মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে শামার মনে হলো লাল কাচের চুড়ি থাকলে খুব ভাল হত। সবুজ শাড়ির সঙ্গে হাত ভর্তি লাল চুড়ি খুব মানায়। শাদা শাড়ির সঙ্গে মানায় নীল চুড়ি।
এ বাড়িতে পানির খুব টানাটানি। সাপ্লাইয়ের পানি ঝিঝির করে তিন চার ঘণ্টা এসেই বন্ধ। জমা করে রাখা পানি খুব সাবধানে খরচ করতে হয়। কেউ পানি বেশি খরচ করলে তার দিকে সবাই এমনভাবে তাকায় যেন চোখের সামনে মূর্তিমান পানি-খেকো শয়তান। আজ শামার সেই ভয় নেই। পুরো বালতি শেষ করলেও কেউ কিছু বলবে না। শামা মনের আনন্দে মাথায় পানি ঢালতে লাগল। ঠাণ্ডা পানিতে এত আরাম লাগছে! শামার ধারণা গায়ে প্রচুর পানি ঢাললে শুধু যে। শরীরের নোংরা দূর হয় তা-না, মনের ময়লাও খানিকটা হলেও ধুয়ে চলে যায়। এই জন্যেই মন ভাল লাগে।
যে ছেলেটা তাকে দেখতে আসবে তাদের বাড়িতে প্রচুর পানি আছেতো? সবচে’ ভাল হয় যদি বাড়িতে বাথটাব থাকে। গরমের সময় বাথটাব ভর্তি করে সে পানি রাখবে। বরফের দোকান থেকে চার পাঁচ কেজি বরফ এনে গুড়ো করে। বাথটাবে ছেড়ে দেবে। কয়েকটা টাটকা গোলাপ কিনে গোলাপের পাপড়ি পানিতে ছেড়ে দিয়ে সে ডুবে থাকবে। হাতের কাছে টি পটে চা থাকবে। মাঝে। মাঝে চায়ে চুমুক দেবে। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজতে পারে। নিশ্চয়ই বাথরুমে গান শুনতে ভাল লাগবে। অনেক মানুষই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই গান ধরে। ভাল না লাগলে নিশ্চয়ই ধরত না।
সুলতানা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিলেন। অবাক হয়ে বললেন, শামা ভাত তরকারি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ কী করছিস?
শামা হালকা গলায় বলল, বালতির পানি সব শেষ হয়ে গেছে মা। আরো পানি লাগবে।
আর পানি পাব কোথায়?
বাড়িওয়ালা চাচার ঘর থেকে আনাও। সারা গায়ে সাবান মেখে বসে আছি। পানি শেষ। আরেকটা কথা মা, যে ছেলেটা আমাকে দেখতে আসছে তার নাম কী?
ছেলের নাম আতাউর।
কী সর্বনাশ আতাউর আবার মানুষের নাম হয়? নাম শুনলেই মনে হয়। খাতাউর সাহেব হাঁ করে আছেন— খেয়ে ফেলার জন্যে।
খাতাউর না, আতাউর। শামা তুই ইচ্ছা করে ফাজলামি করছিল। এইসব ঠিক না।
পানি আনার ব্যবস্থা কর মা। আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। মা শোন, লাল চুড়ি আছে? তোমার ট্রাংকেতো অনেক জিনিস আছে। খুঁজে দেখতে লাল চুড়ি আছে নাকি। আমি লাল চুড়ি পরব।
সুলতানা আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে সহজভাবে কথা বলছে। তিনি কাজের মেয়েকে বালতি দিয়ে পানি আনতে পাঠালেন। মেয়েটা শখ মিটিয়ে গোসল করুক। মেয়েদের অতি তুচ্ছ শখও সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হয়। মেয়েরা মা-বাপের সংসারে থাকে না। অন্য সংসারে চলে যায়। যে সংসারে যায় সেখানে সে হয়ত মুখ ফুটে শখের কথাটা বলতেও পারে না।
অতিথিরা পাঁচটার সময় উপস্থিত হলেন। তখন শামার চুল বাঁধা হচ্ছে। চুল বেঁধে দিচ্ছে শামার ছোট বোন এশা। এশা এ বছর ক্লাস টেনে উঠেছে। সে খুবই হাসি খুশি মেয়ে। গত ছ’দিন ধরে কী কারণে যেন সে মুখ ভোতা করে আছে। কারো সঙ্গেই কথাবার্তা বলছে না। এশার মুখ ভোঁতার রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা কেউ করছে না। কারণ চেষ্টা করে লাভ নেই। এশা নিজ থেকে মুখ না খুললে কেউ তার মুখ খোলাতে পারবে না।
