এশ এসে মাকে সাহায্য করার জন্যে বসল। এশার মুখ আগের চেয়েও গম্ভীর। চোখ ফোলা ফোলা। মনে হয় কেঁদেটেদে এসেছে। এশার কী হয়েছে কে জানে! এমন চাপা মেয়ে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলেও সে মুখ খুলবে না।
সুলতানা বললেন, কী সমস্যা হয়েছে দেখ না। সিঙ্গাড়ার কোণা উঠছে না।
এশা বলল, খেতে ভালই হল। কোণা ওঠার দরকার নেই। দোকানের সিঙ্গাড়ায় লোকজন কোণা খোজে। ঘরের সিঙ্গাড়ায় খোঁজে না।
সুলতানা বললেন, একটা খেয়ে দেখ।
খেতে ইচ্ছা করছে না।
তোর কি কোনো কারণে মন টন খারাপ?
না। এক কথা পাঁচ লক্ষবার জিজ্ঞেস করো না তো মা। আমার মন খারাপ কি-না এটা তুমি এই ক’দিনে পাঁচ লক্ষবারের বেশি জিজ্ঞেস করে ফেলে।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, শামা কী করছে?
খাটে বসে আছে।
সাজার পর তাকে কেমন দেখাচ্ছেরে?
পরীদের রাণীর মতো লাগছে।
সুলতানা তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, শামাকে যে-ই দেখবে সে-ই পছন্দ করবে। মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকালে বুকে ধাক্কার মতো লাগে। ভেবেই পাই না এত সুন্দর মেয়ে আমার পেটে জন্মাল কীভাবে!
এশ বলল, আপা বেশি সুন্দর। বেশি সুন্দরকে আবার মানুষ পছন্দ করে না।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, পছন্দ করবে না কেন?
এশা উত্তর দিল না। সুলতানা বললেন, পছন্দ করবে না কেন বল? কারণ জানিস না?
কারণ জানি কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। মা শোন, তুমি আর বাবা, তোমরা দু’জন কি আসলেই চাও যে ছেলেটা এসেছে তার সঙ্গে আপার বিয়ে হোক?
তোর বাবা চায়, তার ধারণা ছেলেটা খুবই ভাল। অসম্ভব ভদ্র, বিনয়ী। ফ্যামিলিও ভাল। ছেলের অবশ্যি বাবা নেই। কিছুদিন হলো মারা গেছেন। শামা শ্বশুরের আদর পাবে না। তোরাতে জানিস না শ্বশুরের আদর বাপের আদরের চেয়েও বেশি হয়।
আপা যেভাবে সাজগোজ করেছে এভাবে সাজগোজ করে থাকলে কিন্তু ওরা আপাকে পছন্দ করবে না। আপার উচিত খুব সাধারণ একটা শাড়ি পরে ওদের সামনে যাওয়া। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক এইসব কিছু না।
কী বলছিস তুই!
কোনোরকম সাজগোজ ছাড়া আপা যখন ওদের সামনে দাঁড়াবে তারা বলবে, বাহু কী সহজ সরল সাধারণ একটা মেয়ে! বউ হিসেবে সবাই সাধারণ মেয়ে। খোজে। আপার ঠোটে লিপস্টিক, গালে পাউডার কোনো কিছুরই দরকার নেই। গোসল করে আপা যখন ভেজা চুলে বের হলো তখন তাকে যে কী সুন্দর লাগছিল। লক্ষ কর নি?
সুলতানা অবাক হয়েই মেয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে এই যেন সেদিন মেয়েটা ছোট্ট ছিল। সারারাত ওঁয়া ওঁয়া করে কাদত। মুখে দুধ গুজে দিলেও কান্না থামত না। দুধ খাচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে কাঁদছে। কান্নাটা যেন তার বিশ্রাম। আর আজ এই মেয়ে গুটগুট করে কী সুন্দর কথা বলছে! কথাগুলি মনে হচ্ছে সত্যি।
এশা বলল, মা আলাকে সাধারণ ঘরে পরার একটা শাড়ি পরতে বলব?
