আবদুর রহমান সাহেব মুখে বললেন শুধু শুধু চিন্তিত হব কেন? আসলে তিনি খুবই চিন্তিত বোধ করছেন। এত বড় ঘরে তার মতো সাধারণ মানুষের সম্পর্ক করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছেন না। তার চেয়েও অনেক বেশি চিন্তিত সুলতানা। সুলতানার চিন্তার প্রধান কারণ আজ সন্ধ্যার আগে যদি ছেলের বাবা মারা যায় তাহলে তো আজ বিয়ে হবে না। এবং অবশ্যই পাত্র পক্ষ পিছিয়ে পড়বে। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ বলবে, মেয়ে অলক্ষণা। বিয়ের কথা হলো অমি ছেলের বাবা গেল মরে। শ্বশুর-খাকি কন্যা!
সুলতানা আজ সকাল থেকে যে শুধু লক্ষণ বিচার করছেন, এই কারণেই করছেন। শুধু কাকের ব্যাপারটা ছাড়া লক্ষণ বিচারের ফলাফল শুভ। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘে মেঘে কালো। আকাশের ভাব দেখে মনে হয় যে-কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। বিয়ের দিন বৃষ্টি শুভ।
বিয়ের দিন এশাকে দিয়ে পায়েস রান্না বসিয়েছেন। এর মধ্যেও সুলতানার একটা গোপন পরীক্ষা আছে। বিয়ের দিন কনের বাড়িতে রান্না করা পায়েস যদি ধরে যায়, কিংবা পুড়ে যায়, কিংবা পাতিল উল্টে পায়েস মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে বিরাট অলক্ষণ। এশার রান্না করা পায়েস খুব ভাল হয়েছে। এটা একটা ভরসার কথা। সুলতানা এক বাটি পায়েস এনে শামার ঘরে ঢুকলেন। শামা খুব মনোযোগ দিয়ে পায়ের নখ কাটছিল। সে নেইল কাটার থেকে চোখ না তুলেই বলল, পায়েস খাব না মা, দেখেই ঘেন্না লাগছে।
পায়েস দেখে ঘেন্না লাগার কী আছে?
ঈদের দিন ছাড়া অন্য যে-কোনো দিন পায়েস দেখলে আমার ঘেন্না লাগে।
একটু চেখে দেখ।
চেখেও দেখব না। আজ আমার বিয়ের দিন। অন্তত আজকের দিনে আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে কিছু করাবে না।
তোর বান্ধবীরাতো এখনো কেউ এল না?
সবাই আসবে। এখন তো মাত্র সকাল দশটা বাজে। এত টেনশন করছ কেন মা? শান্ত হয়ে একটু আমার পাশে বসতো।
সুলতানা বসলেন। শামা নখ কাটা বন্ধ রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা তুমি আমাকে একটা পরামর্শ দাওভতা।
কী পরামর্শ?
খাতাউর সাহেব বিষয়ক একটা পরামর্শ।
সুলতানা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ওর কথা আসছে কেন?
শামা বলল, ওর কথা আসছে কারণ ওরা আমাকে এক হাজার এক টাকা এবং একটা আংটি দিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে আজই এইসব ওদের ফেরত দেয়া উচিত। আমি বাড়িওয়ালা চাচাকে বলে রেখেছি উনি তার গাড়িটা আমাকে তিন ঘণ্টার জন্যে দিয়েছেন। আমি মন্টুকে নিয়ে বের হব। দু’একটা টুকটাক শপিং করব। তারপর খাতাউর সাহেবের বোনের বাসায় গিয়ে তার বোনের হাতে জিনিসগুলি দিয়ে আসব। তোমার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোনো কারণ নেই। খাতাউর সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হবে না কারণ উনি খুবই অসুস্থ। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে তাঁকে বেশ কিছুদিন হলো তালাবন্ধ করে রাখা হচ্ছে।
তুই এত খবর কোথায় পেলি?
মাঝে মাঝে আমি ঐ বাসায় টেলিফোন করি।
কেন?
