তিনি পিঠে ক্রস দেয়া একজন মানুষ। তাঁর মৃত্যুর পর কেউ কাঁদবে না এই বিষয়টি তাঁকে খুব কষ্ট দিত। আজ তিনি জানেন কেউ কাঁদবে না এটা ঠিক না। একটা মেয়ে কাঁদবে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। মুত্তালিব সাহেবের চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল।
তৃণা খলবল করে বলল, শামা তুই আমাকে চাইনিজ খাওয়াবি কি-না বল।
চাইনিজ খাওয়াবার মতো কিছু ঘটেছে?
হ্যাঁ ঘটেছে। কবে চাইনিজ খাওয়াবি?
কথায় কথায় চাইনিজ খাওয়াবার মতো অবস্থা কি আমার আছে?
টাকা ধার কর। চাচার কাছে থেকে ধার নে। শোন তোর জন্যে কী করেছি। আমার ট্রিকস একশ ভাগ কাজ করেছে। মিঃ হুক্কা এন্ড হিজ ফ্যামিলিকে পুরোপুরি কজা করে ফেলেছি। ঐ দিন যদি তোর ব্যাগে মিঃ হুক্কার চশমা না রাখতাম তাহলে এটা পারতাম না। হুক্কা ফ্যামিলি গোপনে তোদর সব খবরাখবর নিয়েছে। হুক্কার মাতা একদিন কলেজে গিয়ে তোকে দেখেও এসেছে। তোর কি মনে পড়েছে হাবাগোবা টাইপের এক মহিলা একদিন কলেজে এলেন? আমি তাকে দেখে ‘আরে চাচিআম্মা আপনি’ বলে খুব আহ্লাদি করলাম। উনি হচ্ছেন হুক্কা-মাতা। এখন ওরা আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তোদর বাড়িতে ফরম্যাল প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। বুঝলি কিছু?
বুঝলাম।
হুকার পিতা খুবই অসুস্থ। এখন মরেন তখন মরেন অবস্থা। কাজেই ব্যবস্থা এমন থাকবে যে প্রস্তাব দেবার পর প্রস্তাব গ্রাহ্য হলে সঙ্গে সঙ্গে কাজি আনতে লোক যাবে। বিয়ে হয়ে যাবে। মিস্টার হুক্কা তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বারডেমের। হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী পিতার শয্যার পাশে উপস্থিত হবেন। ঘটনা কেমন ঘটিয়েছি বল দেখি?
ভাল।
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কে যাচ্ছেন জানিস? বাংলাদেশের দু’জন অতি বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁদের পরিচয় আগে দিলাম না। এই অংশটা সারপ্রাইজ হিসেবে থাকুক। শামা তুই খুশিতো?
বুঝতে পারছি না।
যখন নিজেদের সুইমিংপুলে মনের সুখে সাঁতার কাটবি তখন বুঝবি। শামা আমি এখন রাখি। কাল তোদর বাসায় এসে সব বলব। চাচা চাচির সঙ্গেও কথা বলব।
আচ্ছা।
আসল কথাইতো বলতে ভুলে গেছি রে। এতক্ষণ শুধু নকল কথা বললাম। আসল কথা হলো— আগামীকাল দুপুরে তুই আমার সঙ্গে চাইনিজ খাবি।
ঐ ভদ্রলোক থাকবেন?
হ্যাঁ থাকবেন। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তাকে একটু বাজিয়ে নিবি না? সামান্য লাউ কেনার সময়ও তো মানুষ লাউ-এ চিমটি দিয়ে দেখে, টোকা দিয়ে দেখে। তুই টোকা দিবি না?
আচ্ছা।
এরকম শুকনো গলায় কথা বলছিস কেন? তোর উচিত আনন্দে লাফানো। আমি তোর জন্যে কী করলাম এটা তুই এখন বুঝতে পারবি না— দশ বছর পর বুঝবি। মনে থাকে যেন আগামীকাল দুপুর। তোর কোনো শাদা শাড়ি আছে? শাদা শিফন?
