সুলতানা এশার কাছে গিয়ে বললেন, মা যা তোর বাবাকে একটু শান্ত কর। এশা শাড়ি ইস্ত্রী করছিল। সে শাড়ি ইস্ত্রী এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ না করে বলল, কোনো দরকার নেই। বাবা আপনা আপনি শান্ত হবে।
এ রকম করলেতো স্ট্রোক হয়ে যাবে।
হয়ে গেলেও কিছু করার নেই।
সুলতানা কাঁদে কাদো মুখে বড় মেয়ের কাছে গেলেন। প্রায় মিনতির গলায় বললেন, শামা তোর বাবাকে একটু সামলা। সারা ঘরে ভাঙা কাচের টুকরা। তোর বাবা খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগের মাথায় কোনো দিকে না তাকিয়ে হাঁটবে। কাচের টুকরায় পা কাটবে।
শামা বলল, বাবার সামনে গেলেই আমি এখন ধমক খাব। আমার ধমক খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি এখন ঘরেই থাকব না।
তুই যাবি কোথায়?
বাড়িওয়ালা চাচার বাসায়। উনাকে হাঁটাব।
তোর বাবার এই অবস্থা আর তুই যাচ্ছিস আরেকজনকে হাঁটাতে?
শমা মা’র সামনে থেকে সরে দোতলায় চলে এল। চল্লিশ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখে সব শান্ত। পশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্চুপ।
আবদুর রহমান সাহেবের রাগের প্রধান কারণ মন্টু। আজ দুপুরে সে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনে পরীক্ষা সকালে হয়ে গেছে। কাজেই তার আর পরীক্ষা দেয়া হয় নি। আবদুর রহমান সাহেব সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে এই ঘটনা শুনলেন। শান্তভাবেই চা খেলেন। তারপর ছেলের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে গেলেন। চাপা গলায় বললেন, মানুষের সামনে লজ্জা না দিলে তোর হুশ হবে না। রাস্তায় নিয়ে তাকে আমি নেংটা করে ছেড়ে দেব।
তিনি এটা করলেন না, তবে যা করলেন তাও ভয়াবহ। ছেলেকে কানে ধরে একশ বার ওঠবোস করালেন। তাদের চারদিকে লোক জমে গেল। রিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ঘণ্টা দিতে লাগল।
আবদুর রহমান সাহেব পুত্রের শাস্তি পর্ব শেষ করার পর বললেন, খবরদার তুই বাড়িতে ঢুকবি না। তোকে ত্যাজ্য বাড়ি এবং ত্যাজ্য পুত্র করলাম। এখন যা, চরে খা।
মন্টু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল, তিনি বাড়িতে ঢুকে থালা বাসন ভাঙা শুরু করলেন।
অল্প সময়ের ভেতরই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। ভাঙা কাচের টুকরা সরানো হয়েছে। ভেতরের বারান্দার কাঠের চেয়ারে সুলতানা স্বাভাবিক। ভঙ্গিতেই বসে আছেন। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই বিরাট ঝড় গিয়েছে। শামা বলল, বাবা কোথায় মা?
সুলতানা বললেন, শুয়ে আছে।
রাগ কমেছে?
হুঁ।
মন্টু ফিরেছে?
না।
এশা কী করছে?
রান্না করছে।
তোমার শরীর ঠিক আছে মা?
