শামা তাকিয়ে আছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ভদ্রলোেক শামার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বান্ধবীর কথায় সামান্য ভুল আছে। ভুলটা আমি ঠিক করে দেই। আমার বাবা প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টে আছেন। এই অবস্থায় একজন মানুষ নিজের কষ্ট ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারে না। কাজেই তিনি তাঁর পুত্রবধূর মুখ দেখে মরতে চাচ্ছেন এটা খুবই ভুল কথা। তবে আমার আত্মীয়স্বজনরা এ ধরনের কথা বলছেন এটা ঠিক। আমার ধারণা ঢাকা শহরের সব রূপবতী মেয়েদের প্রাথমিক ইন্টারভ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়ে গেছে।
তুণা বলল, একজন শুধু বাকি আছে। শামা বাকি আছে। শামার ইন্টারভ্য আপনি নিয়ে নিন। তবে আপনার ইন্টারভ্যুর আগে শামা আপনার বুদ্ধি পরীক্ষা করবে। বুদ্ধি পরীক্ষায় আপনি যদি ফেল করেন তাহলে তার ইন্টারভ্য নিয়ে কোননা লাভ নেই। শামা আপনার দিকে ফিরেও তাকাবে না।
ভদ্রলোক আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বুদ্ধি পরীক্ষাটা কী রকম?
তৃণা বলল, মাকড়সা নিয়ে একটা ধাধা। বেশ কঠিন পরীক্ষা। প্রায় নব্লুই পারসেন্ট লোক এই পরীক্ষায় ফেল করে। কাজেই সাবধান!
শামা বলল, তৃণা আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। ধাধা জিজ্ঞেস করে কি আর মানুষের বুদ্ধি পরীক্ষা করা যায়?
ভদ্রলোক বললেন, তবু শুনি। আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।
তৃণা বলল, শামা লজ্জা পাচ্ছে। সে বলবে না। তার হয়ে আমি প্রশ্নটা করছি। মনে রাখবেন এর উত্তর না দিতে পারলে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শামা আপনাকে বাতিল করে দেবে। মুখে অবশ্যি কিছু বলবে না। কাজেই সাবধান।
ভদ্রলোক তীব্র দৃষ্টিতে তৃণার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে তিনি চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছেন। উত্তেজনায় তাঁর ফর্সা মুখে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।
শামার কাছে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে ভদ্রলোকের ভেতর যে ছেলেমানুষি দেখা গিয়েছিল, সেই ছেলেমানুষিটা আবার ফিরে এসেছে। তৃণা মাকড়সার ব্যাপারটা বলছে। ভদ্রলোক চোখের পাতা না ফেলে শুনছেন। মনে হচ্ছে সত্যি
সত্যি তিনি ভয়ঙ্কর কোনো পরীক্ষা দিতে বসেছেন।
শামার হঠাৎ করেই মনে হলো এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে হলেও তার মেয়ের নাম রাখা যাবে আশা। আশফাকুর রহমানের আ, শামার শা। আশা।
চিঠি
বারান্দার কাঠের চেয়ারের হাতলে একটা কাক বসে আছে।
সুলতানার বুক ধ্বক করে উঠল। এটা কি কোনো অলক্ষণ? কা কী করে। কাক ডাকাটা অলক্ষণ। কিন্তু একটা কাক ঝিম ধরে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ারে বসে থাকলে তার মানে কী হয়? কাক চুপ করে বসে থাকার পাখি না। সে খাবারের খোঁজে ছটফট করবে। ঘাড় বাঁকিয়ে গৃহস্থকে দেখবে। এই কাজটা সে করছে না। ঝিম ধরে বসে আছে। সুলতানা রান্নাঘরে ঢুকলেন। এশাকে কাক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি জানেন, এশা লক্ষণ-অলক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানে না। আধুনিককালের মেয়েদের লক্ষণ বিচারের সময় নেই। তবু মনের শান্তির জন্যে জিজ্ঞেস করা।
সুলতানা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, এশা একটা কাক তোর বাবার চেয়ারের হাতলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।
এশা পায়েস ব্রাধছিল। পায়েস রান্নার প্রধান কৌশল ক্ৰমাগত হাঁড়ির দুধ নাড়াচাড়া করা। একটু থামলেই দুধ ধরে যাবে। পায়েসে দুধ পোড়া গন্ধ এসে যাবে। সে চামচ নাড়তে নাড়তেই বলল, কাক বসে আছে তো কী হয়েছে?
কোনো অলক্ষণ না তো? এশা হেসে ফেলল। সুলতানা বললেন, কাকটাকে দেখে ভাল লাগছে না।
কাক দেখে ভাল লাগার কোনো কারণ নেই মা। কাকতো ময়ূর না যে দেখে ভাল লাগবে। আজ সকাল থেকে তুমি লক্ষণ বিচার শুরু করেছ। দয়া করে মনটা শান্ত কর। পায়েসের মিষ্টি একটু চেখে দেখ।
সুলতানা মিষ্টি চাখলেন। মিষ্টি বেশি হয়েছে না কম হয়েছে কিছুই বললেন না। তিনি খুবই অস্থির বোধ করছেন। তাঁর অস্থির বোধ করার সঙ্গত কারণ আছে। শামার আজ রাতেই বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তৃণার উদ্যোগে আনা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে সম্পর্কিত সব কথাবার্তা শেষ হয়েছে। পাত্রের নানিকে চিটাগাং থেকে আনা হয়েছে। তিনি সন্ধ্যার পর লোকজন নিয়ে শামাকে দেখতে আসবেন। তিনি যদি বলেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেবিয়ে পড়ানো হবে।
আবদুর রহমান সাহেবকে কাজি এনে রাখার কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিকট আত্মীয়স্বজনকেও খবর দিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। আবদুর রহমান সাহেব বলেছেন, আমি সব খবর দিয়ে রাখলাম। কাজি নিয়ে আসলাম আর ছেলের নানি বললেন, মেয়ে পছন্দ হয় নি তখন?
এতে পাত্রের মামা (ব্যারিস্টার। ইমরুল হক। হাইকোর্টে প্রাকটিশ করেন।) খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, ছেলের নানি এ ধরনের কথা বলবেন না। আমরা সব ঠিকঠাক করে তবেই উনাকে আনিয়েছি। উনি আমাদের সবার। মুরুঝি। এই জন্যেই উনাকে সামনে রাখা, আপনি কি আমাদের কথায় ভরসা। পাচ্ছেন না?
আবদুর রহমান সাহেব ব্ৰিত গলায় বললেন, কেন ভরসা পাব না? অবশ্যই ভরসা পাচ্ছি। ভরসা না পাবারতো কিছু নেই।
সমস্যা থাকলে বলুন কাজি আমরা নিয়ে আসব। আপনাদের কিছু করতে হবে না।
না না কোনো সমস্যা নেই।
আমরা তাড়াহুড়া করছি কারণ ছেলের বাবা অসুস্থ। বারডেমে আছেন। যে-কোনো মুহূর্তে এক্সপায়ার করতে পারেন। উনি যেন ছেলের বউ দেখে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা। বুঝতে পারছেন?
জি পারছি।
আপনাকে দেখে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। আপনি কি চিন্তিত?
জি না, চিন্তিত না। শুধু শুধু চিন্তিত হব কেন?