না।
আচ্ছা শাদা শাড়ি আমি নিয়ে আসব। মেয়েদের সবচে’ মানায় ধবধবে শাদা শাড়িতে। আমাদের দেশের মেয়েরা শাদা শাড়ি পরে না কারণ শাদা বিধবাদের রঙ। তুই পরবি ধবধবে শাদা রঙ, গলায় থাকবে মুক্তার মালা। ঠোটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক দিবি। শাদার ভেতর থেকে লাল রঙ লাফ দিয়ে বের হবে। তোর কি মুক্তার মালা আছে?
না।
অসুবিধা নেই আমি জোগাড় করব।
শামা টেলিফোন নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আতাউরের নাম্বারে ডায়াল ঘুরাল। একজন মহিলা ধরলেন। নরম গলায় বললেন, তুমি কে?
শামা বলল, আমার নাম এশা। আমি আতাউর ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
ও অসুস্থ। ওকেতে দেয়া যাবে না।
কী হয়েছে?
ও অসুস্থ।
এই বলেই মহিলা টেলিফোন রেখে দিলেন। শামা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে মনে হচ্ছে বাড়িটা কাঁপছে। সে এক্ষুণি পড়ে যাবে।
আশফাকুর রহমান নীল ব্লেজার পরেছেন। এই গরমে কেউ ব্লেজার পরে না, তিনি পরেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে ব্লেজার ছাড়া অন্য কিছু পরলে তাঁকে মানাতো না। শামার কাছে মনে হলো বিয়ে বাড়িতে জ্বলোককে একরকম দেখাচ্ছিল, আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে তাঁর মধ্যে ছেলেমানুষি ভাব ছিল। আজ নেই।
আশফাকুর রহমান তৃণার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি না বললে তোমরা ছ’জন বান্ধবী এক সঙ্গে থাকবে?
তৃণা বলল, ছ’জন না, সাতজন। মীরার বিয়েতে আমাদের একজন যেতে পারে নি। সেও আজ থাকবে। তবে তারা সবাই আসবে এক ঘণ্টা পর। শুরুতে থাকব আমরা তিনজন।
ও আচ্ছা।
আপনি শামার কাছে ক্ষমা চাইবেন বলেছিলেন। চেয়েছিলেন?
না। উনার সঙ্গে পরে আর দেখা হয় নি।
এইতো দেখা হলো, ক্ষমাটা চেয়ে নিন। ক্ষমা প্রার্থনা দৃশ্য দিয়ে আজকের টোকাটুকি খেলা শুরু হোক।
টোকাটুকি খেলা মানে?
টোকাটুকি খেলা আপনি বুঝবেন না। আমরা বান্ধবীরা অনেক সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করি। কই ক্ষমা প্রার্থনা শুরু করুন।
শামাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। মঞ্চে বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করলেন। ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে তৃণা মজা করছিল,
দ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মজা করছেন না।
বিয়ে বাড়ির ঐ রাতের ঘটনার জন্যে আমি খুবই লজ্জিত। আপনাকে অপ্ৰস্তুত করার জন্যে আপনার বান্ধবীরা যে এই কাণ্ডটা করবে তা আমার মাথাতেও আসে নি। আমি যে কী পরিমাণ লজ্জা পেয়েছি তা শুধু আমি জানি।
শামা বলল, লজ্জা পাওয়ার মতো এমন কিছু আপনি করেন নি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন না, বসুন।
ভদ্রলোক বসলেন। তুণা বলল, শামা এখন তোকে খুব জরুরি একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শোন— আশফাকুর রহমান সাহেবের বাবা খুব অসুস্থ। বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হচ্ছে। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলের একটা গতি হয়েছে এটা দেখে যেতে চান। কাজেই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে উনার জন্যে চমত্তার একটা মেয়ে খুঁজে বের করা। তোর জানা মতে কেউ আছে?