হ্যাঁ।
শামা রান্নাঘরে চলে গেল। এশা বোনকে দেখে হাসল। যেন এ বাড়িতে কিছুই হয় নি। শামা বলল, কী রান্না করছিস।
মাংস। বাবা আজ বাংলাদেশের সবচে’ প্রবীণ গরুর মাংস নিয়ে এসেছেন। এক ঘণ্টার ওপর জ্বাল হয়ে গেছে। যতই জ্বাল হচ্ছে মাংস ততই শক্ত হচ্ছে।
গন্ধতো খুব সুন্দর বের হয়েছে।
গন্ধে গন্ধেই খেতে হবে।
শামা বোনের পাশে বসতে বসতে বলল, তুইতো ভাল রান্না শিখে যাচ্ছি। ঐ দিন মাছের ঝোল রান্না করলি, আমি বুঝতেই পারি নি তোর রান্না। আমি ভেবেছি মা বেঁধেছে।
রান্না শেখার কাজটা আমি মন দিয়ে শিখছি আপা। কারণ শুনতে চাও? কারণ হচ্ছে বিয়ের পর আমাদের সংসারে খুব গরিবি হালত চলবে। কাজের। বুয়া রাখতে পারব না। রান্নাবান্না আমাকেই করতে হবে। আমি এমন রান্না কখনো রাধব না যে মাহফুজ মুখে দিয়ে বলতে কী বেঁধেছ?
তুই এত কিছু চিন্তা করিস?
এশা হাসতে হাসতে বলল, আমি তোমার মতো না আপা। আমি খুবই চিন্তাশীল তরুণী।
তোর বিয়েটা কবে হচ্ছে?
তোমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করব না। তুমি যদি বিয়ে করতে দশ বছর দেরি কর, আমিও ঠিক দশ বছরই দেরি করব।
কারণ কী?
বললাম না, আমি খুব চিন্তাশীল তরুণী। চিন্তাশীল তরুণী বলেই তোমার বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করব।
কেন অপেক্ষা করবি? আমার সঙ্গে তোর কী? সেদিন না বললি আমি আলাদা, তুই আলাদা?
এই সংসারে যতদিন আছি ততদিন আলাদা না। সংসার থেকে বের হলে আলাদা। আপা শোন, আমি কখনো হুট করে কিছু করি না। যাই করি খুব ভেবে চিন্তে করি। আমার সব কিছুর পেছনে একটা পরিকল্পনা থাকে।
শামা আগ্রহ নিয়ে বলল, তোর বিয়ের পরিকল্পনাটা শুনি। থাক এখন না, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় শুনব।
এশা হাঁড়িতে পানি দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, রাতে ঘুমাতে যাবার সময় কিছু শুনতে পারবে না আপা। তখন বাসায় খুব হৈচৈ হতে থাকবে। কান্নাকাটি হতে থাকবে। এর মধ্যে গল্প শুনবে কি?
হৈচৈ কান্নাকাটি হবে কেন?
কারণ মন্টু রাতে বাসায় ফিরবে না। বাবা ছেলের জন্যে অস্থির হয়ে পড়বেন। তাঁর ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে। রাত বারটা একটার সময় কাঁদতে কাঁদতে নিজেই ছেলের সন্ধানে বের হবেন। বের হলেও লাভ হবে না। আগামী এক সপ্তাহ তিনি ছেলে খুঁজে পাবেন না।
শামা বলল, তুই তাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিস।
হ্যাঁ। আমি তাকে মুত্তালিব চাচার ঘরে রেখে এসেছি। তাঁকে বলে এসেছি মন্টুকে যেন এক সপ্তাহ লুকিয়ে রাখেন। আমি চাই বাবার একটা ভাল শিক্ষা হোক। ছেলের ওপর তিনি যত রাগই করেন, অচেনা অজানা একদল মানুষের সামনে তিনি তাকে লজ্জা দিতে পারেন না।
মা জানে যে, মন্টুকে তুই লুকিয়ে রেখেছিস? জানেন।
আমিতো এই মাত্রই মুত্তালিব চাচার কাছ থেকে এলাম। তুই কখন মন্টুকে নিয়ে গেলি?
আমি খুব দ্রুত কাজ করি আপা।
তাইতো দেখছি। এখন শুনি তোর বিয়ের পরিকল্পনা। তুই কথা শুরু করার আগে আমি তোক একটা কথা বলে নেই। মাথায় আঁচল দিয়ে তুই রান্না করছি। তোকে বউ বউ লাগছে। মনে হচ্ছে তুই একটা বিরাট বড় বাড়ির বড় বউ। এবং বাড়িটার সমস্ত ক্ষমতা তোর হাতের মুঠোয়।