সুলতানা বিস্মিত হয়ে বললেন, এইসব কী বলছিস! উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। মা ডাকেন।
এশা বলল, মা ডাকলেও ঠিক না। ঠিক না কেন?
আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মা। আমার কাছে মনে হচ্ছে ঠিক না। মুত্তালিব চাচা আপাকে খুব পছন্দ করেন আবার আপাও উনাকে খুব পছন্দ করেন। তুমি কি লক্ষ করেছ দিনের মধ্যে একবার দোতলায় না গেলে আপা থাকতে পারে না?
ও যায় টেলিফোন করতে।
টেলিফোন করতে যাওয়াটা আপার একটা অজুহাত।
তুই বেশি বেশি বোঝার চেষ্টা করছিস এশা। এত বেশি বোঝা কিন্তু ঠিক না। কিছু কিছু মানুষ আছে ভালর মধ্যে মন্দ খুঁজে। তুইও তাদের মতো হয়ে গেলি?
তুমি রেগে যাচ্ছ মা। কথা ছিল তুমি রাগবে না।
আমি রাগি নি। তোর কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। মানুষের সম্পর্ক এত ছোট করে দেখতে নেই।
এশা চুলায় হাড়ি বসাতে বসাতে বলল, মা শোন, একবার মুত্তালিব চাচার। টেলিফোন নষ্ট ছিল। প্রায় এক মাস নষ্ট ছিল। এই একমাসও কিন্তু বড় আপা প্রতিদিন একবার করে দোতলায় গেছে।
তাতে কী হয়েছে?
কিছু হয় নি এম্নি বললাম। তুমি যে বললে আপা টেলিফোন করতে যায় এটা যে ঠিক না তা বোঝানোর জন্যে বললাম। তুমি রেগে যাচ্ছ বলে গুছিয়ে তোমাকে কিছু বলতে পারছি না। মা শোন, আপা যখন শুনবে আজ বাসায় সর্ষে ইলিশ রান্না হচ্ছে সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে মুত্তালিব চাচার জন্যে তরকারি পাঠাতে।
এতে দোষের কী আছে? উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। মেয়ে কি বাবার জন্যে তরকারি নিয়ে যাবে না? এক টুকরা মাছ মানুষটার জন্যে নিয়ে গেলে সেটা দোষের হয়ে যাবে?
এশা বলল, মা সরি। এই প্রসঙ্গটা তোলা ঠিক হয় নি। তোমার মুখ থেকে রাগ রাগ ভাবটা দূর করে সহজভাবে তাকাও। আমার মন আসলেই ছোট। কী আর করা। মা, চা খাবে?
না।
চা খাও। আমি তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। চা বানানোটা আমি ভাল শিখেছি মা। বানাই? প্লীজ।
বললামতো না।
তোমার সঙ্গে আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে মা। কঠিন মুখে না বলবে না। আমিতো স্বীকার করেছি আমার মন ছোট। তারপরেও রাগ করে থাকাটা কি ঠিক?
এশী খালি চুলায় চায়ের কেতলি বসাল। শামা এসে উপস্থিত হলো। খুশি খুশি গলায় বলল, চা হচ্ছে না-কি রে? আমিও চা খাব। আজ কি তুই রান্না করছিস?
হুঁ।
কী রান্না?
সর্ষে ইলিশ।
ইলিশ মাছে ডিম ছিল?
ছিল।
ডিমটা আলাদা করে রাখবি। মুত্তালিব চাচা ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করেন। ডিমটা আমি উনাকে দিয়ে আসব।
আচ্ছা।
সুলতানা এশার দিকে তাকিয়ে আছেন। এশা একবার মা’র দিকে তাকাল না। সে নিজের মনে চা বানাচ্ছে। শামা বলল, মা শোন, চাচাকে একসারসাইজ করিয়ে এসেছি। আমার কী মনে হয় জান মা? আমার মনে হয় একসারসাইজের চেয়েও উনার যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে সেঁক। কাল থেকে একসারসাইজও করাব, সেঁকও দেব।
তুইতো ডাক্তার না। তুই এসবের জানিস কী?
শামা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ছোটখাট ব্যাপার জানার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা।
এশা বলল, আপা তুমি কী আতাউর ভাইকে টেলিফোন করছিলে?
শামা বলল, না। আমার এত গরজ নেই।
বাবা শখ করে টেলিফোন নাম্বার এনেছেন। একবার টেলিফোন কর।
শামা হালকা গলায় বলল, বাবার শখ থাকলে বাবা করুক। আমার শখ নেই।
সুলতানা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে উঠে গেলেন। এশার কথাগুলি শোনার পর থেকে তার ভাল লাগছে না। মনের মধ্যে কী যেন খচখচ করছে। অদৃশ্য কোনো কাটা বিধে আছে।
শোবার ঘর অন্ধকার করে আবদুর রহমান শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের বুড়ো আঙুল এবং নাক এক লাইনে। সুলতানা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে শরীর খারাপ না-কি?
আবদুর রহমান উঠে বসতে বসতে বললেন, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। মুখের ভেতরটা টক টক লাগছে।
জ্বর আসে নি তো?
না।
চা খাবে? নাও চা খাও, রান্নার দেরি হবে।
অসুবিধা নেই, তোক দেরি।
আজ এশা রান্না করছে।
ও রান্না জানে?
জানে না, শিখবে। তোমার বড় মেয়ের রান্নাবান্নায় আগ্রহ নেই। এশার আছে।
দুই মেয়েকেই শিখিয়ে দাও। আজকালকার মেয়েরা সব শিখতে রাজি, শুধু রান্না শিখতে রাজি না। রান্না শেখাটা খুব দরকার।
আমার মেয়েরা আজকালকার মেয়ের মতো না।
আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের খোঁজ নিয়েছি। এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মতো আছে। এতে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না?
সব টাকা এক মেয়ের পেছনে খরচ করে ফেলবে? তোমার তো আরো একটা মেয়ে আছে।
প্রথম বিয়ে একটু ধুমধাম করে দেই। আমি ঠিক করেছি বিয়ের পর মেয়ে। জামাইকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব। পালকির ব্যবস্থা করব। পালকি করে জামাই-বৌ যাবে। গ্রামের মানুষ ভিড় করবে।
পালকি পাবে কোথায়? দেশে কি পালকি আছে?
আমাদের এদিকে আছে। গ্রামের বাড়িটাও এই উপলক্ষে ঠিক করতে হবে। গ্রামের মানুষরা তো আর দলবেঁধে বিয়েতে আসতে পারবে না। একটা গরু জবহ করে ওদের খাইয়ে দেব।
তার কি দরকার আছে?
আছে। দরকার আছে। সুলতানা শোন, এর মধ্যে আতাউরকে বলি একবেলা এসে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাক।
বল।
অফিস থেকে ফেরার সময় ওকে নিয়ে আসব। রাতে খেয়ে দেয়ে যাবে। গল্প-গুজব করবে। আমিতো আর গল্প করতে পারি না। তোমরা করবে।
আচ্ছা।
তোমার কিছু স্পেশাল রান্না যে আছে সেগুলি কর। শাশুড়ির হাতের রান্না খেয়ে বুঝুক রান্না কাকে বলে! কলার থোর বেটে তুমি যে জিনিসটা কর ওটা করবে। আর মাছের টকও রাঁধবে। নেত্রকোনার ছেলেতো শুটকি পছন্দ করবে। বেগুন দিয়ে শুটকি করবে।