমি চেষ্টা করেছি সহজভাবে বলতে। তা কি আর সম্ভব? এমন ভয়ঙ্কর গল্প কি আর সহজ করা সম্ভব?
শামা এখন বলি আমি আমার অসুখের কথাটা কেন। গোপন করলাম। কেন জানি এক সময় আমার মনে হলো প্রবল বৃষ্টির সময় কেউ যদি গভীর মমতায় আমার হাত ধরে থাকে এবং আমার কানে কানে বলে কোনো ভয় নেই। আমি তোমার পাশে আছি। আমি তোমার হাত ধরে আছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়ব না। তাহলে হয়ত। আমার অসুখটা হবে না। এক সময় বৃষ্টিটা আমার কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে। কে জানে একদিন হয়ত সেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেও পারব।
আমার এ ধরনের চিন্তার পেছনে কোনো যুক্তি ছিল না, ছিল বিশ্বাস। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো চেপে ধরে আমিও তাই করতে চেয়েছি।
আমি খুবই ভুল করেছি। আমিতো আর তোমাদের মতো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ না। ভুলতত আমি করবই।
শেষবার এশার সঙ্গে যখন কথা হয়েছে সে আমাকে বলেছে অন্য এক জায়গায় তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে। তোমার খুব ভাল বিয়ে হোক এটা আমি মনেপ্রাণেই কামনা করছি। তোমার সঙ্গে আমার অতি সামান্য পরিচয় যেন কোনো অবস্থায়ই তোমার মনে কোনো ছাপ না ফেলে এই প্রার্থনা করছি।
আরেকটা কথা— মাঝে মধ্যে এশা টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। এই নিয়ে তুমি তার ওপর রাগ করো না।
এই চিঠিটা এশাকে দেখিও। শেষবার টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বুঝেছি সে আমার গোপন করার ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পেয়েছে।
এই চিঠিটা পড়লে তার কষ্ট সামান্য কমতেও পারে।