বল। তার বাবা আবার রাগ না করে। শখ করে একটা শাড়ি কিনে এনেছে।
বাবা কিছু বুঝতে পারবে না। বাবা খুব টেনশনে আছে তো। টেনশনের সময় মানুষ কিছু বুঝতে পারে না। বাবা ভালমতো আপার দিকে তাকাবেই না। মেয়েরা যখন বড় হয়ে যায় তখন বাবারা মেয়েদের দিকে কখনো ভালমতো তাকায় না। বাবাদের মনে হয় তাকাতে লজ্জা করে।
সুলতানা ছোটমেয়ের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই মেয়েটার ভাল বুদ্ধি আছে। মেয়েটার বুদ্ধির খবর এই পরিবারে আর কেউ জানে না। শুধু তিনি জানেন। এই নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও আছে। মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না। বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনো সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী।
শামা খুব সহজ ভঙ্গিতেই চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। সে ধরেই নিয়েছিল ঘরে ঢোকা মাত্র সবাই এক সঙ্গে তার দিকে তাকাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার হাত পা শক্ত হয়ে যাবে। দেখা গেল সবাই তার দিকে তাকাল না। আতাউর নামের ছেলেটা মাথা নিচু করেই বসেছিল, সে মাথাটা আরো খানিকটা নিচু করে ফেলল। শামা তার দিকে এক ঝলক তাকাল। এক ঝলকে তার অনেকখানি দেখা হয়েছে।
ছেলেটা ছায়ার কচুগাছের মতো ফর্সা। হাতের নীল নীল শিরা বের হয়ে আছে। অতিরিক্ত রোগা। ঘুমের সমস্যা মনে হয় আছে। চোখের নিচে কালি। বাম চোখের নিচে বেশি কালি। ডান চোখে কম। মাথায় অনেক চুল আছে। চেহারা ভাল। গোফ নেই— এটাও ভাল। পুরুষ মানুষের নাকের নিচে গোঁফ। দেখলেই শামার গা শিরশির করে। মনে হয় ঘাপটি মেরে মাকড়সা বসে আছে। তাড়া দিলেই নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে যাবে।
কালো আচকান পরা মুখভর্তি দাড়ি এক ভদ্ৰলোক শামার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে মা, আমাদের জন্যে চা নিয়ে চলে এসেছ। কেমন আছ গো মা?
শামা বলল, জি, আমি ভাল আছি।
বোস মা, তুমি আমার পাশে বোস। এমন সুন্দর কন্যা পাশে নিয়ে বসাও এক ভাগ্যের ব্যাপার।
আচকান পরা ভদ্ৰলোক সরে গিয়ে শামার জন্যে জায়গা করলেন। শামা সহজ গলায় বলল, আমি খাবারটা হাতে হাতে দিয়ে নি। তারপর বসি।
ঠিক আছে মা। ঠিক আছে। আগে কাজ তারপর বসা, তারপর আলাপ। আর এই জগতে খাওয়ার চেয়ে বড় কাজতো কিছু নেই। কী বলেন আপনারা?
কেউ কিছু বলল না। শুধু আতাউর নামের ছেলেটা কাশতে লাগল। শামা মনে মনে বলল, এই যে খাতাউর ভাইয়া, আপনার এই কাশি ঠাণ্ডার কাশি, না যক্ষাটা আছে?
প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে শামা ভাবল খাবারের প্লেট সবার আগে যিনি মুরুঝি তার হাতে দেয়া দরকার। তা না করে সে যদি যক্ষারোগী খাতাউরের হাতে দেয় তাহলে কেমন হয়? যক্ষারোগী নিশ্চয়ই ভাবছে না তাকে প্রথম দেয়া হবে। তার কাশি আরো বেড়ে যাবে। আচকান পরা মওলানা বেশি ফটফট করছে। মওলানার ফটফটানি কিছুক্ষণের জন্য হলেও কমবে। মওলানা হয়ত মনে মনে বলবে নাউজুবিল্লাহ, মেয়েটাতো মহানিৰ্লজ্জ। বলুক যার যা ইচ্ছা।