জ্বর বাধিয়েছিস নাকি রে ব্যাটা?
হুঁ।
খুব ভালো করেছিস।
অন্তু আগ্রহ নিয়ে বলল, খুব ভালো করেছি কেন বাবা?
অন্তু জানে তার বাবা উল্টাপাল্টা কথা বলে, কথা শুনলে মনে হয় ভুল কথা। আসলে ভুল না। বাবা যখন বলেছে জ্বর হয়ে ভালো হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। ভালোটা কী তা সে বুঝতে পারছে না।
হাসান গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, জ্বর বাঁধিয়ে ভালো করেছিস, কারণ জ্বর হবার কারণে সবাই তোকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ পানি ঢালছে, কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, স্কুলে যেতে হচ্ছে না।
আমার স্কুল ভালো লাগে না বাবা।
আমারো লাগে না। আমার ক্ষমতা থাকলে সব স্কুল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম।
অন্তু আনন্দে হেসে ফেলল। সে আগেও লক্ষ্য করেছে একমাত্র বাবাই তার মনের কথাগুলি জানে। আর কেউ জানে না। অন্তু বলল, বাবা তুমি সুপারম্যান হলে ভালো হত।
কীরকম ভালো?
সুপারম্যানদের পাওয়ার থাকে। পাওয়ার দিয়ে তারা সব জ্বালিয়ে দিতে পারে। টিভিতে দেখেছি।
কোন্ চ্যানেলে?
কার্টুন চ্যানেলে।
আমি সুপারম্যান হলে তুই কী হতি? সুপারম্যানের ছানা?
ধ্যাৎ সুপারম্যানদের কোনো ছানা থাকে না। বাবা আমার নাক দিয়ে সর্দি পড়ছে। গাড়িতে টিসু আছে?
টিসু ফিসু নেই। শার্টের কোনায় সর্দি মুছে ফেল।
মা বকবে।
মা জানলে তবেই না বকবে। নাকে সর্দি হয় কেন বাবা?
নাকটা হল নদীর মতো। বর্ষার সময় নদীতে যেমন পানি আসে, নাকে সেইভাবে সর্দি আসে। নাকে সর্দি আসিলে বুঝতে হবে শরীরে বর্ষা নেমেছে।
ধ্যাৎ, বাবা তুমি মিথুক হয়ে যাচ্ছ।
তা একটু একটু হচ্ছি। অন্তু, ডাক্তারের কাছে না গেলে কেমন হয়?
অন্তু উৎসাহের সঙ্গে বলল, খুব ভালো হয় বাবা।
হাসান বলল, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেয়ে চল দুজন খানিকক্ষণ রাস্তায় ঘুরি। আইসক্রিমের দোকান থেকে দুটা কোন-আইসক্রিম কিনে খাই।
বাবা আমি চকলেট ফ্লেভার খাব। তুমি কোন্টা খাবে?
হাসান বলল, আমি খাব ভ্যানিলা। তবে তোর চকলেট-কোনে একটা কামড় দেব।
ছোট করে কামড় দিও বাবা।
আমার মুখের যে সাইজ আমি সেই সাইজেই কামড় দেব। এরচে ছোট করে কামড় দেব কীভাবে? আমার মুখ কি তোর মতো ছোট?
অন্তু বলল, বাবা আমি কি তোমার ভ্যানিলা আইসক্রিম কোনে একটা কামড় দিতে পারি?
হাসান বলল, না। আমি সবকিছু শেয়ার করতে রাজি আছি। আইসক্রিম শেয়ার করতে রাজি না।
অন্তু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বাবা যা বলছে তা হল অন্তুর একেবারে মনের কথা। অন্তুও বাবার মত আইসক্রিম শেয়ার করতে পারে না। অন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না— পৃথিবীতে শুধুমাত্র বাবা কী করে তার মনের কথাগুলি বুঝে ফেলে, আর কেউ তো বুঝতে পারে না।
বাবা।
কি রে ব্যাটা?
