আমাকে সুন্দর লাগছে কি-না সেটা বল?
তোকে পরীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি শাড়ির ফাঁক দিয়ে তোর পাখা বের হয়ে আসবে।
এশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার সবচে’ বড় গুণ কী জান আপা? তোমার সবচে’ বড় গুণ হললা তুমি চট করে মানুষকে খুশি করে ফেলতে পার। আমি পারি না। তুমি খুব সুন্দর করে মিথ্যা কথা বল। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। যে মিথ্যা কথা বলতে পারে না তাকে মানুষ ভয় পায়। ভালবাসে না, পছন্দ করে না।
জ্ঞানের কথা বন্ধ করে তোর বিয়ের পরিকল্পনাটা বল, আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।
এশা বোনের দিকে ফিরল। সে বসেছিল পিঁড়িতে। পিঁড়ি আরেকটু টেনে নিল শামার দিকে। গলা সামান্য নামিয়ে বলল, আপা শোন, আমি খুব খারাপ ধরনের, খুবই বাজে টাইপ একটা ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। কারণ তাকে আমার খুবই পছন্দ।
কেন পছন্দ?
কেন পছন্দ সেটা আরেকদিন বলব। এখন পরিকল্পনাটা শোেন। আমি ঠিক করেছি তাকে বিয়ে করব কাজি অফিসে। তার বিরুদ্ধে পুলিশের বেশ কয়েকটা মামলা আছে। সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি ব্যবস্থা করে রাখব যেন কাজি অফিসে বিয়ের পর পর পুলিশ তার খোঁজ পায়। কাজি অফিস থেকেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। যেন পরের দুই বা তিন বছর সে জেল থেকে বের হতে না পারে।
বলিস কী?
এটা ছাড়া আমার কোনো পথ নেই আপা। বিয়ের পর পর সে যদি জেলে চলে যায়, যদি অনেকদিন সে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না পারে, তাহলে সে যে কষ্টটা পাবে তার কোনো তুলনা নেই। এই কষ্টটাই তাকে বদলে ফেলবে। বাকি জীবন সে চেষ্টা করবে যেন এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে থাকতে না হয়।
তোর কষ্ট হবে না?
আমি ভবিষ্যতের আনন্দটা দেখতে পাচ্ছিতো। আমার কষ্ট হবে না। তোমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি কেন বিয়ে করতে পারছি না তা বুঝতে পারছোতো? যে পরিবারের একটা মেয়ে এমন একজনকে বিয়ে করে, যাকে বিয়ের দিনই পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়, সেই পরিবারের মেয়েরা কেমন? সেই পরিবারের অন্য মেয়েদের বিয়ে হবার কথা না। বুঝতে পারছো?
পারছি। কিছু বলবে?
এত হিসাব নিকাশ করে কি সংসার চলে? সংসারতো কোনো অংক না।
কে বলল অংক না? অংকতো অবশ্যই। জটিল অংক, তবে খুব জটিল না। আপা, মাংসের লবণটা চেখে দেখতে লবণ ঠিক হয়েছে কি-না। লবণ চাখতে আমার কেন জানি সব সময় ঘেন্না লাগে।
রাত দশটার পর থেকে আবদুর রহমান সাহেব খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। একবার বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান, একবার যান রাস্তায়, আবার ঘরে ফিরে আসেন। সুলতানা বললেন, খেয়ে নাও। রাত হয়ে গেছে।
আবদুর রহমান সাহেব বললেন, ক্ষিধে নেই।
সুলতানা বললেন, ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এসে পড়বে। যাবে। কোথায়।
আবদুর রহমান সাহেব চাপা গলায় বললেন, গাধা ছেলে। কোথায় না কোথায় গিয়েছে। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে কি-না কে জানে!
রাস্তা হারাবে না, চলে আসবে।
কী করে বললে চলে আসবে? সব কিছু জেনে বসে আছ? দেখি শার্ট প্যান্ট দাও।
শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে? ছেলে খুঁজে বের করতে হবে না? এত বড় শহরে তুমি কোথায় খুঁজবে?
