সকাল দশটা।
হাসান আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে চারপাশের অবস্থা দেখে সে মোটামুটি তৃপ্ত। তবে আরো অনেক কিছু করার বাকি। এক সপ্তাহে কাজ যতটুকু আগানোর কথা ততটুকু অবশ্যি আগায়নি। তিনটা টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ডীপ টিউবওয়েলের কাজ চলছে— এখনো শেষ হয়নি। দুটা বড় জেনারেটর চলে এসছে। ইলেকট্রিক লাইন টানার কাজ মোটামুটি শেষ।
ওয়ার্কারদের থাকার জন্যে চারটা লম্বা টিনের শেড করা হয়েছে। এই মুহূর্তে একশ আঠারোজন ওয়ার্কার কাজ করছে। এই সংখ্যা আরো বাড়বে। আরো দুটা টিনশেড বানাতে হবে। একেক ধরনের ওয়ার্কার একেকটা টিনশেডে থাকবে। মাটি কাটার মানুষরা একটিতে, রাজমিস্ত্রিরা আরেকটিতে, লোহার কারিগররা আরেকটিতে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি। অনেকগুলি দল।
সংখ্যায় বেশি হলেই কাজ ভালো হয় না— সংখ্যাটাকে কাজে লাগানোর জন্যেও একদল হুকুম দেবার লোক লাগে। হাসান এই শ্রেণীর লোকেরই অভাব অনুভব করছে। তবে সে অত্যন্ত আনন্দিত যে মজুকে পাওয়া গেছে। মজুর বয়স চল্লিশের মতো–কাকলাসের মতো চেহারা। চামড়া রোদে পুড়ে প্রায় ঝলসে গেছে। গলার স্বরে সমস্যা আছে। কথা বলে চি চি করে। তার খুব ঘনিষ্ঠজন ছাড়া তার সব কথা কেউ বুঝতে পারে না।
মজু যে-কোনো কাজ জানে। যে-কোনো সমস্যা বুদ্ধি খাটিয়ে করতে পারে। মজুকে যদি বলা হয়–মজু এই কাজটা করতে হবে। সম্পূর্ণ মাটির ঘর বাড়ি হবে— ঘরের ছাদও মাটির। বৃষ্টি পড়লে মাটির ছাদ গলে বাড়ি ধসে যাবে। একটা বুদ্ধি বের কর যেন ছাদ ধসে না যায়। মজু দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কাটতে কাটতে বলবে— আচ্ছা।
পারা যাবে না?
মজু অবশ্যই হা-সূচক মাথা নাড়বে। হাসানের ধারণা মজুর ঘাড়ে কোনো সমস্যা আছে বলে সে না-সূচক মাথা নাড়তে পারে না। শারীরিক সমস্যার কারণে হা-সূচক মাথা নাড়ে। যেহেতু হা-সূচক মাথা নেড়ে ফেলেছে সেহেতু কোনো-না-কোনো বুদ্ধি বের করে কাজটা করে ফেলে।
হাসানের মতে এরকম একটা লোক পাশে থাকা আর দশটা হাতি পাশে থাকা সমান। মঞ্জুর মতো আরেকজন আছে মোবারক। হাসান তাকে। ডাকে ফাঁকিবাজ মোবারক। তার প্রধান লক্ষ্য কীভাবে ফাঁকি দেবে। শুধু একা ফাঁকি দেবে না, তার পুরা দল নিয়ে ফাকি দেবে। ফাকি ধরা পড়লে মিষ্টি করে হাসবে, মাথা চুলকাবে। মোবারক মূলত রঙমিস্ত্রি, কিন্তু সেও মজুর মতো। সব জানে এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধি। মোবারকের বুদ্ধি কানে লাগাতে হলে তার পেছনে সবসময় একজনকে লেগে থাকতে হয়, যার প্রধান কাজ মোবারক কোন্ দিক দিয়ে ফাঁকি দিচ্ছে সেটা বের করা।
ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাস-করা তিনজনকে হাসান তার প্রজেক্টে কাজ দিয়েছে। এদের বয়স অল্প নতুন চিন্তাভাবনায় এরা ভালো করবে। কার্যক্ষেত্রে সেরকম দেখা যাচ্ছে না। প্রজেক্টের ব্যাপার দেখে এরা মোটামুটি হকচকিয়ে গিয়েছে। তারা তিনজনই একসঙ্গে ঘোরে। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে নিচুগলায় কথা বলে। খুবই আনাড়ি ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে খুকখুক করে ক্যশে। হাসানের ধারণা, চাকরি পাবার পর তারা সিগারেট ধরেছে। হাসানকে তারা তিনজনই কোনো কারণ ছাড়াই অসম্ভব ভয় পায়। হাসান তাদেরকে এখনো কোনো কাজ দেয়নি। বিরাট কর্মযজ্ঞে পড়ে তিন তরুণ ইনজিনিয়ারের শুকনা মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। তিনজন এখন গিটু পাকিয়ে আছে। গিঁট ফাড়িয়ে তিনজনকে তিনদিকে লাগিয়ে দিতে হবে। এমন কাজের চাপে ফেলতে হবে যেন তাদের দেখা হয় রাত দশটার পরে।
হাসান পা লেংচাতে লেংচাতে এগুচ্ছে। তাকে এগুতে দেখে দূর থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে লীনা উপস্থিত হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
হাসান বলল, কোথাও না। একটু হাঁটি।
আপনার পা ফুলে কী হয়েছে। এই অবস্থায় আপনি হাঁটছেন। পা তো আরো ফুলবে।
ফোলা পা-কে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। আপনি যাচ্ছেন কোন দিকে? বিশেষ কোনো দিকে না, আমি পুরো জায়গাটায় একটা চক্কর দেব।
লীনা আতঙ্কিত গলায় বলল, পুরো জায়গাটা চক্কর দিতেতো স্যার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। স্যার, আপনি একটা ভ্যানগাড়িতে বসুন। ভ্যানগাড়ি আপনাকে টেনে নিয়ে যাক।
হাসান বলল, তুমি আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না। আমি যত বেশিবার জায়গাটা ঘুরব ততবেশি জায়গাটা আমার মাথায় ঢুকবে। পরিকল্পনা করতে আমার তত সুবিধা হবে।
স্যার আমি আপনার সঙ্গে আসছি।
তোমাকে সঙ্গে আসতে হবে না। তোমার গেস্ট এসেছে। গেস্ট এন্টারটেইন কর। গেস্টদের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হল তোমার বোন। একই রকম চেহারা। আরেকজন কে?
লীনা লজ্জিত গলায় বলল, ফিরোজ ভাই।
হাসান বলল, ও আচ্ছা–ইনার সঙ্গেই তোমার এনগেজমেন্ট হয়েছে। বিয়ে কবে?
এখনো ঠিক হয়নি স্যার।
ফিরোজ সাহেব কী করেন?
একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেন।
তোমার গেস্টরা কি আজ থাকবেন, না চলে যাবেন?
চলে যাবেন।
তাদের রেখে দাও। থাকার তো অসুবিধা নেই। তোমার বোন তোমার সঙ্গে তাঁবুতে থাকতে পারে। ফিরোজ সাহেব থাকবেন গেস্টদের তাঁবুতে।
স্যার আমি বলে দেখব।
লীনা তুমি আরেকটা কাজ কর। তিনজন ইয়াং ইনজিনিয়ার আছে না? একসঙ্গে গিটু পাকিয়ে ঘুরছে। ঠিক একঘণ্টা পর এদের একজনকে আমার কাছে পাঠাবে। তার প্রথম এসাইনমেন্ট হচ্ছে আমাকে খুঁজে বের করা।
কোন্ জনকে পাঠাব স্যার?
যে-কোনো একজনকে পাঠালেই হবে। এক ঘণ্টা পরে পাঠাবে। এখন at