শরীর খারাপ লাগছে বাবা।
মাথা যন্ত্রণা করছে?
হুঁ।
দেখি মাথাটা আমার কাছে নিয়ে আয়ত। জ্বর দেখি।
অন্তু মাথা এগিয়ে দিল। হাসান জ্বর দেখল। অনেক জ্বর। একজন ডাক্তার আসলেই দেখানো দরকার। হাসপাতালগুলি সারারাত খোলা থাকার কথা। শিশু-হাসপাতালে নিয়ে গেলে কেমন হয়। শিশু হাসপাতাল কোনদিকে তাও তো মনে পড়ছে না।
অন্তু বলল, বাসায় যাব বাবা।
হাসান বলল, তোর জ্বর বেড়েছে রে ব্যাটা। একজন ডাক্তার দেখিয়ে তারপর চল বাড়ি যাই। কোনটা আগে করব? ডাক্তার না আইসক্রিম?
আইসক্রিম খাব মা বাবা। আমাকে কোলে নাও।
গাড়ি চালাতে চালাতে কোলে নেব কীভাবে? তুই বরং এক কাজ কর। আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাক্।
ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে হাসানের পৌনে বারোটা বেজে গেল। ডাক্তার কোনো ওষুধ দেয়নি। প্রথমদিনের জ্বরে কিছু বোঝা যায় না। জ্বর কমানোর জন্যে সাপোজিটরি দিয়েছে। প্রচুর তরল খাবার খেতে বলেছে।
হাসান ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এল। সিগারেট খাবে, দেয়াশলাই নেই। রান্নাঘর থেকে দেয়াশলাই নিতে হবে।
নাজমা বলল, খবরদার এখন সিগারেট খাবে না। হাতমুখ ধুয়ে আসো, ভাত খাবে। রাত বারোটা পর্যন্ত আমি খাবার নিয়ে বসে থাকতে পারব না।
খাবারের কথায় হাসানের মনে পড়ল— লীনার বাসায় তার খাবার পাঠানোর কথা। ওরা সবাই নিশ্চয়ই না-খেয়ে অপেক্ষা করছে। খুবই ভুল হয়েছে। এত রাতে খাবারের কোনো দোকান কি খোলা আছে? পুরনো ঢাকার কিছু রেস্টুরেন্ট সারারাত খোলা থাকে। ওদের মোঘলাই খাবার খেতে ভালো।
নাজমা বলল, কী হল দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চিন্তা করছ?
হাসান বলল, আমাকে এখন একটু বের হতে হবে।
কোথায়?
হাসান চুপ করে আছে। সে অন্য এক বাসার জন্যে খাবার কিনতে যাবে, এটা বলা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। কী বলা যায় হাসানের মাথায় আসছে না।
কী হল, কোথায় যাবে?
জরুরি কাজ আছে—একজনকে খবর দিতে হবে।
পরিষ্কার করে বল তো। ঝেড়ে কাশো।
ঝেড়ে কাশার কিছু নেই। আমার খুবই জরুরি কাজ।
নাজমা শান্ত গলায় বলল, রাতে ফিরবে?
হাসান বলল, রাতে ফিরব মানে? রাতে কোথায় থাকব?
রাত বারোটার সময় জরুরি কাজে যাচ্ছ। দুটার সময় ফেরার চেয়ে না ফেরা ভাল না?
তুমি শুধু শুধু রাগ করছ নাজমা।
আমি মোটেই রাগ করছি না। আমি একটা সুন্দর সাজেশান দিলাম। আচ্ছা শোননা তোমার জন্যে একটা ভালো খবর আছে। ভালো খবরটা। এখন শুনবে নাকি রাত দুটার সময় যখন বাসায় ফিরবে তখন শুনবে?
ভালো খবরটা কী?
নীতুরও জ্বর এসেছে। একশ দুই।
এটা ভালো খবর ইল কীভাবে?
আমাদের অসুখবিসুখ হলে তুমি তো মনে হয় আনন্দিতই হও, এইজন্যে বলছি ভালো খবর।