শামা বলল, টেলিফোন কোন ঘরে?
বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, টেলিফোন সব ঘরে আছে। আপনে দোতলায় চলেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শামা দেখল হলুদ ব্লেজার পরা এক ভদ্ৰলোক সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন। বেঁটে খাট মানুষ, মাথাভর্তি চুল। বিরক্তিতে তাঁর চোখ কুঁচকে আছে, তবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মধ্যে ছেলেমানুষি আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন। যেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠাও একটা খেলা। ভদ্রলোকের চেহারাতেও ছেলেমানুষি আছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পৃথিবীতে জন্মায় যাদের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে না। এই ভদ্ৰলোক সেরকম। বাসে এই ভদ্রলোকের পাশে বসলে কোনো মেয়েই অস্বস্তি বোধ করবে না।
ভদ্রলোক শামাকে দেখে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনি কি মীরার বান্ধবীদের একজন?
জি।
আমি আমার চশমা তিনতলার খাবার টেবিলে রেখে বাথরুমে হাত মুখ ধুতে গিয়েছিলাম। হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি চশমাটা নেই। আমার মাইওপিয়া আছে। চশমার পাওয়ার থ্রি ডাইওপটার। আমার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে সিঁড়িতে দু’বার হোঁচট খেয়েছি। আমার ধারণা মীরার বান্ধবীরা মজা করার জন্যে চশমা লুকিয়ে ফেলেছে। এটা ঠিক না। আপনি মীরার বান্ধবীদের একজন। আপনি কি চশমাটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন? আপনি কি জানেন চশমাটা কার কাছে?
জি না।
প্রথম ভুলটা আমিই করেছি। চশমা সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল। এমন তো না যে বাথরুমে চশমা রাখার জায়গা নেই। বেসিনে রাখা যেত। তবে একবার বেসিনে রেখেছিলাম। বেসিন থেকে পড়ে চশমার গ্লাস ফ্রেম থেকে বের হয়ে এসেছিল। সরি, আপনাকে আটকে রেখেছি। কিছু মনে করবেন না।
ভদ্রলোক আগের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলেন। শামার খুবই মজা লাগছে। কোনো বয়স্ক মানুষকে এইভাবে সিড়ি বেয়ে উঠতে সে আগে কখনো দেখে নি। হড়বড় করে অকারণে এত কথা বলতেও শশানে নি। ভদ্রলোক এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন শামাকে তিনি
অনেকদিন থেকে চেনেন।
হ্যালো কে?
শামা, গলা চিনতে পারছি না? আমি মুত্তালিব। তোদর বাড়িওয়ালা চাচা।
এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার আপনি কোথায় পেলেন?
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। Where there is a will, there is a way. তুই কি অবাক হয়েছিল?
হুঁ।
তোর গলাতে আমি চিনতে পারছি না। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিস কেন? একটা জিনিস খেয়াল রাখবি, টেলিফোনে কথা বলার সময় যতটা সম্ভব মিষ্টি গলায় কথা বলবি। কারণটাও ব্যাখ্যা করি। টেলিফোন কনভারসেশনের পুরোটাই অডিও। মুখ দেখা যাচ্ছে না— গলার স্বরটাই ভরসা। কাজেই সেই স্বরটা মিষ্টি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কি আমার কথায় লজিক খুঁজে পাচ্ছিস?
শামা কিছু বলল না। সে স্বস্তিবোধ করছে। কারণ মুত্তালিব চাচার গলা স্বাভাবিক। তিনি হাসি মুখে কথা বলছেন। কোনো খারাপ সংবাদ থাকলে তিনি
এমন হাসিমুখে কথা বলতেন না।
হ্যালো শামা?
হ্যাঁ শুনছি।
এই টেলিফোন নাম্বার কী করে জোগাড় করলাম সেটা বলি।
কী জন্যে টেলিফোন করেছেন সেটা আগে বলুন।
স্টেপ বাই স্টেপ বলি। তুই এতো ছটফট করছিস কেন? মনে হচ্ছে পাবলিক টেলিফোন থেকে টেলিফোন করছিস তোর পেছনে লম্বা লাইন। সবাই তোকে তাড়া দিচ্ছে। শোন শামা, হ্যালো হ্যালো…
শুনছি।
আমি করেছি কী শোন। প্রথমে এশাকে বললাম, তোমার বোনের ডায়েরি ঘেঁটে দেখ তার কোনো বান্ধবীর নাম্বার লেখা আছে কিনা। সে একজনের নাম্বার দিল। তৃণা মেয়েটার নাম। আমি তৃণার বাসায় টেলিফোন করে এই বাড়ির নাম্বার নিলাম। বুঝেছিস?
বুঝলাম। আপনার অনেক বুদ্ধি। এখন বলুন টেলিফোন করেছেন কেন?
টেলিফোন করেছি এটা বলার জন্য যে, বাসায় চলে আয়। আমি তোদের এখানকার ঠিকানা নিয়ে গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছি। এতোক্ষণে গাড়ি পৌছে যাবার কথা।
বাসায় চলে আসব?
হুঁ।
কেন?
তোর বাবার শরীর খারাপ। বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। এখন ভাল। কিছুক্ষণ আগেও বিছানায় শুয়ে ছিল। এখন দেখে এসেছি বিছানায় বসা। লেবুর সরবত খাচ্ছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে শামা, শামা, করছে। এই জন্যেই আমার মনে হয় ভোর চলে আসাটা ভাল হবে।
শামা হতভম্ব গলায় বলল, চাচা আপনি কী বলছেন?
আপসেট হবার কিছু নেই। তার বাবা ভাল আছে। ডাক্তার এসে দেখে। গেছে। বলেছে চিন্তার কিছু নেই। প্রেসার সামান্য বেশি। প্রেসার কমানোর ওষুধ দেয়া হয়েছে। সিডেটিভ দেয়া হয়েছে। আমি যতদূর জানি এখন নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে।
চাচা আমি আসছি।
তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই টেনশনে মরে যাচ্ছি। টেনশন করার মতো কিছু হয় নি। এভরিথিঙ্ক ইজ আভার কন্ট্রোল। তোর মা শুরুতে খুব ভয় পেয়েছিল। এখন সামলে উঠেছে। তুই বরং এক কাজ কর— বাবাকে দেখে তারপর আবার বিয়ে বাড়িতে চলে যা। সাপ মরল লাঠি ভাঙল না। Snake is dead, stick in tact হা হা হা।
এত হাসছেন কেন? হাসির কী হল?
তোর টেনশন দেখে হাসছি। ভুল বললাম। টেনশন দেখতে পারছি না। শুধু ফিল করছি।
আমার টেনশন করাটা কি হাস্যকর?
হ্যাঁ, হাস্যকর। ছোটখাট ব্যাপারে যদি এত টেনশন করিস বড় ব্যাপারগুলি কীভাবে সামাল দিবি?
চাচা আমি রাখি।
এখন টেলিফোন রেখে কী করবি? গাড়িতো এখনো পৌছে নি। ততক্ষণ কথা বল।
চাচা, আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
শামা টেলিফোন রেখে দ্রুত নিচে নেমে গেল। মুত্তালিব চাচার গাড়ি এখনো আসে নি। গাড়ির ড্রাইভার যদি বাসা চিনে আসতে না পারে? আচ্ছা সে কি আতাউরকে টেলিফোন করে আসতে বলতে পারে না? আতাউর তাকে বেবীটেক্সি করে পৌঁছে দেবে। এতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই।