বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ছে। সুলতানা দরজা ধাক্কাচ্ছেন। শামা বলল, কী হলো মা? তুমি দেখি দরজা ভেঙে ফেলার জোগাড় করছ।
সুলতানা ফিসফিস করে বললেন, বারান্দায় আতাউর বসে আছে না?
হ্যাঁ। ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিসানির কোনো কারণ ঘটে নি।
তুই এই নাটকটা কেন কলি? কেন আমাকে বললি না আতাউর এসেছে।
মা প্লিজ ফিসফিস করবে না তো। মনে হচ্ছে তুমি কথা বলছ না। হাঁস কথা বলছে।
ঘরে খাবারের আয়োজন এত খারাপ। তুই এটা কী করলি বলতে মা?
আমি কিছুই করি নি। তোমার কি ধারণা আমি দাওয়াত করে নিয়ে এসেছি? ভদ্রলোক নিজেই এসেছেন। মা শোনো, তুমি কি দয়া করে জমিদার সাহেবকে এক গ্ৰাস পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করবে? আমার কাছে ঠাণ্ডা পানি চেয়েছেন, আমি ভুলে গেছি।
কী সর্বনাশের কথা, তুই ভুললি কী করে! না জানি কী মনে করছে।
কিছুই মনে করছে না মা। তুমি মুত্তালিব চাচার ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি আনাও তারপর ন’আনির জমিদারকে এক গ্লাস পানি পাঠাও। আর শোন মা, বাথরুমের সামনে থেকে সর। আমি লক্ষ করেছি আমি বাথরুমে ঢুকলেই তোমার একশ একটা গল্প করার নেশা চাপে।
চট করে একটু পোলাও করে ফেলব?
পোলাও কী দিয়ে খাবে। বেগুন ভাজা দিয়ে? ঘরে ডিম আছে। ডিমের কোরমা করি?
তোমার যা ইচ্ছা কর। এখন দয়া করে বাথরুমের সামনে থেকে সর। আমার খুবই বিরক্তি লাগছে।
শামা গায়ে পানি ঢালছে। গরমের সময় শরীরে পানি ঢাললেই ভাল লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও অনেক বেশি ভাল লাগছে কেন? শামার হঠাৎ মনে। হলো বাথরুমের বন্ধ দরজার ওপাশে যদি মা দাঁড়িয়ে না থেকে খাতাউর সাহেব দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে চমৎকার হত। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে আতাউর সাহেবের সঙ্গে গল্প করা যেত। কী গল্প করা যায়? কোনো মানে হয় না এমন সব গল্প। ধাধা জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? মাকড়সার একটা ধাধা আছে। কেউ এই ধাধার উত্তর পারে না। এটা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। শামা মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে বলবে, আচ্ছা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন মাকড়সা জাল বানায়। বানায় না?
আতাউর বলবে, হ্যাঁ, জানি।
সেই জালে অন্যান্য পোকা আটকায়, মাকড়সা সেগুলো খায়। এটা জানেন তো?
হা জানি।
আচ্ছা তাহলে বলুন মাকড়সা তো পোকাই। সে কেন নিজের জালে আটকায় না?
মীরা
বাড়ি দেখে শামা হকচকিয়ে গেল। সে অনেকবার শুনেছে মীরাদের বিরাট বাড়ি। সেই বিরাট বাড়ি যে এই হুলুস্থুল তা বুঝতে পারে নি। এমন বাড়ির একটা মেয়ে ইডেন কলেজে পড়বে কেন? সে পড়বে দেশের বাইরে ইংল্যান্ড আমেরিকায়। তা না হলে দার্জিলিং-টার্জিলিং। এমন বাড়ির মেয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়। ভাবাই যায় না।
শামা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির নাম্বার ঠিক আছে নামও ঠিক আছে হ্যাপি কটেজ। সব ঠিক থাকার পরেও তো ভুল হতে পারে। হয়ত এটা মীরাদের বাড়ি না। অন্য কারোর বাড়ি। একই নামের দু’টো বাড়িতে থাকতেই পারে।
আতাউর বলল, এই বাড়ি?
শামা বলল, তাইতো মনে হয়।
তুমি আগে আস নি?
না।
কী বিশাল ব্যাপার।
শামা বলল, আপনি চলে যান।
আতাউর দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। শামা বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলে যান। আতাউর বলল, যেতে ইচ্ছা করছে না। তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকলামতো, অভ্যাস হয়ে গেছে।
মানুষটা চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শামার তীব্র ইচ্ছা হলো মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেয়। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে। মানুষটাকে ছুঁয়ে না দিলে সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। একটা অজুহাত তৈরি করে কি মানুষটাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় না! সে কি বলতে পারে না- এই যে। শুনুন, আপনার কপালে এটা কী লেগে আছে? খুব স্বাভাবিকভাবে এই কথাটা বলে সে কপালে হাত দিতে পারে। কপালে হাত দিয়ে অদৃশ্য ময়লা সরিয়ে ফেলা। মানুষটার নিশ্চয়ই এত বুদ্ধি নেই যে কপালে ময়লার আসল রহস্য ধরে ফেলবে। এই জাতীয় ব্যাপারগুলোতে পুরুষদের বুদ্ধি থাকে কম।
হ্যাপি কটেজের বারান্দায় তৃণা দাঁড়িয়ে আছে। সে শামাকে দেখে হাত নাড়ছে। শামা বাড়ির ভেতর ঢুকল। তৃণা অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে শামার কাছে এসে বলল, মারাত্মক একটা ব্যাপার হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। না? মীরাকে আজ নিচ্ছে না। এই বাড়িতেই বাসর হবে। মারাত্মক না?
শামা বলল, মারাত্মক কেন?
বুঝতে পারছি না কেন মারাত্মক?
না।
তৃণা বিরক্ত গলায় বলল, তোর কি মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই নাকি? এই বাড়িতে বাসর হচ্ছে তার মানে কী? আমরা বাসর ঘর সাজানোর সুযোগ পাচ্ছি। অলরেডি সাজানো শুরু হয়েছে। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে, তার কলাবাগানে ভিডিওর দোকান। তাকে খবর দেয়া হয়েছে। সে বাসর ঘরে গোপন। ভিডিও ক্যামেরা সেট করে রাখবে। একটা সাউন্ড রেকর্ডারও থাকবে। মীরার যাবতীয় অডিও ভিজুয়াল কর্মকাণ্ড রেকর্ডের অবস্থায় থাকবে। এখন বুঝতে পারছিস কেন মারাত্মক?
পারছি।
মীরা কিছু বুঝতে পারছে না?
সে তার বিয়ের টেনশনে বাঁচে না, সে কী বুঝবে তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।
বাসর হচ্ছে কোথায়?
মীরার ঘরে হচ্ছে না। ছাদে এদের প্রকাণ্ড একটা কামরা আছে। সেখানে হচ্ছে।
তুই এ বাড়িতে আগে এসেছিস।
এসেছি। মাত্র একবার এসেছি। এত প্রকাণ্ড বড়লোকের বাড়িতে বারবার আসা যায় না। এত বড় বাড়িতে নিজেকে সব সময় পর পর লাগে। তবে আমরা সবাই এক সঙ্গে আছিতো আমাদের লাগছে না।