তিনি পর পর কয়েক চামচ স্যুপ মুখে দিলেন। শামা বলল, শরীরটা কি এখন আগের চেয়ে ভাল লাগছে?
হুঁ।
একটু ভাল না অনেকখানি ভাল?
অনেকখানি ভাল।
স্যুপ খেয়ে শুয়ে পড়।
আবদুর রহমান সাহেব আরো এক চামচ স্যুপ মুখে দিলেন। ভক করে মুরগির গন্ধ মাকে লাগল। শরীর কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। বমি হয়ে যেতে পারে। তিনি বমি আটকাবার চেষ্টা করলেন। তাঁর শরীরের কলকজা ভাল না। একবার বমি শুরু হলে বাড়িতে আবারো হৈচৈ শুরু হবে। মন্টুর পড়া হবে না। পরীক্ষার আগের রাতের রিভিশনটা এক মাসের পড়ার সমান। কাল তার পরীক্ষা। মনেই ছিল না। স্যুপ খাওয়াটা বন্ধ করতে হবে। মেয়ে এমন আগ্রহ নিয়ে যেতে বলছে তিনি নাও করতে পারছেন না। মন্টু দরজা ধরে আবারো এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি চোখের ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকলেন। মন্টু এগিয়ে এলো।
রিভিশন শেষ হয়েছে?
না।
আমার শরীর ভাল আছে। আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করবি না। হাত মুখ। ধুয়ে বই খাতা নিয়ে বসে যা। রাত দু’টা পর্যন্ত পড়বি। দু’টার পর ঠাণ্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বি। পরীক্ষার আগের রাতে রিভিশন যেমন দরকার, ঘুমও ঠিক তেমনই দরকার। দু’টার ইম্পৰ্টেন্সই সমান সমান। ফিফটি ফিফটি। বুঝতে পারলি?
মন্টু মাথা কাত করল। শামা বলল, তোমার উপদেশ দেবার কোনো দরকার। নেই বাবা, তুমি স্যুপটা শেষ কর। ঠাণ্ড হলে আর খেতে ভাল লাগবে না।
আবদুর রহমান সাহেব নিচু গলায় বললেন, আমি আর খাব না। বমি আসছে। বাতি নিভিয়ে দিয়ে তুই চলে যা। আমি শুয়ে থাকব।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই? দরকার নেই। তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? হু।
ঘুম পেলে মাথায় হাত না বুলালেই ভাল। ঘুমের সময় মাথায় হাত বুলালে ঘুম কেটে যায়।
শামা বাবার ঘরের বাতি নিভিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।
সুলতানা রান্নাঘরে রুটি বানাচ্ছেন। শামা মা’র পাশে বসতে বসতে বলল, রুটি বানাচ্ছ কেন?
তোর বাবাকে দেব। বাবা শুয়ে পড়েছে, কিছু খাবে না।
আজ সারাদিন কিছু খায় নি। অফিসে শুধু একটা কলিজার সিঙ্গাড়া খেয়েছিল। টিফিন বক্স খুলেও দেখে নি।
এই বয়সে বাবার কলিজার সিঙ্গাড়া খাওয়া একেবারেই ঠিক না। পচা বাসি কলিজা দিয়ে সিঙ্গাড়া বানায়।…
সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস?
শামা নাসূচক মাথা নাড়ল। তাহলে হাত মুখ ধুয়ে আয়, রুটি খা। না-কি ভাত খাবি? রুটি খাব। গরম গরম রুটি দেখে লোভ লাগছে। সুলতানা বললেন, তোর বান্ধবীর বিয়ের উৎসব কেমন জমেছে?
খুব জমেছে। নানান ধরনের মজা হচ্ছে।
কী হচ্ছে বল, শুনি।
বলতে ইচ্ছা করছে না। বড় মানুষদের বড় মজা।
ওরা কি খুবই বড়লোক?
বড়লোক মানে হুলস্থূল বড়লোক! মীরাদের বাড়ির প্রতিটা ঘরে এসি আছে। আমার ধারণী কাজের মেয়েদের ঘরেও আছে।
বলিস কী?
কথার কথা বলছি। কাজের মেয়ের ঘরেতো আর এসি থাকে না। বড়লোকেরা যা করে নিজের জন্যে করে। অন্যের জন্যে করে না।
মীরার বাবা কী করেন?
ইন্ডাস্ট্রি আছে। মাছের ব্যবসা আছে। আরো কী কী যেন আছে।
শামা একটা রুটি নিয়ে খেতে শুরু করলো।
সুলতানা বললেন, শুধু শুধু রুটি খাচ্ছিস কেন? তরকারি দিয়ে খা। ডিম একটা ভেজে দেব, ডিম দিয়ে খাবি?
উঁহু।
সবুজ শাড়িতে তোকে যে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এই কথা কেউ বলে নি?
না বলে নি।
সুলতানা বললেন, কুমারী মেয়েদের সেজগুজে বিয়ে বাড়িতে যাওয়াটা ভাল। অনেকের চোখে পড়ে। সম্বন্ধ আসে।
সুলতানা মাথা নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, তোর বয়সে আমি যতবার কোনো বিয়ে বাড়িতে গিয়েছি ততবার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। এর মধ্যে একটা এসেছিল প্লেনের পাইলট।
পাইলটের সঙ্গে বিয়ে হলো না কেন? বিয়ে হলেতো প্লেনে করে তুমি দেশবিদেশ ঘুরতে পারতে।
বিয়ে কপালের ব্যাপার। কপালের লেখা ছিল তোর বাবার সাথে বিয়ে হবে। তাই হয়েছে।
আমার কপালে লেখা খাতাউরের সঙ্গে বিয়ে হবে, কাজেই যত সেজেগুজেই বিয়ে বাড়িতে যাই না কেন আমার কপালে খাতাউর তাই না মা? খাতাউর সাহেব যে দুপুরে বাসায় খেতে এসেছিল এটা কি বাবাকে বলেছ?
না।
বল নি কেন?
আছে একটা সমস্যা।
কী সমস্যা?
পরে শুনবি।
পরে শুনব কেন? এখন বল।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবার ইচ্ছা না ছেলেটার সঙ্গে তোর বিয়ে হোক। তার যে শরীরটা খারাপ করেছে এইসব ভেবেই করেছে।
তার মানে?
তোর বাবা আজ দুপুরে ছেলেটার সম্পর্কে খুব একটা খারাপ খবর পেয়েছে। তখনি তার শরীরটা খারাপ করেছে। এত আশা করে ছিল। হঠাৎ একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। অফিসেই বমি টমি করেছে।
খারাপ খবরটা কী?
আমাকে কিছু বলে নি। তোর বাবাকেতো তুই চিনিস একবার যদি সে ঠিক করে কিছু বলবে না, পেটে বোমা মারলেও বলবে না।
খারাপ খবর যেটা বাবা শুনেছেন সেটাতো ভুলও হতে পারে। বিয়ের সময় প্রায়ই মিথ্যা খবর রটানো হয়।
তোর বাবা বলেছে খবর মিথ্যা না।
শামা তাকিয়ে আছে। সুলতানা মেয়ের দৃষ্টির সামনে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এশার ঘরে একবার যেতে হবে। মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। স্বামীকে দেখতে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকানো হয় নি।
প্রথমে তিনি স্বামীর ঘরে উঁকি দিলেন। মানুষটা ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরাম করেই ঘুমুচ্ছে। আরামের ঘুমের সময় মানুষ হাত পা গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে যায়। বেআরামের ঘুমের সময় মানুষ সরল রেখার মতো সোজা হয়ে থাকে।