লোকজন চলে এসেছে এই খবরটা দিল শামার ছোট ভাই মন্টু। সে গত বছর এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিল। টাইফয়েড হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষা শেষ করতে পারে নি। এবার আবারো দিচ্ছে। আগামী বুধবার থেকে তার পরীক্ষা শুরু। মন্টুর ধারণা এবারে পরীক্ষার মাঝখানে তার কোনো বড় অসুখ হবে, সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। এরকম স্বপ্নও সে দেখে ফেলেছে। স্বপ্নে পরীক্ষার হল থেকে এম্বুলেন্সে করে তাকে সরাসরি হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে ডাক্তাররা ছোটাছুটি শুরু করেন। কারণ তাকে রক্ত না দিলে সে মারা যাবে। কারো রক্তের সঙ্গেই তার রক্ত মিলছে না। শেষে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মিলল। সেই একজন তাদের স্কুলের হেড স্যার। তিনি রক্ত দিতে এসে তাকে দেখে প্ৰচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, কীরে তুই এ বছরও পরীক্ষা দিচ্ছিস না? ফাজলামি করিস?
মন্টু এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপা, এসে গেছে। চারজন এসেছে।
শামা বিরক্ত গলায় বলল, চারজন এসেছে খুব ভাল কথা। তুই ফিসফিস করছিস কেন? এর মধ্যে ফিসফিসানির কী আছে।
ট্যাক্সি করে এসেছে।
শুনে খুশি হলাম। ট্যাক্সি করেইতো আসবে। ঠেলাগাড়িতে করে তো আসবে না। না-কি তুই ভেবেছিলি ঠেলাগাড়ি করে আসবে?
অনেক মিষ্টি এনেছে। পাঁচ প্যাকেট।
সামনে থেকে যা তো, কানের কাছে বিজবিজ করবি না। কয় প্যাকেট মিষ্টি এনেছে—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুণেছিল। শুনতেইতো লজ্জা লাগছে।
মেহমানরা বসার ঘরে বসেছেন। তাদেরকে চা নাস্তা এখনো দেয়া হয় নি। আরো দু’জন নাকি আসবেন। তাদের জন্য অপেক্ষা। মজার গল্প হচ্ছে। হাসি শোনা যাচ্ছে।
শামা সেজেগুজে অপেক্ষা করছে। চা নিয়ে যেতে বললেই সে ট্রেতে করে চী নিয়ে যাবে। এই উপলক্ষে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে সুন্দর একটা ট্রে আনা হয়েছে। ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে। এক ধরনের চায়ের কাপ আছে ছ’টা। চারজন গেস্ট আছেন। আরো দু’জন আসবেন। ছ’টা কাপ হয়ে গেল। আবদুর রহমান সাহেবকে চা দিতে হবে, তার জন্যে একটা কাপ লাগবে। তারা হয়ত শামাকেও চা খেতে বলবেন। আরো দু’টা ভাল কাপ দরকার।
সুলতানা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। তিনি ঠিক করেছেন মেহমানদের কোনো বাইরের খাবার দেবেন না। সব খাবার ঘরে তৈরি হবে। তিনি কলিজার সিঙ্গাড়া বানানোর চেষ্টা করছেন। সিঙ্গাড়ার তিনটা কোণা ঠিক মতো উঠছে না। সিঙ্গাড়া তিনি আগেও বানিয়েছেন। তখন ঠিকই কোণা উঠেছে। এখন কেন উঠছে না? বিয়েতে কোন অলক্ষণ নেই তো? আজ সকালবেলা বেশ কয়েকবার তিনি এক শালিক দেখেছেন। এক শালিকের ব্যাপারটা অনেকেই বিশ্বাস করে না। তিনি খুব করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি লক্ষ করেছেন যতবার এক শালিক দেখেছেন ততবারই ঝামেলা হয়েছে।