মানুষটার অসুখটা কমল কিনা এটা জানার জন্যে টেলিফোন করি। এই মানুষটাতে আমার স্বামীও হয়ে যেতে পারত। পারত না? এখন আমাকে অনুমতি দাও, আমি আংটি ফেরত দিয়ে আসি।
সুলতানা চিন্তিত গলায় বললেন, তোকে যেতে হবে কেন? আংটি ফেরত দিতে হলে তোর বাবা গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবে।
শামা শান্ত স্বরে বলল, আংটিতো তারা বাবাকে দেয় নি। আমাকে দিয়েছে। কাজেই আংটি আমাকেই ফেরত দিতে হবে।
সুলতানা বললেন, তুই আমার পরামর্শ চেয়েছিলি। আমার পরামর্শ হলো তুই যাবি না।
শামা বিছানা থেকে নামল। বুক শেলফ থেকে একটা বই বের করল। বইয়ের মাঝখানে রাখা একটা চিঠি বের করে মা’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি চিঠিটা পড়। তারপর আমাকে বল আমার যাওয়া উচিত হবে, কি হবে না।
কার চিঠি?
খাতাউর সাহেবের চিঠি।
সে আবার কবে চিঠি লিখল?
তিনি অসুস্থ হবার আগে চিঠিটা লিখেছেন।
সুলতানা নিচু গলায় বললেন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। সে চিঠি লিখবে কেন? তুই কি এই চিঠির জবাব দিয়েছিস নাকি?
শামা বলল, এত কথা বলছ কেন মা। চিঠিটা তুমি আগে পড়তো। সুলতানা চিঠি পড়ছেন। চিঠি পড়তে গিয়ে তার হাত কাঁপছে।
শামা,
তোমার কাছে এই চিঠি লিখতে খুব অস্বস্তি লাগছে, খানিকটা লজ্জাও লাগছে। একবার ভাবলাম এই চিঠি লেখাটাতো তেমন জরুরি না। না লিখলেও চলে। কিন্তু পরে মনে হললা চিঠিটা না লিখলে নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকব। অন্তত এইটুকু আমার ব্যাখ্যা করা উচিত কেন আমি অসুখের ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখলাম। আমার ব্যাখ্যাটা যে তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা আমার মনে হচ্ছে না। আমার নিজের কাছেই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না। তাহলে ব্যাখ্যাটা দিচ্ছি কেন? মানুষের স্বভাব হচ্ছে খুব বড় ধরনের ভুল করলেও কেন ভুল করল তার একটা ব্যাখ্যা সে দাঁড় করায়। যতটা না অন্যের জন্যে তারচে’ বেশি নিজের জন্যে। মূল কথা না বলে অন্য গীত গাইছি— তোমা তোমার নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত লাগছে। একটু ধৈর্য ধর, এক্ষুণি আমার সব কথা বলা হয়ে যাবে। আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলব। গল্পটা শেষ হওয়া মানে আমার সব কথা শেষ হওয়া।
আমার তখন সাত বছর বয়স। ক্লাস টুতে পড়ি। জন্ম থেকেই অসুখ বিসুখ আমার লেগেই আছে। দু’দিন পর পর জ্বরে পড়ি। ঠাণ্ডা লাগলেই সর্দি-কাশি। বাবা আমার অসুখ নিয়ে খুবই বিরক্ত। একদিন আমার মা’কে বললেন। শুধুমাত্র তোমার পুত্রের চিকিৎসার জন্যে বাড়িতে একজন ডাক্তারকে জায়গির রাখা দরকার। ডাক্তার ঘরেই থাকবে, খাবে আর বার মাস আমার ছেলের চিকিৎসা করবে। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওর চিকিৎসা আমি করব। প্রতিদিন আমার সঙ্গে সে এক মাইল হাঁটবে। ফজরের নামাজের পর একে তুমি কানে ধরে বিছানা থেকে তুলবে। আমি রোজ একে নিয়ে সান্ধিকোনা পুলের কাছের বটগাছ পর্যন্ত যাব। আবার ফিরে আসব। এই চিকিৎসার নাম হাঁটা চিকিৎসা। এই চিকিৎসা এক মাস করলে তোমার ছেলের আর কোনো চিকিৎসা লাগবে না। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন, টাইফুন কোনো অবস্থাতেই এই হাঁটা চিকিৎসা বন্ধ হবে না।