আবদুর রহমান সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, আমাকে কী করতে বল? খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব? আমার ছেলে ঘরে ফিরছে না আর আমি বিছানায় শুয়ে থাকব? তুমি আমার সামনে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার সামনে থেকে যাও।
সুলতানা শামাদের ঘরে গেলেন। গলা নিচু করে বললেন, তোর বাবা কাঁদছে। মন্টুকে নিয়ে আয়।
এশা বলল, অসম্ভব। এক সপ্তাহ মন্টুকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
তোর বাবা কাঁদছে।
কাঁদুক। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি রুমাল দিয়ে বাবার চোখ মুছিয়ে দাও। এক সপ্তাহ আমি মন্টুকে লুকিয়ে রাখব।
সুলতানা শান্ত গলায় বললেন, মা এটা তোর সংসার না। এটা আমার সংসার। তোর সংসার তুই তোর মতো করে চালাবি। আমার সংসার আমি দেখব আমার মতো। মানুষটা হাউমাউ করে কাঁদছে। তোরা যত ইচ্ছা তাদের স্বামীকে কাদাস। আমি আমার স্বামীকে কাঁদতে দেব না।
শামা বলল, মা তুমি বাবার কাছে যাও। আমি মন্টুকে নিয়ে আসছি।
মন্টু বেশ সহজভাবেই কার্পেটে বসে টিভিতে এক্স ফাইল দেখছিল। আজকের পর্বটা দারুণ। টেনশনে মন্টুর শরীর কাপছে। পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
শামা যখন বলল, মন্টু যা বাসায় যা। মন্টু বলল, আপা পনেরো মিনিট পরে যাই।
এক্স ফাইল হচ্ছে? হু। আচ্ছা ঠিক আছে, পনেরো মিনিট পরেই যা।
মুত্তালিব সাহেব নিজের ঘরের খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। শামা ঘরে ঢুকে বলল, চাচা আপনি কি রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছেন?
মুত্তালিব সাহেব বললেন, না।
আজ একটু দেরি করে খেতে বসবেন। এখা মাংস রান্না করছে। আমি এক বাটি মাংস দিয়ে যাব।
মাংস দিতে হবে না। রাতে আমি কিছু খাই না। এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব।
মুখ বাঁকা করে বসে আছেন কেন? হাঁটু ব্যথা করছে?
হুঁ।
পায়ে গরম তেল মালিশ করে দেই।
কিছু মালিশ করতে হবে না।
এরকম করে কথা বলছেন কেন? কী হয়েছে।
কিছুই হয় নি। তোকে দেখে কেন জানি বিরক্ত লাগছে। তুই সামনে থেকে যা। যাবার সময় বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যা।
একটা টেলিফোন করি চাচা?
যা ইচ্ছা কর।
শামা বাতি নিভিয়ে চলে গেল। তৃণার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবে। তারপর মন্টুকে নিয়ে বাসায় যাবে।
মুত্তালিব সাহেব অন্ধকারে হাসলেন। তাঁর মনটা আজ এই মুহূর্তে খুব ভাল। তিনি উঁকিল ডাকিয়ে উইল করেছেন। উইলে শামা নামের মেয়েটিকে তাঁর ইহজীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে গিয়েছেন। কাজটা করতে যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছে। নিজের কন্যা জীবিত থাকতে অন্য কাউকে বিষয় সম্পত্তি দেয়া যায় না। আইনের জটিলতা আছে। উঁকিল সাহেবকে আইনের জটিলতা থেকে পথ বের করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পথ বের করা গেছে। মুত্তালিব সাহেব ঠিক করেছেন। যেহেতু আজই কাগজপত্র ফাইনাল হয়েছে আজ থেকেই তিনি শামার সঙ্গে। যতদূর সম্ভব খারাপ ব্যবহার করবেন। যেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দানপত্রের খবর পেয়ে শামা ফঁপিয়ে খুঁপিয়ে তাঁর জন্যে কাঁদে।